দু’চার দিন আগে চণ্ডীগড় থেকে এক জন অত্যন্ত পরিচিত মানুষ জানালেন যে, ওখানে তাঁর পরিচিত স্থানীয় মানুষজন বলছেন যে, “তোমাদের তো মমতাদিদি আছে, আমাদের রক্ষাকর্তারা কি সে রকম মানুষ, কে জানে।” মনে পড়ে গেল বেশ কিছু বছর আগে উত্তরপ্রদেশের একটি জায়গার কথা। কাজের সূত্রে সেখানে যেতে হয়েছিল। কথা হচ্ছিল সেখানকার শ্রমিক ইউনিয়নের এক জন নেতার সঙ্গে। সেই সময় তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে খুব সংগ্রাম চলছিল। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের যদি মমতাদিদি থাকত তা হলে এ ঝামেলা অনেক আগেই মিটে যেত।” মনে পড়ে গেল ২০১৯ সালে এক বন্ধুর সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসি-র বাংলাদেশি রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। সেই সময় রেস্তরাঁয় আমাদের সঙ্গে অন্য টেবিলে দু’এক জন অবাঙালি ভারতীয় মুসলমান ভদ্রলোকও খাচ্ছিলেন। রেস্তরাঁর মালিক আলাপ করলেন। প্রথম কথাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুশল কামনা করে দুটো কথা বললেন। সঙ্গে ভারতীয় যে দু’জন ছিলেন, তাঁরাও সুর মিলিয়ে হাসতে হাসতে ইংরেজিতে বললেন “আওয়ার প্রোটেকটর”। বলেই ন্যূনতম ন্যায্য দামে হাসপাতালে ওষুধের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে কথা বলতে লাগলেন— এক জন ছিলেন ডাক্তার। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় শোষিত মানুষের সংগ্রামী নেতা হিসেবে। এ বিষয়ে লেখালিখিও হয়েছে।
ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক অবস্থায় একটা ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সপক্ষে এবং বিপক্ষে একটা কথা অনেকেই বলেছেন, অবশ্যই দুটো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। একনায়কতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সপক্ষে কেউ কেউ বলছেন, এ দেশের পক্ষে এটা প্রয়োজন— এক জন সর্বোচ্চ শক্তিশালী নেতার। কেউ বলছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দিন-দিন দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। আবার জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকার এবং সরকারের পক্ষের মানুষজন দুঃখ হলেও অনেক সময় এটা বিশ্বাস করেন যে, কোনও বিরুদ্ধ পক্ষ থাকা মানে জয় নিরঙ্কুশ। বিরোধী পক্ষদের সমূলে নির্বংশ করাই সঠিক রাজনীতি— ছলে বলে কৌশলে যে ভাবেই হোক বহুমতপুষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার এ দেশে প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। প্রশ্ন করার মূল কান্ডারিরূপে মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই অবতীর্ণ হচ্ছেন। সেটা সবচেয়ে বেশি হয়তো বোঝেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। রাজ্যের নির্বাচনে এত বার প্রধানমন্ত্রীকে আসতে দেখিনি। এ দল-ও দলের সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্যের ভুল ও বিভ্রান্তকারী পেশি সঞ্চালনকে এড়িয়ে গিয়েও বলা যায় যে, মমতা-বিরোধী শাসক দলের ভাষণে রাস্তা আর সরকারি হাসপাতালের কথা তেমন ভাবে শোনা যায় না। এদের ওদের দুর্নীতির আপেক্ষিক অনুপাত নিয়েও তেমন কথা হয় না। পুরোটাই মমতাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, ‘সবাই মানলেও কেন মানবে না বাংলা’, যার মুখ মমতা। হয়তো যাঁরা মানতে চান না তাঁদের মুখ আর দেখা যায় না বলে, সবাই হারিয়ে যাচ্ছেন।
ভারতবর্ষের গণতন্ত্র ভবিষ্যতে কি চেহারা নেবে তা বলার সাধ্য আমার নেই। এখন যেমন দেখছি তাতে বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, ছোট-বড় পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী ভারতবর্ষের যেখানে যেখানে বিক্ষিপ্ত প্রতিপক্ষ দানা বাঁধছে, এমনকি বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী, সবাই বাংলার ভোটকে সর্বগ্রাসী ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই হিসেবে দেখছেন।
টাকাকড়ির সাহায্যে বিধায়ক লেনদেন হয়তো রাজ্যের ইতিহাসে তেমন সরব ছিল না। অন্য অনেক রাজ্যে এ সব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। চাহিদা-জোগান থাকলে বাজার থাকবে, এ সব আমরাই শেখাই। সত্যি বলতে কী, সেই বাজারের উন্মুক্ত চেহারাটা কি ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে? অনেকে বলছেন, প্রশ্নটা এখন আর শুধু পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে নয়।
এ রাজ্যে কংগ্রেস, বাম এবং তৃণমূল শাসনকালের ক্ষমতার অপব্যবহার বিরোধীরা হয় রুখে দিয়েছেন, নয় অনেক সংগ্রামের পর মানুষ পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ অবধি কোনও নির্বাচনেই প্রধানমন্ত্রীর নামে নতুন রাজ্য সরকারের নাম, এমন স্লোগান শুনিনি। আর প্রধানমন্ত্রীকে যদি বার বার এসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মোকাবিলা করতে হয়, তা হলে তো এ নির্বাচনে ভারতের অর্থাৎ গোটা দেশের ভবিষ্যৎ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাই নয় কি?
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির শাসক দল কতটা জোরদার হবে, সেটা এ রাজ্যের ভোটের ফল নির্দেশ করবে। তাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে তাঁদের এত চিন্তা। কেউ বলছেন, ভোটের পর বিধায়ক কেনা-বেচায় টাকার বন্যা বইবে।
ভয়ে ভয়ে একটা কথার প্রতিবাদ না করে পারি না— অর্থনীতি পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করি তো, তাই। রাজ্যে পালাবদল হলে শিল্প ম ম করবে, এমনটা তো উত্তরপ্রদেশে দেখিনি। আর পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে দিলেও চিনের তুলনায় জাতীয় আয়ে শিল্পের অনুপাত এ দেশে অন্তত ১৫ শতাংশের মতো কম। সেটা তো পশ্চিমবঙ্গের দোষে হয়নি। যা-ই হোক, বিরুদ্ধমত পোষণ করায় বিনাবিচারে জামিনহীন কারাবাস বুদ্ধিজীবীদের দগ্ধ করছে। এ রকম একটা গণতন্ত্র পছন্দ করা শক্ত। ‘কোনও প্রশ্ন নয়’— এটাই কি আমরা চাই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy