দৃঢ়স্বর: গোয়ায় ৫৩তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নাদাভ লাপিদ (বাঁ দিক থেকে চতুর্থ)-সহ আন্তর্জাতিক জুরি সদস্যেরা, ২৭ নভেম্বর। পিটিআই
কেন কাশ্মীর ফাইলস একটি ‘মহান’ ছবি, সে বিষয়ে আপনার মতামত অনধিক ৫০০ শব্দে লিখুন। ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভবিষ্যতে জুরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এমন একটি প্রশ্নপত্রের অবতারণা করা হলে, খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি? মনে হয় না। নাদাভ লাপিদের ঘটনা থেকে আমাদের সরকার বাহাদুর অবশ্যই শিক্ষা নেবেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলে ফেলেছে, আরে এই বেয়াড়া লোকটাকে ডাকল কে? প্রশ্নটা শুনলে মনে হতে পারে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি বোর্ড আসলে খোলা মাঠের জলসা। হাতে সময় থাকলেই ঢুকে পড়া যায়। তার পর ‘আমি প্রধান জুরি হবওওও’ বলে বায়না ধরলে ‘আচ্ছা আচ্ছা হবেখন’ বলে কেউ এক জন পিঠ চাপড়ে দেয়। লাপিদকে এক হাত নেওয়ার আগ্রহে এই সব বালখিল্য প্রশ্ন তুলে সাংবাদিককুলের একাংশ এবং ‘ভক্ত’দের অনেকেই নিজেদের হোমওয়ার্কের অভাব প্রকট করছেন মাত্র। একই সঙ্গে লাপিদকে প্রধান জুরি হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি হোমওয়ার্কেও যে ‘গলদ’ থেকে গিয়েছিল, সেটাও চাপা থাকছে না।
‘গলদ’ এ কারণে নয় যে, একাধিক পুরস্কারজয়ী চিত্রপরিচালক লাপিদ, একাধিক প্রথম সারির উৎসবে জুরির দায়িত্ব সামলানো লাপিদ ভারতে প্রধান জুরি হওয়ার অযোগ্য। ‘গলদ’ এই কারণে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে লাপিদের কাজ এবং সমাজ-রাজনীতি বিষয়ে লাপিদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলে তিনি যে কড়া ধাতের লোক, সেটা আগে থেকেই জানার কথা। আর সরকার যদি সব জেনেশুনেই তাঁকে প্রধান জুরি হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে, তা হলে এখন নতুন করে গেল-গেল রব তোলা বৃথা। বরং, লাপিদের বক্তব্য প্রসঙ্গে হিরণ্ময় নীরবতা পালন করে পরমতসহিষ্ণুতার একটি প্রতীকী নজির তৈরি করা যেতে পারত। কিন্তু ভক্তদের গরম রক্ত সে কথা শুনবে কেন? অতএব তোলো আওয়াজ! ‘নাদাভ লাপিদ নিপাত যাও’ ধ্বনিতে মুখরিত করো আকাশবাতাস! আর লাপিদ যে নিজের দেশের সরকারের কাছেও একটি ‘আপদ’স্বরূপ, সে তো ইজ়রায়েলের দূতাবাস তাঁকে তিরস্কার করে বুঝিয়েই দিয়েছে।
বস্তুত সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। মনে রাখা যাক, এই বছরেই ইজ়রায়েলের প্রাক্তন সংস্কৃতি মন্ত্রী মিরি রেগেভ ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ফিল্ম ফান্ড’ নামে একটি অনুদান প্রকল্প চালু করেছেন। যার লক্ষ্য, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজ়রায়েলের ‘দখলদারি’র প্রশ্নটা ধুয়েমুছে দিয়ে ইজ়রায়েলপন্থী ছবি তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া। ইজ়রায়েলের এক ঝাঁক চিত্রপরিচালক খোলা চিঠি লিখে এই ফান্ডের বিরোধিতা করেছেন। নাদাভ লাপিদ সেই দলের অন্যতম। কাশ্মীর ফাইলস প্রসঙ্গে লাপিদ পরে যখন বলছিলেন, তিনি এই ছবিতে ফ্যাসিস্ট চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন এবং তাঁর আশঙ্কা যে অদূর ভবিষ্যতে তাঁর নিজের দেশেও এমন ছবি তৈরি হতে পারে, তিনি হাওয়ায় কথা বলছিলেন না। ইজ়রায়েলের মানুষ বলেই হয়তো আত্মপরিচয়ের জটিলতার দিকটা লাপিদকে খুব বেশি স্পর্শ করে। তিনি নিজে এক সময় ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন। এক জন ইহুদি হিসেবে হলোকস্টের ইতিহাস, ইজ়রায়েলের নির্মাণ, ইহুদিবিদ্বেষের প্রশ্নগুলো তাঁর কাছে আত্মিক ভাবেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একই সঙ্গে উগ্র অস্মিতাবাদ, যুদ্ধবাদ তাঁকে সমান ভাবে বিপন্ন করে। নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে সব সময় দ্বন্দ্ব জাগিয়ে রাখে। তাঁর মনে হয়, ইজ়রায়েলের জনমানসের মধ্যে কোথাও একটা অসুস্থতা গেড়ে বসে আছে। সে কথা খোলাখুলি বলতেও কার্পণ্য করেন না তিনি। এ দেশে যাঁদের আজকাল শহুরে নকশাল বা ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ বলে ডাকা হচ্ছে, ইজ়রায়েলে লাপিদের ভূমিকা অনেকটা সে রকমই। ভারতের উৎসব-কর্তারা সেটা বোধ হয় যথাযথ ভাবে খতিয়ে দেখেননি। অথবা, দেখে থাকলেও এটা ভাবতে পারেননি যে, ‘বন্ধু দেশ’ থেকে আসা একটা লোক সোজা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে ফেলবেন, “কাশ্মীর ফাইলস একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভালগার ছবি! এই মর্যাদাপূর্ণ উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে এই ছবির স্থান পাওয়ার কথা নয়!”
এখানেই শেষ না। লাপিদের কথা নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠার পরেও নিজের বক্তব্যে অনড় থেকে বিশদ ভাবে লাপিদ বুঝিয়ে দিয়েছেন, উৎসবের মঞ্চে তিনি কোনও আলটপকা মন্তব্য করেননি। যা বলেছেন, ভেবেচিন্তে বলেছেন। বলা উচিত মনে করেছেন বলেই বলেছেন। এক জন সৎ শিল্পীর যে অহং এবং দৃঢ়তা থাকার কথা, সেটা যে তাঁর আছে, লাপিদের প্রতিটি কথায় তা ফুটে বেরিয়েছে।
অন্য দিকে ভক্তদের কণ্ঠ, কাশ্মীর ফাইলস-এর টিম এবং ইজ়রায়েলের দূতাবাসের বক্তব্যে কী অদ্ভুত মিল! সকলেই টেনে আনছেন, শিন্ডলার্স লিস্ট-এর প্রসঙ্গ! লাপিদ ইহুদি বলে সকলের মনে হচ্ছে, এটাই হতে পারে তুরুপের তাস! হলোকস্ট নিয়ে শিন্ডলার্স লিস্ট ছাড়া আর কোনও ছবি যে কারও মনে পড়ছে না, সেটা আলাদা করে ভেবে দেখার মতো। ঠিক যেমন কাশ্মীর ফাইলস-এর আগেও যে পণ্ডিতদের উৎখাত-আখ্যান ছবিতে এসেছে, (আই অ্যাম, ২০১১, পরিচালনা: ওনির) সেটা আজকাল বিলকুল চেপে যাওয়া হয়। কিন্তু সে সব প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও বলা যায়, লাপিদের নিন্দুকেরা একটা জিনিসই চাইছেন— একটা ছবির সমালোচনাকে একটা ‘ইতিহাসের অস্বীকার’ বলে দেগে দেওয়া। সেই কারণে ইতিহাসের একটা নৃশংস অধ্যায়ের পাশে আর একটা নৃশংসতার উদাহরণ বসিয়ে বাজিমাত করতে চাইছেন! এটাকে প্রোপাগান্ডা বললে ওটাকে বলছেন না কেন-র মতো প্রশ্ন ছুড়ছেন। এ যেন দস্যু মোহনকে কাঁচা বললে ব্যোমকেশকে ভাল বলা চলবে না বলে দাবি তোলা।
কাশ্মীর ফাইলস-কে ভালগার বলা মানে যে পণ্ডিতদের নিপীড়নকে অস্বীকার করা নয়, সেটা কিন্তু এমনিতে একটা শিশুও বোঝে। তবু ইচ্ছে করেই তর্কটা সে দিকে নিয়ে যাওয়া হল, যাতে বাজার ভাল গরম হয়, হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো ক্লাস আরও বাড়ানো যায়। সেই ক্লাসে অবশ্য কোনও দিন পড়ানো হবে না, জীবনের সত্য আর শিল্পের সত্য এক নয়। তা হলে খবরের লাইভ সম্প্রচারই কাহিনিচিত্র বলে গণ্য হত। খবরের কাগজ আর উপন্যাসেও ফারাক থাকত না।
পড়ানো হবে না এটাও যে, কোনও শিল্পমাধ্যমে কী দেখানো হচ্ছে-র পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হল, কী ভাবে আর কী উদ্দেশ্যে দেখানো হচ্ছে। কাহিনিচিত্রের ক্ষেত্রে প্লট তার সামগ্রিকতার একটা অংশমাত্র। দৃশ্যনির্মাণে, অভিনয়শৈলীতে, শব্দ সংযোজনে, সঙ্গীত প্রয়োগে, সম্পাদনার কৌশলে ছবি জুড়ে একটা ভাষার জন্ম হয়। সেই ভাষার একটা রাজনীতি আছে। একটা চলচ্চিত্রকে দেখতে হয় সেই ভাষার চলনকে বিচার করে এবং সেই বিচারক্ষমতা অর্জন করতে হয় নির্দিষ্ট এবং নিবিষ্ট চর্চার মধ্য দিয়ে, ছবি দেখতে শেখার মধ্য দিয়ে। ছবি দেখা আর দেখতে শেখা, দুটো এক জিনিস নয়। খেলা দেখলেই যেমন কেউ ক্রীড়াবিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে না, গান শুনলেই যেমন হয় না সঙ্গীতবিদ, ঠিক তেমনই। এমনকি ছবি-করিয়ে মাত্রেই চিত্রবোদ্ধা নন সকলে। পাড়ার পাঁচুদা কবিতা লেখে বলে সে যেমন জীবনানন্দ দাশ নয়, ঠিক সে রকম। সুতরাং বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানদণ্ডে কাশ্মীর ফাইলস-কে কেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারধর্মী ছবি বলা হবে, তা নিয়ে রাগ দেখানো যেতেই পারে। কিন্তু তাতে ওই মানদণ্ড সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পায় না। লাপিদ কাশ্মীরের পণ্ডিতদের অসম্মান করেছেন মনে করে যাঁরা ফুঁসছেন, তাঁরা হয়তো জানেন না, লাপিদ বলেছেন, একটা বৃহৎ ট্র্যাজেডি নিয়ে ছবি করতে হলে সেটা সত্যিকারের সিরিয়াস ছবি হওয়া উচিত। নইলে সেই ট্র্যাজেডিকেই অসম্মান করা হয়।
মুশকিল এই যে, সম্মান-মর্যাদার মতো শব্দগুলোর একটা ওজন আছে। আছে সূক্ষ্মতার দাবি। জাতীয়তাবাদ-দেশভক্তির উগ্রচণ্ডা রূপ সবার আগে সেই সূক্ষ্মতাকে গলা টিপে হত্যা করে। কাঙ্ক্ষিত দার্ঢ্যের জায়গায় ফাঁপা চিৎকারের আমদানি করে। সেই পরম্পরাতেই কাশ্মীর ফাইলস-এর সমালোচনা কাশ্মীরে দুর্গতদের অসম্মান, ভারতের অসম্মানের সমার্থক হয়ে ওঠে। লাপিদ ‘বিশ্বাসঘাতক’ হয়ে যান, তাঁর দিকে শয়ে শয়ে হুমকি-শাসানি ধেয়ে আসে। ‘দেশকে গদ্দারোঁকো...’ বলে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রীর সেই প্রিয় স্লোগানটুকুই যা তোলা বাকি। এই ‘পাগলামি’ দেখে লাপিদ বিস্মিত। মত প্রকাশের স্বাধীনতার হাল বুঝে শঙ্কিত তার চেয়েও বেশি। তবে পিছপা নন। তাঁর বক্তব্য ঋজু এবং স্পষ্ট— “জুরি-প্রধান হিসেবে আমাকে তো ছবি নিয়ে মতামত দিতেই ডাকা হয়েছিল! আমার মত আমি জানিয়েছি!”
হক কথা। সে ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে প্রথম প্রশ্নেই ফিরতে হয়। এমন ‘বেয়াড়া’ লোককে ডাকা হল কেন? যিনি পুলিশম্যান বা সিনোনিমস-এর মতো ছবি করেন, ভারত সরকার কি আশা করেছিল, তিনি জুরিপ্রধান হয়ে কাশ্মীর ফাইলস-কে পুরস্কারে ভরিয়ে দেবেন? গলদ গোড়াতেই, এ বার দ্রুত ভুল শুধরে নিন। কে কোথায় পুরস্কার জিতেছে, সেই বায়োডেটা দেখে ডাকলে এমন গোলমাল আবার হতে পারে। তার চেয়ে ভাল করে প্রশ্নপত্র তৈরি করুন। অথবা, বিবেক অগ্নিহোত্রীকে স্থায়ী জুরিপ্রধান বানিয়ে দিন! ঘরেই এমন মহৎ পরিচালক থাকতে আবার বাইরে থেকে উটকো লোক আনা কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy