আমরাও: দিল্লিতে এআইসিসি-র সদর দফতরের সামনে কংগ্রেস সমর্থকদের জমায়েত। ২৫ মার্চ ২০২৩। ছবি: পিটিআই।
এত বুদ্ধি, কিন্তু মোদী-শাহ এক বারও ভেবে দেখলেন না যে, এ ভাবে রাহুল গান্ধীকে হেনস্থা করলে তাতে বিরোধীদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে?” শিবুদার উদ্দেশে প্রশ্ন করল শিশির। শিবুদা একটা বই হাতে নিয়ে আড্ডায় ঢুকেছিলেন— মাইকেল স্যান্ডেল-এর লেখা দ্য টিরানি অব মেরিট— সেটার পাতা ওল্টাছিলেন। প্রশ্ন শুনে খোলা পাতার উপরের দিকের কোণটা অল্প মুড়ে বইটা সরিয়ে রাখলেন। তার পর বললেন, “তুই-ই বল, যাঁদের এত বুদ্ধি, তাঁরা এই সামান্য কথাটা ভেবে দেখবেন না?”
পাল্টা প্রশ্নে মাথা চুলকায় শিশির। বলল, “সেই হিসাবটাই তো মেলাতে পারছি না।”
“মোক্ষম সময়ে বইটা পড়ছি, বুঝলি,” পাশে রাখা বইটার উপর বাঁ হাতের আঙুলগুলো রাখলেন শিবুদা। “গোটা দুনিয়ায় দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এমন বিস্ফোরণ ঘটল কেন, হার্ভার্ড-এর দর্শনশাস্ত্রের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক মাইকেল স্যান্ডেল তার কারণ সন্ধান করতে গিয়ে বলেছেন, গত কয়েক দশকে উদারবাদী রাজনীতি ক্রমেই সরে এসেছে মেরিটোক্র্যাসির— মেধাতন্ত্রের— দিকে। উদারবাদী রাজনীতি ক্রমশ ‘এলিট’দের রাজনীতি হয়ে উঠেছে। আর, বিশ্বায়িত অর্থনীতির ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠা খেলার বিভিন্ন ধাপে যারা হেরে গিয়েছে, যারা ‘এলিট’ হতে পারেনি, পারবেও না কোনও দিন, তাদের রাগ গিয়ে পড়েছে উদারবাদী রাজনীতির উপরে। দক্ষিণপন্থীরা সেই রাগটাকেই ব্যবহার করছে, ক্রমাগত নিজেদের ‘হেরে যাওয়া’ লোকের দলের অংশ হিসাবে দেখিয়ে।”
“এর মধ্যে রাহুল গান্ধী এলেন কোত্থেকে, সেটা বুঝলাম না।” গম্ভীর মুখে বলল তপেশ।
“এখনও বুঝিয়ে বলিনি, তাই বুঝিসনি।” তপেশের টিপ্পনীতে পাত্তা দিলেন না শিবুদা। “রাহুল গান্ধী কে বল দিকি? সাধারণ মানুষ রাহুল গান্ধীকে চেনে কোন পরিচয়ে? রাহুলের কথা ছাড়, যে কোনও নেতাকে— যে কোনও লোককে— মানুষ কী ভাবে চেনে? যে ভাবে চেনানো হয়, সে ভাবে চেনে। প্রত্যেকেই একটা ব্র্যান্ড— সুপারস্টোরের তাকের পর তাকে সাজানো পণ্যকে আমরা যেমন ব্র্যান্ড হিসেবে চিনি। কোনও সাবান শরীরের দুর্গন্ধ দূর করে, কোনও সাবান ত্বককে মোলায়েম বানায় আর কোনওটা জীবাণুর সঙ্গে লড়ে গড়ে তোলে সুরক্ষা কবচ— প্রত্যেকটাই ব্র্যান্ড পজ়িশনিং। বিপণন বিশেষজ্ঞরা সচেতন ভাবে, ভেবেচিন্তে তৈরি করেন নিজেদের ব্র্যান্ড-পরিচয়— অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটাকে গুরুত্ব দিয়ে, এমনকি বহু ক্ষেত্রে প্রকৃত পক্ষে যে বৈশিষ্ট্য আদৌ নেই বা অকিঞ্চিৎকর, তাকেই গুরুত্ব দিয়ে। রাজনীতিকদেরও ব্র্যান্ড এ রকমই। কারও ব্র্যান্ড নিজে থেকে তৈরি হয়, কারও ব্র্যান্ড তৈরি করে দেয় সংবাদমাধ্যম, আবার কিছু নেতা পেশাদার এজেন্সি নিয়োগ করে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করান। কিন্তু, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিচিতি আছে— ভেবে দেখ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর জ্যোতি বসুর ব্র্যান্ড পরিচিতি কতটা আলাদা, আবার তাঁদের থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচিতি কতখানি আলাদা। অরবিন্দ কেজরীওয়াল আর নরেন্দ্র মোদীর ব্র্যান্ড কতটা আলাদা।”
তপেশ ফের কিছু বলতে যাচ্ছিল, শিবুদা হাত তুলে থামালেন তাকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “আগে শোন, পরে ফুট কাটবি। ব্র্যান্ডিং-এর খেলাটা পুরনো, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি তাতে একটা অলৌকিক টুইস্ট দিয়েছে। তারা শুরু করল প্রতিপক্ষের ব্র্যান্ড তৈরির কাজ— নেতিবাচক, অবশ্যই। শুধু লাগাতার এক কথা বলতে বলতে মনমোহন সিংহকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলল মৌনমোহন হিসেবে। অঙ্কের হিসাব বলবে, মোদীর চেয়ে ডক্টর সিংহ অনেক বেশি বার ভাষণ দিয়েছেন সংসদে। কিন্তু সে হিসাব আর কে কষছে? ঠিক তেমনই, শুধু প্রচারের জোরে বিজেপি রাহুল গান্ধীর ব্র্যান্ডিং তৈরি করে দিল পাপ্পু হিসেবে। এমন জোরালো ব্র্যান্ডিং যে, সাধারণ মানুষের চোখে রাহুলের গ্রহণযোগ্যতাই নষ্ট হয়ে গেল।” একটানা কথা বলে থামলেন শিবুদা।
“অর্থাৎ রাহুল পাপ্পু, অতএব তাঁকে হেনস্থা করলেও সাধারণ মানুষ বিচলিত হবে না, এই তো? তা হলে গোড়ায় ওই সব উদারবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-টোভ বলছিলেন কেন?” ফাঁক পেয়েই প্রশ্ন করে তপেশ। শিবুদা একটু বিরক্তই হন এ বার। বলেন, “তুই শুধু ওটুকুই শুনবি বলে ঠিক করেছিস? তা হলে কানে আঙুল দিয়ে বস, বাকিরা শুনুক অন্য কথাগুলো। এই যে বিরোধী দলের নেতার নেতিবাচক ব্র্যান্ড তৈরি করে ফেলতে পারার ক্ষমতা, এটা কিন্তু সামান্য কথা নয়। বিরোধী দলের নেতাকে এক বার ‘পাপ্পু’ বলে দেগে দিতে পারলে তাঁর কথার রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করার আর দরকারই থাকে না, তাঁকে নিয়ে পরিহাস করলেই চলে।
“গত সেপ্টেম্বরেও রাহুলকে সাধারণ মানুষ ‘পাপ্পু’ বলেই চিনত। আজ কিন্তু চেনে না— ভারত জোড়ো যাত্রা আর কিছু না পারুক, রাহুলকে সিরিয়াস নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। মানুষের মনোভাবের এই বদলটা বিজেপি বুঝেছে বলেই আমার বিশ্বাস। খেয়াল করে দেখ, ভারত জোড়ো যাত্রার প্রথম পর্বের পর থেকে বিজেপি রাহুলকে নিয়ে পরিহাস করা বন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি। এখন রাহুলের রাজনৈতিক বৈধতাকে যদি ফের প্রশ্নের মুখে ফেলতে হয়, তা হলে নতুন ভাবে তাঁর নেতিবাচক ব্র্যান্ডিং করতে হবে।”
গোপাল আবার চা দিয়ে গেল। শিবুদা কাপটা তুলে চুমুক দিলেন। একটু কিন্তু কিন্তু করে সূর্য বলল, “এ বারের ব্র্যান্ডিং কি তবে রাহুলকে এলিট ‘গণশত্রু’ হিসেবে দেখানোর?” হাত থেকে কাপটা নামিয়ে শিবুদা সূর্যর পিঠটা চাপড়ে দিলেন, “একদম। এ বারের আক্রমণগুলো খেয়াল কর। রবিশঙ্কর প্রসাদ বললেন, রাহুল যাতে মানুষকে যথেচ্ছ অপমান করতে পারেন, কংগ্রেস সেই অধিকার চায়। ধর্মেন্দ্র প্রধান আর অনুরাগ ঠাকুর সাংবাদিক সম্মেলন করে বললেন, রাহুল নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। রাহুলের কথাকে পেঁচিয়ে তাঁকে নিম্নবর্গের মানুষের বিরোধী করে দেখানো হল। একটাও অকারণে নয়, একটাও কাকতালীয় নয়। গত কয়েক মাসে রাহুল লাগাতার চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে আসার, মানুষকে তাঁর কাছে আসার সুযোগ করে দেওয়ার। কাজেই, এই মুহূর্তে তাঁর নেতিবাচক ব্র্যান্ডিং করতে হলে ঠিক এই জায়গাটাতেই আঘাত করা দরকার— তাঁকে সাধারণ মানুষের উল্টো দিকে থাকা, জনগণের প্রতি বিদ্বিষ্ট এলিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেটা করার ক্ষেত্রে এমনিতেই একটা সুবিধা আছে— রাহুল নেহরু-গান্ধী পরিবারের সন্তান, জন্মসূত্রেই ‘এলিট’। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ করার পরের দিনই তাঁকে বাংলো থেকে উচ্ছেদের নোটিস পাঠানো কি শুধু অপমান করার জন্য? একেবারেই নয়। এটা একটা ফাঁদ— রাহুল বাংলো ছাড়তে বিন্দুমাত্র আপত্তি করলেই বলা যেত যে, রাজপুত্র তো, তাই প্রাসাদ ছাড়তে রাজি নন! রাহুল এই ফাঁদটা এড়িয়েছেন। কিন্তু আমার কথা মিলিয়ে নিস, একের পর এক ফাঁদ পাতা চলবেই।”
“কিন্তু তাতেও আমার গোড়ার প্রশ্নটার উত্তর মিলল না, শিবুদা। দুটো লেখা পড়লাম— একটা প্রতাপভানু মেহতার, একটা ক্রিস্তফ জাফ্রেলোর— দু’জনেই বলছেন, বিজেপি যেটা করছে, সেটা কঠোর কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রকাশ। সেটা বিজেপি হজম করতে পারবে কি না, গণতন্ত্র পাল্টা আঘাত করবে কি না, প্রশ্ন আছে দু’জনেরই। এতটা ঝুঁকি বিজেপি নিচ্ছে কেন?” প্রশ্ন করল শিশির।
“কেন, সেটার আসল উত্তর তো আমার কাছে নেই, তবে আন্দাজ করতে পারি।” আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন শিবুদা। “বিজেপি প্রচণ্ড ঝুঁকি নিচ্ছে, সন্দেহ নেই— সম্ভবত, এই জমানার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি। কিন্তু, সেটা না নিয়েও উপায় নেই। রাহুল যে ভাবে আদানিকে নিয়ে প্রশ্ন করে চলেছেন, সেটা ২০২৪-এর আগে বিপজ্জনক হতে পারে। এই মুহূর্তে রাহুলকে থামানো দরকার। সেটা সরাসরি হবে না, ফলে প্রয়োজন তাঁর নবার্জিত রাজনৈতিক বৈধতাকে লোকের চোখে নাকচ করে দেওয়া। যদি রাহুলকে দেশের সাধারণ মানুষের, হেরে যাওয়া মানুষের বিরুদ্ধ-শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া যায়, তা হলে আর রাহুলের আক্রমণের ক্ষমতাও থাকে না, আবার তাঁকে জব্দ করতে গিয়ে কর্তৃত্ববাদী আচরণের, অর্থাৎ স্বৈরতন্ত্রী শাসনভঙ্গির— কথাটা আমি বলছি না, মেহতা আর জাফ্রেলো বলছেন, আমি কোট করছি মাত্র— দায় গ্রহণ করার বাধ্যতাও থাকে না।
“কিন্তু, এখানেই গল্পটা শেষ হচ্ছে না। রাহুলকে আক্রমণের কেন্দ্র করে তুলতে পারলে তর্কটা চলে আসে রাহুলের রাজনীতির বৈধতা আর অবৈধতার বিন্দুতে— রাহুল যে প্রসঙ্গগুলো তুলছেন, সেগুলো নিয়ে আর মাথা না ঘামালেও চলে। তার চেয়েও বেশি সুবিধা হয়, বিরোধীরা যদি মূল প্রশ্নগুলো ছেড়ে নরেন্দ্র মোদীর দিকে আক্রমণ শাণাতে থাকেন— যেটার সম্ভাবনা বিপুল, কেউ সেটা করবেন গান্ধী পরিবারের কাছে ব্রাউনি পয়েন্ট পেতে, কেউ আবার ঘুরপথে নরেন্দ্র মোদীকেই সুবিধা করে দিতে। কারণ তেমনটা হলে লড়াই গিয়ে দাঁড়াবে ব্র্যান্ড রাহুল বনাম ব্র্যান্ড মোদীতে। ভারতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে যে লড়াই জেতা যে কোনও বিরোধী নেতার পক্ষেই কার্যত অসম্ভব। বিজেপিও সম্ভবত এই সুযোগের অপেক্ষায় আছে।”
শিবুদা উঠে পড়লেন। দরজা অবধি গিয়ে হঠাৎ পিছু ফিরে বললেন, “ভরসা কোথায়, জানিস? অনেক দিন না দেখে থাকার পর মানুষ শেষ অবধি দেখতে পায়। বুঝে নেয়, কে ভাই কে দুশমন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy