প্রতিবাদ: সাংবাদিকরা পথে নেমে এসেছেন খবরের অধিকার দাবি করে, মুম্বই, ৫ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই।
অক্টোবরের গোড়ায় ভারতের মিডিয়া জগতে এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটাকে আর কোনও ভাবেই অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। এক সঙ্গে ১২ জন সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশি চালাল দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল যারা সাধারণত সন্ত্রাসবাদ ও সংগঠিত অপরাধের তদন্ত করে। এই ১২ জন সাংবাদিকের মধ্যে ছ’জনকে জেরা করে স্পেশাল সেল, নিউজ়ক্লিক নামে একটি স্বীকৃত সংবাদ-সাইটের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও এক কর্মীকে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেফতার করা হয়। সংস্থার দিল্লির দফতর বন্ধ করে দেওয়া হল, দু’জন সম্পাদক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও সুবোধ বর্মার বাড়িতে তল্লাশি চলল, জেরা করা হল গুহঠাকুরতাকে। এক কার্টুনিস্ট-সহ অন্তত আরও ন’জন সিনিয়র সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশির পর কয়েক জনকে জেরাও করা হয়। যত দূর জানা যাচ্ছে, এই মামলায় চল্লিশেরও বেশি মানুষকে জেরা করা হয়েছে— যাঁদের সকলেই সাংবাদিক নন।
কোনও গভীর শিকড়-সম্পন্ন দলকে বিপদে ফেলার ক্ষমতা ছোট সংবাদমাধ্যমের নেই। তবুও গণমাধ্যমকে— বিশেষত ডিজিটালকে— নিয়মিত বিপদে পড়তে হচ্ছে। একাধিক সমীক্ষা বলছে, বড় গণমাধ্যম— যেমন সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল— প্রায় পুরোপুরি দুই-তিন জন ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে। সংগঠিত মাধ্যমে বিজেপির পক্ষের যে সমস্ত সাংবাদিক নাম করেছেন, তাঁদের বিজেপি-বিরোধীরা ‘গোদি মিডিয়া’ বলে চিহ্নিত করেন। আর সমাজমাধ্যম বা ডিজিটালে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) সেলের ব্যবহার তো বহুবিদিত।
এর বাইরে যাঁরা থাকার চেষ্টা করেছেন, মূলস্রোতের এমন সাংবাদিক ও সম্পাদকের চাকরি গিয়েছে, বহু সাংবাদিকের নামে মামলা ও জেল হয়েছে। অন্তত দু’জন সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশ ও সুজাত বুখারি আততায়ীদের হাতে হত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ভারত ১৮০ দেশের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচিতে গত এক বছরে ১৫০ থেকে ১৬১-তে নেমে গিয়েছে। এখন সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএ-তে (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট) সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করা হল।
ঠিক ৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জরুরি অবস্থা চলাকালীন পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ জ্ঞান প্রকাশের বই ইমার্জেন্সি ক্রনিকলস-এর একটা বড় অংশই সে সময়ে এসএফআই-এর সদস্য এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রবীরের উপরে পুলিশি অত্যাচার নিয়ে। এখন এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থায় প্রচারমাধ্যমকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি। সরাসরি সংঘাতে চলে গিয়েছিলেন, যে কারণে প্রচারমাধ্যম পুরোপুরি কংগ্রেস-এর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল।
উল্টো দিকে, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে, উপর থেকে চাপানো ‘সেন্সরশিপ’-এর পরিবর্তে ভিতর থেকে ব্যবস্থার পরিবর্তন করেছে বিজেপি। ইন্দিরা গান্ধীর মতো সার্বিক আক্রমণের রাস্তায় না গিয়ে, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটিয়েও এই কাজে বহুলাংশে সফল হওয়া যায়। গত কয়েক বছর ধরে ভারতে এই ভাবেই রাজনীতি-মিডিয়া সম্পর্কের প্রশ্নে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।
ওই যেটুকু পারেনি, সেই ফাঁকটুকু ধরে ডিজিটাল মাধ্যমে বিজেপিকে বিব্রত করছেন প্রবীর পুরকায়স্থ, রবীশ কুমার, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা থেকে কুণাল কামরার মতো স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানরা। বিজেপি খুব ভাল জানে ডিজিটাল মাধ্যম কী ভাবে কাজ করে। এখানে শুধুই প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করলেই হয় না, একটা পাল্টা ‘ন্যারেটিভ’ (আখ্যান) তৈরি করতে হয়। এত দিন একক ভাবে বিজেপি সেটা করছিল, এখন করছেন এই সাংবাদিকরাও। এখানে বিজেপির আরও একটা ভয় কাজ করছে। ভারতে যে কোনও রাজনৈতিক দলই জানে, যত দিন ক্ষমতায় থাকা যাবে তত সরকারের জনপ্রিয়তা কমবে। বিজেপিও সেটা অনুভব করছে। এক দিকে পাল্টা ‘ন্যারেটিভ’ এবং অন্য দিকে জনপ্রিয়তায় ভাটার আশঙ্কা বিজেপিকে বাধ্য করছে নিউজ়ক্লিক-এর মতো ছোট সংস্থার দফতরে তালা ঝোলাতে।
গত বছরখানেক ধরে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা সরকার পক্ষের তারকা সাংবাদিক/ডিজিটাল ‘প্রভাবক’ (ইনফ্লুয়েন্সার) তাঁদের গ্রাহক-দর্শক সংখ্যা কমছে বা যে হারে অতীতে বেড়েছে সেই হারে আর বাড়ছে না। আর যে সমস্ত সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও ‘প্রভাবক’ বিজেপি-বিরোধী ‘ন্যারেটিভ’ দিচ্ছেন, তাঁদের দর্শক সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সেই কারণেও ধরা হচ্ছে প্রবীর পুরকায়স্থ, ফাহাদ শাহ, শ্যাম সিংহ, সিদ্দিক কাপ্পান থেকে মহম্মদ জ়ুবেরদের। ও দিকে, কমেডিয়ান মানোয়ার ফারুকিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, প্রবল চাপে আছেন কুণাল কামরা, বীর দাস। গ্রেফতার করা হয়েছে অসংখ্য সমাজকর্মীকে— তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। কয়েক জনকে চাপ দিয়ে বাকিদের বোঝানো হচ্ছে যাতে তাঁরা নির্বাচনের পূর্বে সরকারকে ভীষণ রকম অপদস্থ না করেন। করলে কপালে সন্ত্রাস দমন আইন।
ঔপনিবেশিক আমলের সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএ যে ভাবে ভারতে এখনও কার্যকর, তাতে প্রায় কেউই শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হন না। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই আইনে ৪৬৯০ গ্রেফতার হয়েছে, মাত্র তিন শতাংশের সাজা হয়েছে, ২০১৬-১৯ সালের মধ্যে সাজার হার আরও কম, ২.২ শতাংশ। কিন্তু ইউএপিএ-তে দ্রুত জামিন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে গড়ে দু’বছর বা আরও বেশি সময় অভিযুক্তরা জেলে কাটান। বেরোনোর পরে আরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার কথায় ‘দ্য প্রসেস ইজ় দ্য পানিশমেন্ট’ (বিচার প্রক্রিয়াই শাস্তি)। ইউএপিএ সেটাই করতে পারে।
উল্লেখ্য, নিউজ়ক্লিক-এর বিরুদ্ধে গত দুই বছর ধরে বেআইনি অর্থ আমদানির তদন্ত চালিয়ে ইডি, দিল্লি পুলিশের আর্থিক লেনদেনের তদন্তকারী শাখা এবং আয়কর দফতর কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ পেশ করতে পারেনি। এখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে এঁরা চিনের ঘনিষ্ঠ, সে দেশের দুই মোবাইল সংস্থাকে নাকি আইনি সাহায্য দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলেন প্রবীর পুরকায়স্থ ও তাঁর বন্ধুরা। অভিযুক্তদের পক্ষে প্রতিক্রিয়া এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এই প্রতিবেদন তাদের সাংবাদিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এতই নিচু মানের যে কার্যত নিজেদের লেখার বিরুদ্ধেই একটি প্রতিবেদন তাদের গত সপ্তাহে ছাপতে হয়েছে। সেই লেখায় বামপন্থী নেত্রী কবিতা কৃষ্ণনকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, “খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন এমন সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের অজুহাত হিসাবে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনকে মোদী সরকার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে বলে আশঙ্কা করছি।”
এই অবস্থায় আর কিছু দিনের মধ্যেই আসতে চলেছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-২০২৩’। যত দূর জানা যাচ্ছে, এই আইন আরও কঠোর। যদি সরকারের মনে হয় সাংবাদিকরা ভুয়ো তথ্য দিচ্ছেন, আরও কঠোর শাস্তি হতে পারে। যেমন নিউজ়ক্লিক-এর ক্ষেত্রে এফআইআর-এ লেখা হয়েছে সাংবাদিকরা কৃষক আন্দোলনের সময় কৃষকদের উত্তেজিত করেছিলেন। এ দিকে শোনা যাচ্ছে, প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে নির্দিষ্ট কোনও অপরাধের কথা মেলেনি, অস্পষ্ট অভিযোগের একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছে মাত্র। এই লেখার সময়ে নিউজ়ক্লিকের অফিস ও বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই। আর, পুরনো একটি ঘটনায় ‘উত্তেজক’ ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করার অনুমোদন দিয়েছেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট-গভর্নর।
বুঝতে অসুবিধা নেই, আরও কঠোর আইন এলে সাংবাদিকতার একমাত্র জোরের জায়গা
‘স্পিকিং ট্রুথ টু পাওয়ার’— ক্ষমতাকে সত্যি কথা শোনানোর সাহস— আর কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে জানা নেই। মনে পড়ছে কাশ্মীরের এক বন্ধু সাংবাদিকের কথা। তিনি বলেছিলেন, ৫০০ শব্দ লিখে কে পাঁচ বছর জেলে থাকবে? সে সময় কাশ্মীরের সাংবাদিকদের জন্য দুঃখ হয়েছিল, এখন চিন্তা হচ্ছে নিজেদের জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy