দক্ষিণায়ন? কাশী তামিল সঙ্গমম্ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী, বারাণসী, ১৯ নভেম্বর, ২০২২। পিআইবি।
টানা পনেরো বছর উত্তরপ্রদেশে সাংসদ থাকার পরেও গত লোকসভা নির্বাচনে রাহুল গান্ধী অমেঠী থেকে হেরে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখ রক্ষা করেছিল কেরলের ওয়েনাড়। হিন্দি বলয়ে হেরে গিয়ে দক্ষিণ ভারত থেকে জিতে আসার পরে রাহুল গান্ধী তিরুঅনন্তপুরমে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “প্রথম ১৫ বছর আমি উত্তর ভারতের সাংসদ ছিলাম। অন্য ধরনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কেরলে আসাটা নতুন অভিজ্ঞতা। কারণ আমি হঠাৎ বুঝতে পারছি, এখানে মানুষ শুধু উপর-উপর নয়, বিষয়ের গভীরে যেতে আগ্রহী।”
রাহুলের সেই মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক বাধে। বিজেপি বলেছিল, রাহুল উত্তর ভারত, বিশেষত হিন্দি বলয়ের অপমান করছেন। কংগ্রেসকে সেই বিতর্ক ধামাচাপা দিতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে অধুনা কংগ্রেস নেতাদের হাবেভাবে রাহুল গান্ধীর সেই কথারই ছায়া দেখা যাচ্ছে। হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য— রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ধরাশায়ী। তবে কংগ্রেস তেলঙ্গানা জয় করেছে। কর্নাটকের পর আরও একটি দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কংগ্রেসের দখলে। কংগ্রেসের নেতাদের এখন মনোভাব হল, বিজেপি গোবলয়ের ভোটারদের বোকা বানাতে পারলেও দক্ষিণ ভারতে সফল হচ্ছে না। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে। তাঁদের বোধবুদ্ধি বেশি। তাই তাঁদের কাছে কংগ্রেসই গ্রহণযোগ্য। বস্তুত কর্নাটকে কংগ্রেসের জয়ের পর থেকেই দলের নেতারা ‘বিজেপি দক্ষিণ ভারতে ধুয়ে-মুছে সাফ’ ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলেন। এখন তেলঙ্গানায় কংগ্রেসের জয়ের পরে তাঁরা সুখনিদ্রায় যাচ্ছেন।
এই বেলা বলা থাক, তেলঙ্গানায় পাঁচ বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মাত্র একটি আসনে জিতেছিল। তেলঙ্গানায় বিজেপি বড় শক্তি নয়। মূল লড়াই ছিল বিআরএস বনাম কংগ্রেসের মধ্যে। তা সত্ত্বেও এ বারের ভোটে বিজেপির আসনসংখ্যা এক থেকে বেড়ে আট হয়েছে। ভোটের হার পাঁচ বছরে দ্বিগুণ: ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশ ছুঁইছুঁই।
কংগ্রেসের নেতারা যে খবর রাখেন না, তা হল, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির ১৩০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে এখনই বিজেপির দখলে ২৯টি লোকসভা। এর মধ্যে ২৫টি লোকসভা কেন্দ্র কর্নাটকে। বাকি চারটি তেলঙ্গানায়। বিজেপির তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, পুদুচেরি থেকে কোনও সাংসদ নেই। ২০২৪-এ দক্ষিণ ভারতের ১৩০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি ৬০টি লোকসভা কেন্দ্র জিতে আসার লক্ষ্য নিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কাছে বিষয়টি খুব স্পষ্ট। তা হল, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে বিজেপি এমনিতেই যথেষ্ট লোকসভা কেন্দ্র জিতছে। এখান থেকে আর লোকসভার আসন বাড়ার সম্ভাবনা কম। বরং কমার আশঙ্কা রয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে হলে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত থেকে আরও বেশি আসন জিতে আসতে হবে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের মতো ৩০৩টি বা তার বেশি আসন জিততে হলে দাক্ষিণাত্যে আসন বাড়ানো জরুরি।
প্রশ্ন হল, কী ভাবে? যে কোনও রাজ্য দখলের মতোই বিজেপি এ ক্ষেত্রেও ধীরে-সুস্থে কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে এগোচ্ছে। গত বছর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বারাণসীতে ‘কাশী তামিল সঙ্গমম্’-এর উদ্বোধন করছেন, তখন কংগ্রেস বা অন্য দলের অনেকেই এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাঁদের মনে হয়েছিল, মোদী তো রোজই কোনও অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, এ আর নতুন কী! সত্যিই তো, আইআইটি-মাদ্রাজ ও বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি-র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে রাজনীতি খুঁজতে যাওয়ার আপাতভাবে কোনও কারণ থাকে না।
নরেন্দ্র মোদী ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-কে রাজনৈতিক পুঁজি করতে চাইছেন। কাশী ও তামিলনাড়ুর প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক যোগসূত্রকে তুলে আনতে চাইছেন তিনি। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র ‘দ্রাবিড় বনাম আর্য’ তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিতে প্রধানমন্ত্রী কাশী ও শিবকাশীর মেলবন্ধন ঘটাতে চাইছেন। তামিলনাড়ু থেকে শিক্ষক-পড়ুয়াদের বারাণসী, অযোধ্যা, গোরক্ষপুরে নিয়ে এসে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রের আদানপ্রদানের ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাইছেন। ডিএমকে বিজেপির বিরুদ্ধে হিন্দি আগ্রাসনের অভিযোগ তুললে প্রধানমন্ত্রী তামিল ভাষার প্রতি তাঁর ভালবাসা তুলে ধরছেন। এ বছরও ১৭ ডিসেম্বর থেকে ‘কাশী তামিল সঙ্গমম্’ শুরু হবে। তামিলনাড়ুর কয়েক হাজার শিক্ষক-গবেষক-পড়ুয়াদের কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের নবনির্মিত করিডর থেকে অযোধ্যায় উদ্বোধন হতে চলা রামমন্দির ঘুরিয়ে দেখানো হবে।
গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রধান নাদাপ্রভু কেম্পেগৌড়ার ১৮ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ মূর্তি উদ্বোধন করেছিলেন। জুলাই মাসে অন্ধ্রপ্রদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামী আল্লুরি সীতারামা রাজুর বর্ষব্যাপী ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর দিশানির্দেশ অনুযায়ীই অযোধ্যার রামমন্দিরে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের মতো সুউচ্চ, কারুকার্যকরা প্রবেশদ্বার বা গোপুরম তৈরি হচ্ছে। যেমনটা তামিলনাড়ুর মীনাক্ষী মন্দির বা কেরলের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে দেখা যায়। যাতে উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের মানুষও উত্তরপ্রদেশের রামমন্দিরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। দক্ষিণ ভারতকে পাখির চোখ করেই চলতি বছরে হায়দরাবাদে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজ়ামের হায়দরাবাদকে তাঁর পুরনো নাম ‘ভাগ্যনগর’ বলে উল্লেখ করেছেন।
বস্তুত, বিজেপি-আরএসএস মনে করে, দক্ষিণ ভারত গৈরিকীকরণের উর্বর জমি। তার জন্য দক্ষিণ ভারতের এক-একটি অঞ্চলের জন্য এক-এক রকম হিন্দু পরিচিতিতে কাজে লাগাতে বিজেপি তৈরি। তার জন্য হিন্দুত্বের মতাদর্শে খানিক অদলবদল করতেও বিজেপির আপত্তি নেই। কাশী তামিল সঙ্গমম্-এর মতো কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য একটাই। হিন্দু পরিচিতির সূত্র ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে একই সুতোয় বেঁধে জাতীয় ঐক্য তুলে ধরা। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক পুঁজি করে নির্বাচনে সাফল্য পাওয়া।
এই লক্ষ্যেই বিজেপি দলের দু’জন সাধারণ সম্পাদককে শুধু দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে আসন বাড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে। তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে নেতা-কর্মীদের নিয়মিত উত্তরপ্রদেশে বা গুজরাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর পাঠ দিতে।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে তামিলনাড়ুতে সবচেয়ে বেশি, ৩৯টি লোকসভা আসন রয়েছে। কর্নাটকে ২৮টি, অন্ধ্রে ২৫টি, কেরলে ২০টি, তেলঙ্গানায় ১৭টি লোকসভায় আসন রয়েছে। কংগ্রেসের অনেক নেতার বিশ্বাস, গত লোকসভা নির্বাচনের মতো বিজেপি এ বার আর কর্নাটক থেকে ২৫টি এবং তেলঙ্গানা থেকে ৪টি আসন জিততে পারবে না। কারণ দুই রাজ্যেই এখন কংগ্রেসের সরকার। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, ২০১৮-য় কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা জয়ের পরেও লোকসভায় তিন রাজ্যেই সিংহভাগ আসন বিজেপি জিতেছিল। এ বার কর্নাটকে কংগ্রেসের জয়ের পরেই বিজেপি এইচ ডি দেবগৌড়ার দল জেডি(এস)-এর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ফলে কংগ্রেসের লড়াই কঠিন হবে। তেলঙ্গানায় বিআরএস প্রধান কে চন্দ্রশেখর রাও কংগ্রেসের কাছে হারের পরে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবেন না বা গোপন আঁতাঁত করবেন না, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। তামিলনাড়ুতে পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচনে বিজেপি সাফল্য পেয়েছে। তামিলনাড়ু, কেরলে লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে আসন জিততে না পারলেও বিজেপির সংগঠন ক্রমশ বাড়ছে।
কংগ্রেসের নেতারা বলতেই পারেন, গত দু’দশক ধরে বিজেপি দক্ষিণ ভারত জয়ের চেষ্টা করলেও তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। দেড় দশক আগে বিজেপি কর্নাটকে প্রথম বার ক্ষমতায় এসেছিল। তার পরে বিজেপি কর্নাটকের বাইরে তেমন ভাবে পা ফেলতে পারেনি। সেই অটলবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আডবাণীর জমানায় ১৯৯৯-তে বিজেপি অবিভাজিত অন্ধ্রে তেলুগু দেশমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ন’টি আসন জিতেছিল। একই বছরে তামিলনাড়ুতে বিজেপি চারটি আসন জিতেছিল। এখনও পর্যন্ত কর্নাটকের বাইরে সেটাই বিজেপির সেরা সাফল্য। এখন তা হলে লোকসভা নির্বাচনের তিন মাস আগে বিজেপি আর কী করতে পারবে?
কংগ্রেসের নেতারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, দক্ষিণ ভারতেও নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছ কম নয়। আর সেই ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’ এ বারও নরেন্দ্র মোদীর প্রধান অস্ত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy