চ্যাটজিপিটি হল এআই-এর সর্বশেষ বিস্ময়। প্রতীকী ছবি।
এআই অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কী ভাবে যে এআই আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করছে, এক দিকে আমাদের অশেষ মঙ্গল করছে, আবার অন্য দিকে ঘোর বিপদ ডেকে আনছে, সাম্প্রতিক দুটো ঘটনা তা স্পষ্ট করে দিল। প্রথম, জানা গেল যে, বিদেশি প্রকাশকদের হতবাক করে দিয়ে এমন পাণ্ডুলিপি নাকি জমা পড়েছে তাদের কাছে, যেগুলো কোনও লেখকের লেখা নয়— চ্যাটজিপিটির লেখা। চ্যাটজিপিটি হল এআই-এর সর্বশেষ বিস্ময়। এক সুবিখ্যাত জাপানি কমিক-লেখক দাবি করলেন যে, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে তাঁর শেষ কমিক বইটির জন্য নতুন কাহিনি ফেঁদে দিয়েছে। দ্বিতীয় খবরটা ভারতের। জনৈক ব্যক্তি চ্যাটজিপিটিতে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন পুরে দিয়ে দেখলেন যে চ্যাটজিপিটি তাতে মোটেও ভাল ফল করতে পারল না, বাস্তবিক বেশ খারাপই করল মাত্র ৫৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে!
চ্যাটজিপিটি কী? এক বিরাট ‘ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’, যা তৈরি করেছে ওপেনএআই বলে এক কোম্পানি। একে তৈরি করা হয়েছে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। এবং ব্যবহারকারীদের ভাষাবিষয়ক সাহায্য সরবরাহ করার জন্য। আমাদের চার পাশের প্রযুক্তি জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে এই চ্যাটজিপিটি। আমাদের পরস্পরের সঙ্গে আদানপ্রদানেও। আরও অনেক কিছু করতে পারে এই জিনিসটি, এর মাধ্যমে গল্প-কবিতা লেখা যায়, ইন্টার-অ্যাকটিভ সম্পর্ক তৈরি করা যায়, ইন্টারনেট থেকে তথ্য খুঁজে বার করা যায়।
এর প্রধান সুবিধা হল, এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের যে কোনও প্রশ্নের চটজলদি,নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া সম্ভব। বিরাট পরিমাণ তথ্য ঘেঁটে, তার থেকে ছেঁটেকেটে উত্তরতৈরি করে দিতে পারে এটা। অর্থাৎ, গবেষণা বা শিক্ষার ক্ষেত্রে, এমনকি যে কোনও অঙ্ক বা ধাঁধার সমাধানের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান এই জিনিসটি। ব্যবসার কাজেও বিরাট ভাবে কাজে লাগানো যায় একে। উপভোক্তা পরিষেবায় এর দ্রুত ও দক্ষ প্রয়োগ হতে পারে।
না, কোনও শর্টকাটের জন্য এটা তৈরি নয়। আলসে মানুষের জন্যও তৈরি নয়। চ্যাটজিপিটির মধ্যে বিশাল মাপের সব সম্ভাবনা আছে— যেমন, প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে এটা। যাঁরা কি-বোর্ড বা মাউস ব্যবহার করতে পারেন না, তাঁদের জন্য এর ব্যবহার বৈপ্লবিক হতে পারে। দৃষ্টিশক্তির সমস্যাযুক্ত মানুষের জন্যও চ্যাটজিপিটির বিরাট মূল্য। তা ছা়ড়া ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে ভাবনাচিন্তা কথাবার্তা আদানপ্রদানেও এর বড় ভূমিকা থাকতে পারে। এর অর্থ— আন্তর্জাতিক কূটনীতি, বাণিজ্য বা সহযোগিতার ক্ষেত্রে এর দারুণ প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া চ্যাটজিপিটি দিয়ে অনুবাদের কাজ করতে পারবে যন্ত্রই। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কাজও পারবে। ভিন্ন ভাষার মানুষের মধ্যে সেতু বাঁধতে পারবে সহজে। প্রচুর সংখ্যক পরিসংখ্যান বা তথ্য ‘প্রসেস’ বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও রয়েছে চ্যাটজিপিটির, যা দিয়ে অনেক রকম কাজ সহজ হয়ে যাবে, বিজ্ঞান গবেষণা থেকে বাজার হিসাবপত্র, সবই। বড় মাপের তথ্য পড়ে ও বিশ্লেষণ করে অন্তর্নিহিত বক্তব্যে পৌঁছনো কিংবা ভবিষ্যৎ গতিপথ দর্শানো— সবই এর সাহায্যে জলবৎ তরল হওয়ার কথা। ব্যবসায়ী বা গবেষকদের যে এর ফলে কত সুবিধে হবে, তা আর বলে দিতে হয় না।
তবে কিনা, এত ভাল ভাল কথার পাশে কিছু সঙ্কটের কথাও বলা দরকার। চ্যাটজিপিটি কিন্তু অনেক বিপদের সম্ভাবনাও নিয়ে আসছে। প্রথমেই, প্লেজিয়ারিজ়ম বা অন্যের লেখা চুরি করার বিষয়টি আসে। পশ্চিম দুনিয়ার বাচ্চারা ইতিমধ্যেই চ্যাটজিপিটির সাহায্যে নিজেদের হোমওয়ার্ক করে ফেলছে! এর সঙ্গে যোগ হতে চলেছে আগে থেকেই তৈরি কোনও বিশেষ ঝোঁক কিংবা বৈষম্য সৃষ্টির বিরাট সুযোগ। চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে যা পাওয়া যায়, তার ভিত্তি যে-হেতু ওকে প্রশিক্ষণ দেওয়া তথ্য, এবং সেই তথ্যে যে-হেতু ঝোঁক বা বৈষম্য থাকতেই পারে— যে কোনও সমাধানের মধ্যেও তাই সেই ঝোঁক বা বৈষম্য আপনা থেকেই ঢুকে যাওয়ার কথা। যিনি সমাধানের অপেক্ষায় বসে আছেন, নিজের সম্পূর্ণ অজানতেই তিনি বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন। ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের সামনে খুব ভাল ফল করা যায়নি খানিকটা এই কারণেই। কেননা, যা তথ্য ওতে দেওয়া হয়, তার ভিত্তিতে এমন পরীক্ষার পুরো উত্তর লেখা যায় না— নিজের মাথাটা আলাদা করে খাটাতে হয়।
এর থেকেই বোঝা যায়, চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে কেন প্রোপাগান্ডা বা উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচার চালানো, কিংবা ভুল তথ্য ছড়ানো খুব সহজ। যে-হেতু এতে যা লেখা হবে, তার সঙ্গে সত্যিকারের মানুষের লেখার কোনও পার্থক্য থাকবে না, তাই কোনটা ঠিক তথ্য কোনটা ভুল, কে লিখছে, কিছুই বোঝা যাবে না। ব্যবহারকারীদের মধ্যে এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ঘটবে। নানা ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে— রাজনীতি, জনস্বাস্থ্য, কিংবা আরও এমন কোনও ক্ষেত্র, যেখানে সঠিক তথ্য জানাটা খুব জরুরি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চ্যাটজিপিটি ভুল পথে ব্যবহার করা যেতে পারে, ভ্রান্তিমূলক বা বিভ্রান্তিসূচক ইমেল ছড়িয়ে কিংবা অন্য রকমের সোশাল এঞ্জিনিয়ারিং বা সমাজ পরিবর্তনমূলক কাজকারবারের মাধ্যমে। এমনকি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও সঙ্কট তৈরি হতে পারে এর জন্য।
বলা বাহুল্য, এর ফলে যান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা বাড়বে, এবং মানুষের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে। এর সামাজিক ফলাফল যে কত বৈষম্যমূলক হতে পারে, সে আর বলে দিতে হয় না। অটোমেশন বা যন্ত্রনির্ভর ব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ে ঠিকই, কিন্তু তার ফলে চাকরি সঙ্কোচন এবং তারও ফলে সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যও বাড়ে। বিশেষত, ভারতের মতো জনবহুল দেশে এর যে কী ফলাফল হতে পারে, তা আর বলে দিতে হয় না। চ্যাটজিপিটির ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারকারী এবং অব্যবহারকারীর মধ্যে দূরত্বও দাঁড়াবে বিরাট। বাস্তবিক, এআই যাঁরা ব্যবহার করছেন, আর যাঁরা করছেন না, সেই দুই দলের মধ্যে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা প্রযুক্তি পৃথকীকরণ রেখা বেড়ে চলবে হুহু করে।
কী দাঁড়াল তা হলে? আমরা কি আশ্বস্ত হব এই জেনে যে, চ্যাটজিপিটি ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সমাধানে সাফল্য পায়নি? সম্ভবত, সেটাই হওয়া উচিত। (চ্যাটজিপিটি-কেই আমি এই প্রশ্নটা করেছি— কেন এমন হল। উত্তর পেয়েছি: “এআই ‘ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ হিসেবে আমার পরীক্ষা দেওয়ার বাহ্যিক (ফিজ়িক্যাল) ক্ষমতা নেই, যে তালিকায় ভারতের সিভিল সার্ভিসের জন্য তৈরি ইউপিএসসি পরীক্ষাও পড়ে।”) ক্রমশ প্রশ্নপত্র-নির্মাতারা নিশ্চয়ই চাইবেন, প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর নিজে নিজে ভাবার ক্ষমতা কিংবা সৃজনশীলতা কতটা, সেটাই দেখা হোক— কেবল মুখস্থ করে যেন পরীক্ষায় ভাল করা না যায়।
আর জাপানে পাণ্ডুলিপি-সংক্রান্ত যে কাণ্ড ঘটেছে, সেটা? শুনে কি আমাদের আঁতকে ওঠা উচিত? সম্ভবত না। কেননা, এআই মাধ্যমের মধ্যে এই লেখার ভাবনাগুলো কোথাও না কোথাও পুরে দেওয়া হয়েছে বলেই এমন ঘটতে পারল। কিন্তু যে কোনও আত্মমর্যাদাপূর্ণ লেখক চাইবেন, নিজের লেখায় নিজের ভাবনাই ফুটিয়ে তুলতে, নিজের ভাষায় সেই ভাবনা কেমন করে ফুটে উঠছে দেখাটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা। এখন তিনি যদি এআই-এর সহায়তায় কাজটা করে ফেলতে চান, তবে বলতে হবে তিনি লেখক হওয়ার আসল আনন্দটাই মাটি করে ফেললেন— হারিয়ে ফেললেন সৃষ্টির আনন্দ।
সুতরাং, চ্যাটজিপিটি (বা অন্যান্য এআই প্রোগ্রাম) নিশ্চয়ই আমাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ভাবনাচিন্তা, এবং প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিতে দিতে পারে। তাই, শেষ পর্যন্ত, আমরা কী ভাবে চ্যাটজিপিটি কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই বিরাট সম্ভাবনাকে ব্যবহার করছি, সেটাই ঠিক করে দেবে আমরা তার বিপদটাকে সরিয়ে রেখে নতুন সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব কি না। মানবিক বুদ্ধিমত্তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতার উপরে জায়গা দিতে পারব কি না। আমাদের নিজেদের সৃজনশীলতা এবং চরিত্রমর্যাদা এর হাতে নষ্ট হয়ে যেতে দেব কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy