বাজারে ডিমেরও যা দাম, তাতে তিন টাকা তেত্রিশ পয়সায় কতখানি বাড়তি পুষ্টি সরবরাহ করা যাবে, সে-প্রশ্ন উঠবেই। ফাইল ছবি।
সরকারি কীর্তিকলাপে লজ্জার কারণ থাকেই, অনেক কালই সেটা নিতান্ত গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সামান্যতম চক্ষুলজ্জার অভাব দেখলে এখনও, এমনকি এই ঘনতমসাবৃত পশ্চিমবঙ্গেও, মাঝে মাঝে গা-শিরশির করে। দিনকয়েক আগে মিড-ডে মিল সম্পর্কে রাজ্য সরকারের ঘোষণা শুনে তেমনই একটা অনুভূতি হল। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ সরকারি সুসমাচার: স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দুপুরবেলার খাবার দেওয়ার জন্য নির্ধারিত বরাদ্দ বাড়ছে। বৃদ্ধির পরিমাণ সপ্তাহে কুড়ি টাকা, অর্থাৎ ছ’দিনেরস্কুল ধরে দৈনিক ৩ টাকা ৩৩ পয়সা। এই বাড়তি টাকায় শিশুদের মরসুমি ফল, ডিম এবং মাংস খাওয়াতে চায় সরকার, যাতে তাদের আরও পুষ্টি হয়। এ জন্য বাড়তি প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
ফল বা মাংস ছেড়েই দিলাম, বাজারে ডিমেরও যা দাম, তাতে তিন টাকা তেত্রিশ পয়সায় কতখানি বাড়তি পুষ্টি সরবরাহ করা যাবে, সে-প্রশ্ন উঠবেই। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, এত দিন যে টাকা দেওয়া হচ্ছিল, তার তুলনায় বরাদ্দ বাড়ছে (উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে) ৪০ থেকে (প্রাথমিক স্তরে) ৬০ শতাংশ। এবং এই বৃদ্ধির পুরো দায় মেটাবে রাজ্য সরকার। শুনে আশা হয়েছিল, এত দিনে পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা দীর্ঘ দিনের বকেয়া একটি কাজ অন্তত কিছুটা এগিয়ে দিলেন।
কিন্তু সরকারি বিজ্ঞপ্তির পিছু পিছু কয়েক পা এগিয়েই সব আশা একেবারে পপাত চ মমার চ। মহামান্য সরকার বাহাদুর জানিয়েছেন, এই যে সপ্তাহে বাড়তি কুড়ি টাকা, এটা চার মাসের জন্য, তার পরে আবার বরাদ্দ ফিরে যাবে সেই পুরনো অঙ্কেই। তা হলে ফল? মাংস? নিদেনপক্ষে এক দিনের বদলে সপ্তাহে কয়েক দিন ডিম? চার মাস পার হলেই ছেলেমেয়েরা দেখবে— কোথায় বা কী, ভূতের ফাঁকি, মিলিয়ে গেল চট করে। এ যদি মঞ্চের নাটক হত, তবে এই দৃশ্যে নিশ্চয়ই কোনও বিবেকবান চরিত্রের কণ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত হত আবেগতাড়িত প্রশ্নবাণ: মহাসিংহাসনে বসে ক্ষুধার্ত শিশুদের সঙ্গে কেন এই নির্মম এবং কুরুচিকর রসিকতা?
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী কোনও নাটকের মধ্যে যাননি, নিরুত্তাপ কণ্ঠে জানিয়েছেন, বাড়তি টাকাটা সারা বছর দিতে পারলেই তাঁরা খুশি হতেন, কিন্তু তহবিল নেই, কেন্দ্রীয় সরকার এগিয়ে এলে বাড়তি খাবারের জোগান আরও চালানো যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কথা আপাতত থাকুক, কিন্তু রাজ্য সরকারের ‘তহবিল নেই’ যুক্তিটি দু’দিক দিয়েই অদ্ভুত— যেতেও কাটে, আসতেও কাটে। প্রথম কথা হল, তহবিল যদি না-ই থাকে, তা হলে এই সাময়িক উদারতা কেন? এবং সেটা বেছে বেছে এমন সময়েই, যখন দুয়ারে নির্বাচন? শিশুদের প্রতি সরকারি বদান্যতার আসল অঙ্কটা স্পষ্টতই সহজ এবং সরল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে কিছু পয়সা খরচ করে কয়েক মাস স্কুলে বাড়তি খাবার দিলে ভোটদাতারা শাসকের উপর প্রীত হবেন। ভোট হয়ে গেলে আর সেই প্রীতির দরকার থাকবে না, অতএব বরাদ্দ টাকা স্বস্থানে ফিরে যাবে। সস্তায় কার্যসিদ্ধি। ভোটের বাজারে অনেক লীলাই চলে, কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খাবার নিয়ে সকলের চোখের সামনে এমন তঞ্চকতা একটা সরকার করতে পারে? লজ্জা না থাকুক, চক্ষুলজ্জা থাকবে না?
কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় প্রশ্ন হল, তহবিল না থাকলে তহবিল জোগাড় করা হবে না কেন? সরকারি বাজেটের কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, তার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা তো শাসকদেরই কাজ। যে খরচ বেশি জরুরি, সেটা বাড়াতে হবে, তুলনায় কম জরুরি খরচ কমিয়ে তার সংস্থান করতে হবে। তা, স্কুলে শিশুদের একবেলা যথাযথ খাবার দেওয়ার থেকে বেশি জরুরি দায় আর কী হতে পারে? হাজার হাজার ক্লাবকে বার্ষিক পারিতোষিক দেওয়া? ছেঁদো কথা আর শেয়ালের যুক্তি ছেড়ে মূল সত্যটা যদি সাফ সাফ বলতে হয়, তবে সেটা এই যে, মিড-ডে মিল নামক বস্তুটিকে আমাদের সরকারি কর্তারা যথেষ্ট অগ্রাধিকার দেন না। অতীতেও দেননি, এখনও দেন না। দিলে এই প্রকল্পের চেহারা এত দিনে সম্পূ্র্ণ অন্য রকম হয়ে উঠত।
এই দেশেরই কোনও কোনও রাজ্যে তেমনটা হয়েছে। একটি বড় উদাহরণ তামিলনাড়ু। ঐতিহাসিক উদাহরণ। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেই সে-রাজ্যে স্কুলে খাবার দেওয়ার কিছু কিছু উদ্যোগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যে রাজ্য সরকার সেই উদ্যোগকে নিজেদের নীতি হিসাবে গ্রহণ করে, আশির দশকের মধ্যে রাজ্য জুড়ে স্কুলে মিড-ডে মিল চালু হয়ে যায়। এই বিষয়ে সম্প্রতি চমৎকার একটি লেখা পড়লাম। চিকিৎসক-আধিকারিক চন্দ্র মোহন বি এবং সাংবাদিক এ আর মেয়াম্মাই-এর লেখা প্রবন্ধটির নাম: ‘মিলস দ্যাট এডুকেটেড জেনারেশনস’— যে খাবার একের পর এক প্রজন্মকে শিক্ষিত করেছে। লেখাটি একটা ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিঃসংশয় করে তোলে। সেটা এই যে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে পেট ভরে খাওয়ানোর কাজটাকে গুরুত্ব দিলে অর্থাভাবে সে-কাজ আটকায় না। বস্তুত, ১৯৫৬ সালে তামিলনাড়ুতে মুখ্যমন্ত্রী কামরাজ যখন কাজটা শুরু করতে চান, তাঁর মন্ত্রিসভা থেকেও বাধা এসেছিল— টাকা কোথায়? রাজ্যের তহবিলে ঘোর অনটন, দিল্লিও কৃপণ অথবা অপারগ। মুখ্যমন্ত্রী তখন সরাসরি জনসাধারণের কাছে হাত পাতেন। মানুষ কেবল টাকাই দেয় না, প্রবল উৎসাহ দেয়, এবং নিজেরাও সেই উৎসাহে সঞ্জীবিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী সেই নতুন উদ্যোগের সূচনা করেছিলেন কবি সুব্রহ্মণ্য ভারতীর জন্ম-গ্রামে, এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্ধৃত করেছিলেন তাঁর একটি পঙ্ক্তি, যার অর্থ: এক জন মানুষও যদি খাবার না পায়, তবে আমাদের হাতে পৃথিবীটাই শেষ হয়ে যাবে।
পড়তে পড়তে মনে হল, এই রাজ্য যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা যদি স্থির করতেন যে— আর নয়, এ-বার হাল ফেরাতেই হবে, যে ভাবে হোক? যদি রাজ্যবাসীর উদ্দেশে বলতেন শাসকরা, “আমাদের তহবিল নেই, কিন্তু শিশুদের খাওয়াতে হবে, কেবল তাদের পেট ভরলেই হবে না, সুষম এবং সুস্বাদু খাবার দিতে হবে তাদের, যে ভাবে হোক তার বন্দোবস্ত করা চাই, আমরাও অন্য সব খরচ টেনে এবং চুরি-ডাকাতির মাত্রা কিছুটা কমিয়ে তহবিল জোগাড় করব, কেন্দ্রের কাছেও সমবেত ভাবে বরাদ্দ বাড়ানোর— অনুরোধ নয়— দাবি জানাব, আপনারাও যথাসাধ্য সাহায্য করুন।” কতটা সাড়া দিত পশ্চিমবঙ্গের সমাজ? সমাজের উপরতলার মানুষ কী করতেন বলা কঠিন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক, যাঁদের নিজেদের সামর্থ্য অতি সীমিত, তাঁরা অবশ্যই মুখ ফেরাতেন না। তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে হাতের কাছে, চোখের সামনে। এই রাজ্যেই কিছু কাল আগে তৈরি হয়েছে ‘আম্মা’— মিড-ডে মিল সহায়িকাদের সংগঠন। এই সহায়িকারা শিশুদের জন্য রান্না করেন, রান্নার জোগাড়যন্ত্র থেকে শুরু করে শিশুদের খাওয়ানো, এমনকি অনেক সময় খাইয়ে দেওয়া, তা-ও তাঁদেরই কাজ। পারিশ্রমিক হিসাবে যা পান, তার অঙ্কটা তামিলনাড়ু বা কেরলের মতো রাজ্যের তুলনায় যৎসামান্য বললেও কম বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই এক-এক জনের প্রাপ্তি দিনে দশ-পনেরো টাকায় এসে ঠেকে। কিন্তু আম্মা-র কর্মীরা যখন আন্দোলন করেন, তাঁদের দাবিপত্রের প্রথমেই থাকে— নিজেদের প্রাপ্য বাড়ানোর দাবি নয়— বাচ্চাদের খাবারের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি! এই মানুষগুলোই তো প্রকৃত সমাজ।
তাই বিশ্বাস করি, সমাজ যায়নি মরে আজও। সমাজ আর রাষ্ট্র যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁদের মৃত লজ্জাবোধকে যদি বাঁচিয়ে তোলা যায়, তা হলে ইতিহাস পাল্টানো সম্ভব। শাসকরা নিজেরা নিজেদের শোধরাবেন না। তাঁদের বাধ্য করতে হবে। সেটাই প্রকৃত সামাজিক আন্দোলনের কাজ, সত্যকারের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কাজ। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। যে কোনও সুযোগে গোল করার সম্ভাবনা। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে, নিছক ভোটের তাগিদে শাসকরা মিড-ডে মিলের টাকা সাময়িক ভাবে বাড়িয়ে বন্ধ দরজা একটু ফাঁক করেছেন, ওই ফাঁকটিতে পা রেখে সমস্বরে দাবি জানাতে হবে: সাময়িক নয়, এই বরাদ্দ বৃদ্ধি স্থায়ী হোক, দ্রুত বরাদ্দ আরও বাড়ানো হোক, বাড়ানো হোক সহায়িকাদের প্রাপ্য, গড়ে তোলা হোক মিড-ডে মিলের একটা সুষ্ঠু সবল ব্যবস্থা। যে নির্বাচনের ফসল তুলতে এই সরকারি হরির লুট, সেই নির্বাচনের দাবি-সনদে একটা প্রধান বিষয় হিসাবেই কেন উঠে আসবে না মিড-ডে মিল প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের এই দাবি? সেটাই তো যথার্থ রাজনীতি! কদর্য এবং হিংস্র পরম্পরার পঙ্কশয্যা ছেড়ে যে রাজনীতির গর্বিত নজির হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে পশ্চিমবঙ্গ?
দিবাস্বপ্ন? হবেও বা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy