লড়াই: মণীশ সিসৌদিয়াকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সমর্থকদের বিক্ষোভ। ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। পিটিআই
মল্লিকার্জুন খড়্গে, জয়রাম রমেশ, কে সি বেণুগোপালরা মরিয়া হয়ে একের পর এক বিরোধী দলের নেতানেত্রীকে ফোন করছিলেন। একটাই কথা বোঝানোর চেষ্টা চলছিল— “আজ আমাদের এ ভাবে নিশানা করা হলে, আগামী কাল আপনাদের সঙ্গেও হতে পারে।”
সাড়া মিলেছিল। রাহুল গান্ধীকে যখন ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় ইডি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করছে, তখন অধিকাংশ বিরোধী দলই মুখ খোলেনি। কিন্তু একই মামলায় সনিয়া গান্ধীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হতে কংগ্রেসের ডাকে অন্য দলগুলি এগিয়ে আসে। মল্লিকার্জুন খড়্গের আহ্বানে বিরোধীদের বৈঠকে ডিএমকে, এনসিপি, বাম, শিবসেনা, আরজেডি, ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর মতো দল তো ছিলই। কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি, অধুনা ভারতীয় রাষ্ট্র সমিতিও এগিয়ে এসেছিল। ১৩টি বিরোধী দল মিলে সনিয়া গান্ধীকে ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের সমালোচনা করে যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল, মোদী সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির অপব্যবহার হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিশানা করে, ইচ্ছাকৃত ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে।
গত বছরের জুলাই মাসে দিল্লিতে ১৩টি রাজনৈতিক দলের সেই বৈঠকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দল যোগ দেয়নি। এক, তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের নেতারা তখন সবাই কলকাতায়। ২১ জুলাইয়ের শহিদ দিবসের সমাবেশে ব্যস্ত। দুই, আম আদমি পার্টি। যে আম আদমি পার্টির নেতা, দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া এখন সিবিআই-এর জালে বন্দি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেজরীওয়ালের ডান হাত সিসৌদিয়া তখন থেকেই সিবিআই-ইডি’র আতশকাচের তলায়। অভিষেক কয়লা-গরু চুরির মামলায়। সিসৌদিয়া দিল্লির মদ কেলেঙ্কারিতে। দিল্লির রাজনীতিকদের আড্ডায় প্রশ্ন উঠেছিল, মোদী সরকার তথা বিজেপি কি সিবিআই-ইডি’কে কাজে লাগিয়ে বিরোধী জোটে ফাটল ধরাচ্ছে? বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে দেখা গিয়েছে, তিনি কোনও বিজেপি-বিরোধী জোটে থাকেন না। একই ভাবে সিবিআই-ইডি’র জুজু দেখিয়ে বিজেপি মমতা, কেজরীওয়াল বা চন্দ্রশেখর রাওদের বিরোধী জোট থেকে দূরে থাকার চাপ দিচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তখন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
সিবিআই, ইডি-র ভয় দেখিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোট থেকে তৃণমূল, ভারতীয় রাষ্ট্র সমিতি এবং আম আদমি পার্টিকে দূরে রাখতে পারলে যে নরেন্দ্র মোদীর লাভ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। উল্টো দিকে, বিরোধীরা যদি এককাট্টা হয়ে যান, তাতেও কি নরেন্দ্র মোদী লাভ দেখছেন?
ঠিক তা-ই। আদানি-কাণ্ডে প্রায় সব বিরোধী দলই যখন এককাট্টা হয়ে নরেন্দ্র মোদীর দিকে আঙুল তুলেছে, তার জবাবে লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাল্টা বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, ইডি সবাইকে এককাট্টা করে ফেলেছে— ভোটাররা যা পারেননি, ইডি সেটাই করে দেখিয়েছে। বিরোধীদের উচিত ইডি-কে ধন্যবাদ দেওয়া।
দু’মুখো তরোয়াল ঠিক এমনই হয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের সিবিআই-ইডি’র ভয়ে কিছু রাজনৈতিক দল বিরোধী জোটে থাকবে না। আবার ভয় কাটিয়ে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সব বিরোধী এককাট্টা হলেও নরেন্দ্র মোদী তাঁদের গায়ে কালি ছিটিয়ে বলবেন, সবাই চোর, তাই সবাই চুরির দায় থেকে বাঁচতে জোট বেঁধেছে। দু’দিকেই নরেন্দ্র মোদীর লাভ। বিরোধী জোটের লক্ষ্য মোদীর বিরোধিতা নয়, দুর্নীতি থেকে বাঁচা— এটা বোঝাতে পারলে বিরোধী জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা, নৈতিকতা নিয়ে প্রথমেই মানুষের মনে সংশয় তৈরি হবে।
এখানেই শেষ নয়। মোদী সরকারের গত আট বছরে কংগ্রেস-সহ প্রায় সব আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধেই কোনও না কোনও দুর্নীতির মামলা সিবিআই-ইডি’র খাতায় দায়ের হয়ে গিয়েছে। ফলে রাজ্য স্তরের রাজনীতিতেও সেই দুর্নীতির অভিযোগ কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে দেওয়াল তুলছে। কী ভাবে? পশ্চিমবঙ্গে যখন গরু-কয়লা পাচার থেকে নিয়োগ দুর্নীতিতে একের পর এক তৃণমূল নেতার নাম উঠে আসছে, তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী স্বাভাবিক নিয়মেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলছেন। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সময় রাহুল গান্ধী তেলঙ্গানায় গিয়ে কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের সরকারকে ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে আক্রমণ করেছিলেন। তার পরে মেঘালয়ে গিয়ে তিনি তৃণমূলকে সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে নিশানা করেছেন। গত বছরের অগস্টে আম আদমি পার্টির মণীশ সিসৌদিয়ার বাড়ি-দফতরে সিবিআই হানা দেওয়ার পরে দিল্লির প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা কেজরীওয়াল সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। এখন সিবিআই সিসৌদিয়াকে গ্রেফতার করলেও দিল্লির কংগ্রেস নেতারা এ ক্ষেত্রে সিবিআই-ইডি’কে অপব্যবহারের অভিযোগ তুলতে নারাজ।
এখানেও নরেন্দ্র মোদীর লাভ। তিনি সব বিরোধী দলের গায়েই দুর্নীতির কালি ছিটিয়ে রেখেছেন। এখন বিরোধী দলগুলি নিজেদের মধ্যেই সেই কালি ছেটাচ্ছে। বিরোধীদেরও কিছু করার নেই। পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি-পঞ্জাব, তেলঙ্গানায় তৃণমূল, আপ, বিআরএস-এর মতো দল কংগ্রেসের জমি দখল করেই বেড়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের হাতিয়ার পেলে, রাজ্য রাজনীতির বাধ্যবাধকতা মেনে কংগ্রেসকে সরব হতেই হচ্ছে।
জাতীয় স্তরে বিরোধী জোটের স্বার্থে তৃণমূল, আপ, বিআরএস-এর মতো দলকে যথাসম্ভব পাশে রাখা প্রয়োজন, তা কংগ্রেস নেতৃত্বের অজানা নয়। কারণ, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে না হলেও, ভোটের পরে তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে বিরোধী জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কে চন্দ্রশেখর রাও, অরবিন্দ কেজরীওয়ালরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন। তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন। আম আদমি পার্টি দিল্লি ও পঞ্জাবে। তেলঙ্গানায় বিআরএস। এই চারটি রাজ্যে ৭৮টি লোকসভা আসন রয়েছে। তাই দিল্লির প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা না চাইলেও মণীশ সিসৌদিয়াকে গ্রেফতারের পরে জাতীয় কংগ্রেস বিবৃতি জারি করে সিবিআই-ইডি’কে রাজনৈতিক অপব্যবহারের নিন্দা করেছে। অতীতে ঠিক এই কারণেই পেগাসাস স্পাইওয়্যার কাজে লাগিয়ে রাহুল গান্ধীর মতো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ ওঠার পরে কংগ্রেস অভিষেকের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে অবশ্য দু’বছর আগের কথা। এখন রাহুল গান্ধীর অভিযোগ, সিবিআই-ইডি’র চাপে তৃণমূল, আম আদমি পার্টি ও বিআরএস শুধুমাত্র যে বিরোধী জোটে ফাটল ধরাচ্ছে তা নয়, বিভিন্ন রাজ্যে ভোটে লড়তে গিয়ে তলে তলে বিজেপিকেই সুবিধা করে দিচ্ছে। গোয়া, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে তৃণমূল এ কাজ করেছে। আম আদমি পার্টিও গোয়া, উত্তরাখণ্ড, গুজরাতে এ কাজ করেছে। ভবিষ্যতে কে চন্দ্রশেখর রাও মহারাষ্ট্রে একই কাজ করতে চাইছেন।
এ সবের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সিবিআই মণীশ সিসৌদিয়াকে গ্রেফতারের পরে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতারণা, কারচুপির অভিযোগ প্রচারের আলো থেকে সরে গিয়েছে। বিরোধীরা নিজেরাই পরস্পরের গায়ে দুর্নীতির কালি ছেটাচ্ছেন। আপাত ভাবে জনমানসে ধারণা তৈরি হচ্ছে, একমাত্র বিজেপি নেতারাই নিষ্কলঙ্ক। অথচ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নারায়ণ রাণে থেকে পশ্চিমবঙ্গের শুভেন্দু অধিকারী, অসমের হিমন্তবিশ্ব শর্মা থেকে কর্নাটকের বি এস ইয়েদুরাপ্পা, অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। হিমন্ত বা শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই কেন সিবিআই-ইডি হাত গুটিয়ে নেয়, বিরোধীদের সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণা, বিদেশে করফাঁকির স্বর্গরাজ্যে ভুয়ো সংস্থা তৈরি করে নিজেদের শেয়ার নিজেরাই কিনে শেয়ার দর বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্ত্বেও ইডি কেন তা নিয়ে তদন্ত করে না, সে প্রশ্নও পিছনে চলে যায়।
এ সব দেখে অন্তরালে বসে বোধ হয় এক জনই মুচকি হাসেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy