‘আর্বান নকশাল’ বা ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ কিন্তু সরকারের ঘোষিত ভাষা ছিল না। প্রতীকী ছবি।
এবার থেকে আর আড়ালের প্রয়োজন নেই ভারত রাষ্ট্রের! প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, শুধু বন্দুকধারী মাওবাদীদেরই নয়, এ বার থেকে ‘কলমধারী মাওবাদী’-দের ধরপাকড় ও বিচ্ছিন্ন করার উপরে জোর দেওয়া হবে। তাঁর কথায়: “বন্দুক ধরে যে, সে যেমন মাওবাদী, তেমনই যিনি লেখনীর মাধ্যমে মাওবাদকে উৎসাহ দেন, তিনিও মাওবাদী। দু’জনেই দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। তাই এঁদের চিহ্নিত করে ছেঁটে বাদ দিতে হবে।” শাসক দল বিজেপি আরও একটি শব্দবন্ধের বহুল ব্যবহার করে থাকে: ‘আর্বান নকশাল’ বা ‘শহুরে নকশাল’। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রে এলগার পরিষদের ঘটনার পর কথাটি প্রথম শোনা যায়। একের পর এক গ্রেফতার করা হয় সমাজবিজ্ঞানী, কবি, মানবাধিকার ও সমাজকর্মী, পাদরি, আইনজীবী এবং অধ্যাপকদের। জেল হেফাজতে অশীতিপর পাদরি স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হলেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের তাতে ইতর-বিশেষ হয়নি।
দিল্লির কাছে ফরিদাবাদের সুরজকুণ্ডে ওই বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিভিন্ন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা ছাড়াও ছিলেন মুখ্য সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল, আধা সামরিক বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল এবং গোয়েন্দাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা। সেই বৈঠকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘কলমওয়ালা মাওবাদী’ সম্পর্কে আরও বললেন, “এই বিশিষ্ট জনেরা যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করতে এমন সব কথা বলেন, যাতে দেশের ক্ষতি হয়। ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি কোনও ভাবেই সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।”
কী ধরনের ক্ষতি করেন ‘কলমওয়ালা মাওবাদী’রা? তাঁদের মধ্যে কেউ ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে সরব হন, কেউ প্রান্তিক মানুষের উপরে নানা সামাজিক-রাজনৈতিক পীড়ন নিয়ে সমাজকে সচেতন করেন, কেউ উন্নয়নের নামে আদিবাসী-প্রান্তবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিন কেড়ে নিতে গেলে সাধ্যমতো বাধা দেন, কেউ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন জনজাতির অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন, সে সব অধিকার নিয়ে বই লেখেন, আবার কেউ বা রাষ্ট্রের কোপে পড়া প্রান্তিক জনজাতির মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সাহায্য দেন।
কোনও সন্দেহ নেই যে, এ সব কাজ যে কোনও আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের কাছে গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হয়। তাদের সুরে সুর না মেলালে রাষ্ট্র সব সময়েই ‘চতুর্দিকে কেমন এক অলৌকিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ পায়। যাঁরা এই সব কাজ করেন, সমাজ তাঁদের যে সম্মানের চোখেই দেখুক না কেন, তাঁরা শাসক দলের চোখে ‘গভীর ষড়যন্ত্রকারী’। তাঁদের বিশেষ কোনও তকমায় দাগিয়ে দিতে পারলে রাষ্ট্রের পক্ষে গণতান্ত্রিক বালাই সরিয়ে রেখে তাঁদের শায়েস্তা করার কাজটি সহজতর হয়। প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃত বিশেষণ, অতএব, শুধু কথার কথা নয়।
ওই বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনলে বোঝা যায়, তার মধ্যে ভয়ঙ্কর এক ইঙ্গিত লুকিয়ে রয়েছে। মোদী বলছেন, নকশালবাদের সমস্ত রূপকেই পরাস্ত করতে হবে। তাদের ছেঁটে ফেলতে হবে। এই ‘সমস্ত রূপ’ কথাটা প্রণিধানযোগ্য। কোন রূপকে ‘মাওবাদ’ বলে মনে হবে রাষ্ট্রের? কোনও লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট লেখক বা সাংবাদিককে ‘দেশদ্রোহী’ বলে মনে হতে পারে। কোনও নাটকে সরকারবিরোধী বক্তব্য থাকলে তার নাট্যকার ও পরিচালক মাওবাদী হিসাবে অভিযুক্ত হতে পারেন। সিনেমার পরিচালকের ক্ষেত্রেও একই দাওয়াই চলতে পারে। মানবাধিকার বা সমাজকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক— যে কোনও শাখার যে কোনও ব্যক্তির কথায় বা লেখায় কোনও রকম বিরোধিতার সুর থাকলেই তাঁকে ‘হীরক রাজার দেশে’ পাঠানো হতে পারে। সব রাজ্যকেই এ ব্যাপারে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
‘আর্বান নকশাল’ বা ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ কিন্তু সরকারের ঘোষিত ভাষা ছিল না। এই ভাষা ব্যবহার করত শাসক দল বিজেপি এবং হিন্দুত্ব রক্ষার স্বঘোষিত সংগঠনগুলি। গত বছর সংসদেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ব্যাপারে তাদের কিছু জানা নেই। এ বারে কিন্তু আর সে কথা বলার উপায় থাকবে না সরকারের। কারণ, সুরজকুণ্ডের সরকারি বৈঠকে খোদ প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলছেন!
শুধু এ কথাই নয়, ২০২৪-এর মধ্যে দেশের সব রাজ্যে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) শাখা গঠনের কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এবং, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা বিধিবদ্ধ করতে প্রয়োজনে আইন আনা হতে পারে। বিরোধীদের আশঙ্কা, এ ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর তোয়াক্কা না করে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ভারও নিজেদের হাতে নিতে চাইছে কেন্দ্র। এরই মধ্যে জল্পনা আরও উস্কে দিয়ে গোটা দেশের পুলিশের জন্য একই উর্দির পক্ষে সওয়াল করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এখানেও প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি ভবিষ্যতে গোটা দেশের পুলিশকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে চাইছে বিজেপি সরকার?
আধুনিক রাষ্ট্র কী ভাবে গোটা গণতান্ত্রিক কাঠামো নিজেদের কুক্ষিগত করতে চায়, তার চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্টিভেন লেভিটস্কি এবং ড্যানিয়েল জিব্লাট, তাঁদের হাউ ডেমোক্র্যাসিস ডাই গ্রন্থে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এই দুই অধ্যাপক বলছেন, আধুনিক রাষ্ট্রের কাছে অনেক সংস্থা আছে, যারা তদন্ত করে দোষী সরকারি অফিসার এবং সাধারণ নাগরিককেও শাস্তি দেওয়ার অধিকারী। এদের মধ্যে আছে বিচারব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা বিভাগ, কর ও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক শাখা। গণতন্ত্রে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলিকে তৈরি করা হয় নিরপেক্ষ মীমাংসাকারী হিসাবে। কিন্তু হবু স্বেচ্ছাচারীদের কাছে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জের, অন্য দিকে নানা সুবিধা পাওয়ার হাতিয়ারও বটে।
স্টিভেন ও ড্যানিয়েল বলছেন, যদি এই সব প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষ হয়, তা হলে তারা সরকারের বিভিন্ন অপকীর্তির তদন্ত করে তাকে শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু যদি ওই সব প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুগতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা হলে তারা ভবিষ্যতের স্বৈরাচারীর স্বার্থে কাজ করবে। তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যাতে সেই সরকার ক্ষমতাচ্যুত না হয়, তার জন্য তারা রক্ষাকবচের কাজ করবে।
ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই দুই গবেষকের বিশ্লেষণের সঙ্গে যদি কেউ এ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কোনও মিল খুঁজে পান, তা হলে তা নেহাতই অনিচ্ছাকৃত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy