—প্রতীকী ছবি।
ফরাসি ভূগোলবিদ ওনেসিম রক্ল্যু ‘ফ্রঁকফোনি’র উদ্ভাবক, তিনিই সর্বপ্রথম দেশগুলির শ্রেণি নির্ধারণ করেন ভাষার ভিত্তিতে। সামাজিক, অর্থনৈতিক বা নৃতাত্ত্বিক অর্থে নয়, ভাষিক স্তরে দেশের শ্রেণিবিন্যাস তাঁর সময়ে অভিনব এক চিন্তা। ফরাসি ভাষার আতশকাচে তিনি এই ভুবনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ফ্রান্স, ইউরোপ ছাড়িয়ে সেই দেশ বিস্তৃত হয়েছে আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে। আর দেশ মানেই তো ভাষা, ভাষা মানেই সাহিত্য দর্শন; স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিপ্লবের আদর্শ।
‘ফ্রঁকফোনি’র এক কথায় ব্যাখ্যা মুশকিল। এর ভাষিক অর্থ তো আছেই, আছে ভৌগোলিক, আধ্যাত্মিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অর্থও। ভাষিক স্তরে ‘ফ্রঁকফোনি’ নিষ্পন্ন ‘ফ্রঁকফোন’ থেকে, যার আভিধানিক অর্থ ‘ফরাসিতে যে কথা বলে’। ‘ফরাসি বলা’কে ‘ফ্রঁকফোনি’ অভিহিত করা যায়, এই সঙ্কীর্ণ অর্থেই শব্দটি সুবিদিত। ভৌগোলিক অর্থটি ভাষিক অর্থ দ্বারা নির্ধারিত। ভাষিক ও ভৌগোলিক স্তরে ‘ফ্রঁকফোনি’ এক জঙ্গম ধারণা। ভাষার বিস্তারের সঙ্গে তার সীমানাও প্রসার পায়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ফরাসিভাষীকে নির্দিষ্ট দেশ ও জাতীয়তার গণ্ডিতে বাঁধা যাচ্ছে না, সে হয়ে উঠছে দেশাতীত, যে-হেতু যে কোনও ব্যক্তিই ‘সম্ভাব্য’ ফরাসিভাষী। যে কেউ ফরাসি ভাষা আপন করে নিতে পারে, নিলেই সে হয়ে উঠছে বিশ্বজোড়া এক বৃহৎ গোষ্ঠীর অংশ।
আসা যাক আধ্যাত্মিক দ্যোতনায়। শুধু দেশ ও ভাষা নয়, এর অধিষ্ঠান হৃদয়ে, একটি কল্পিত গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতায়। ইংরেজিতে ‘ইংলিশ’ ও ‘ব্রিটিশ'-এর মধ্যে যেমন পার্থক্য: প্রথমটি জাতীয়তার দ্যোতক, দ্বিতীয়টি সংস্কৃতির। অনুরূপ পার্থক্য ফরাসি ও ‘ফ্রঁকফোন’-এর। অর্থাৎ সব ছাপিয়ে ‘ফ্রঁকফোনি’ এক বৌদ্ধিক নির্মাণ, এবং যে কেউই যে-হেতু ‘সম্ভাব্য ফ্রঁকফোন’, তাই তা ভবিষ্যগর্ভ। এই অর্থেই শব্দটির ব্যবহার সবচেয়ে প্রচলিত ও উদ্যাপিত। সেনেগালের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, কবি লেয়পলদ সেদার সঁগোর বলছেন, “ফরাসি ভাষা অর্গ্যানের সুমিষ্ট ধ্বনিতে তোলা বজ্রগর্ভ সুর, কখনও তা বাঁশি, কখনও ওবো, কখনও বা টমটমের ধ্বনি।” অর্থাৎ ভাষাটি একাধারে ইউরোপীয় ও আফ্রিকান।
আধ্যাত্মিক অর্থটি বিমূর্ত কিছু নয়; ভাষা, বিদ্যাচর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তব এক ঘটনা। গোষ্ঠীবদ্ধতার সঙ্গে এর যোগ হেতু ‘ফ্রঁকফোনি’র প্রাতিষ্ঠানিক দিকটিও উপেক্ষার নয়। কারণ বাস্তবে মানুষ মিলিত হলে তৈরি হয় সমন্বয়কারী কোনও সঙ্ঘ, সঙ্ঘ মানেই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ সমন্বয় জোটের নয়, জোট-নিরপেক্ষতার সমন্বয়। ফরাসি মূলত সংলাপের, সংহতির ভাষা। ফলত ‘ফ্রঁকফোনি’র প্রতিষ্ঠানগুলি উল্লম্ব নয়, অনুভূমিক, এখানেই ‘কমনওয়েলথ’-এর সঙ্গে ‘ফ্রঁকফোনি’র পার্থক্য; অতীত-রোমন্থনের বদলে ভবিষ্যতের আবাহন।
তবে ভাষা তো ক্ষমতা, শোষণ, সন্ত্রাসও। ফরাসি ভাষার বোলবোলাওয়ের পিছনে আছে তার প্রাক্তন উপনিবেশ। কোটি-কোটি মানুষের ঘামরক্ত নিংড়েই পুষ্ট হয়েছে এক-একটা ভাষা। ক্ষমতাই নির্ধারণ করে ভাষাকে। বিশ্ববাজারে ইংরেজির কাছে কোণঠাসা না হলে কি ফ্রান্সের প্রয়োজন হত ‘ফ্রঁকফোনি’ নামের এক সর্বরোগহর বটিকা?
আজকের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি কি আমরা অতীতের আয়নাতেই দেখব? ‘ফ্রঁকফোনি’ কি ফ্রান্সের উপগ্রহদের শাসন করার এক নয়া-ঔপনিবেশিক কৌশল? গোটা ছয় ইউরোপীয় ভাষা বিশ্বজয়ে বেরিয়েছিল, সাফল্য পেল তিনটি। অথচ প্রতিটিই ছিল নিজঘরে ক্ষীণকায়: ছোট্ট একটা দ্বীপে প্রচলিত ছিল ইংরেজি; স্প্যানিশ কয়েকটি স্থানীয় ভাষা ও অ্যারাবিকের চাপে হাঁসফাঁস; ফরাসিও তথৈবচ, রাজসভার ভাষা হয়ে শুধু বাবুয়ানি করছিল, ফ্রান্সের অন্যত্র বলা হত অন্যান্য উপভাষা। উপনিবেশ বানিয়েই এদের আজকের কলেবর বৃদ্ধি। আজকের ‘ফ্রঁকফোনি’ কি মুছতে পারছে সেই ইতিহাস? মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব নিয়ে ভারতে এলে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, বার্তাবাহক মন্দ তাতে কী, বার্তাটি তো উত্তম। আসলে ইতিহাসে অনেক অশুভই শুভর পথ প্রশস্ত করে। তাই বিশ্বযুদ্ধের পর সেনেগালের কৃষ্ণাঙ্গ লেখক লেয়পলদ সেদার সঁগোর রাষ্ট্রপুঞ্জের সংযোগের ভাষা হিসাবে বলেন লাতিনের কথা।
তাই যখন অতীত উপনিবেশগুলির একজোট হওয়ার প্রশ্ন সামনে এল, তাঁরা কেউ এস্পেরান্ত-র মতো নিরপেক্ষ ভাষা-নির্বাচনের দিকে হাঁটলেন না, বেছে নিলেন ফরাসি। কারণ তাঁরা নিজেরাই তো তখন প্রকাশের জন্য হাত পেতেছেন সে ভাষার কাছে। যে ভাষায় এক সময় লেখা হয়েছে ‘নাগরিক ও মানুষের অধিকারের ঘোষণা’, যে ভাষায় লিখেছেন দেকার্ত, রাবলে, ভলতের, রুসো, রাসিন, এখন লিখছেন ফ্রঁজ ফানঁ, ইয়ম্ব উয়োলোগোয়েম, এমে সেজার, সঁগোর, আমাদু কুরুমা। এই ‘অ-ফরাসি’দের অংশগ্রহণে ভাষাটা আরও পুষ্ট হচ্ছে। নিজের দেশের মায়া কাটিয়ে ভাষাটা নিজেই যেন হয়ে উঠছে একটা দেশ। শরণার্থীদের দেশ।
এই নতুন দেশের গা থেকেও বৈষম্য মোছে না। থেকে যায় অর্থনৈতিক ক্ষমতার চিহ্ন। ফরাসিতে প্রকাশিত বইয়ের বিশ্ববাজারে যে কৌলীন্য, স্থানীয় ভাষায় লিখলে কি তার ভগ্নাংশও জুটত? আফ্রিকা, ভিয়েতনাম বা মরিশাসের তাবড় লেখকদের বিষয়ে আমরা যে এতটা অবহিত, তা তাঁরা ফরাসিতে লেখেন বলেই না! নয়তো তাঁদের কপালেও জুটত বাংলা ভাষার লেখকদের দীর্ঘশ্বাস, ‘দিস্তে-দিস্তে লিখে চুপি-চুপি একা-একা মরে যাওয়া’-র নিয়তি।
এই কৌলীন্যের টানেই কি তবে মাতৃভাষা বিসর্জন? উত্তর সহজ নয়। ফরাসির আকর্ষণের সঙ্গে যোগ করতে হয় তার ঔদার্য, অন্য ভাষা-সংস্কৃতি থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের দিকেও চিরকাল দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছে। আলজিরিয়ার কামেল দাউদ, আফগানিস্তানের আতিক রাহিমি স্বদেশের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন ফরাসি অবলম্বন করে। ফরাসি তাই শুধু এক দেশ নয়, আগ্রাসকের বিরুদ্ধে আক্রান্তের অমোঘ হাতিয়ার।
১৯৭০-এর ২০ মার্চ প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা পেয়েছিল ‘ফ্রঁকফোনি’। বিশ্ব জুড়ে আজ পালিত হয় ফ্রঁকফোনি দিবস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy