দলবদলুদের ছড়াছড়ি সব রাজ্যেই। —ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস বিধায়ক বাইরন বিশ্বাস দলত্যাগ করে তৃণমূলে চলে গেলেন। ফের বোঝা গেল, এক বার জিতে যাওয়ার পরে তাঁদের প্রতিনিধি কী করবেন, তার উপর নির্বাচকদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তার জন্য আইনি ব্যবস্থাও পাকা করা আছে। ফলে দলবদলুদের ছড়াছড়ি সব রাজ্যেই। কর্নাটক তো এ ব্যাপারে অসামান্য নজির গড়েছে, সেখানে গত ২৫ বছর ধরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ছয় ভাগের এক ভাগ দল বদলেছেন।
মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু— সর্বত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি জেতার পরে, অথবা নির্বাচনের ঠিক আগে, দিব্যি দল বদল করছেন। তাঁর নির্বাচকদের কাছে ফেরত যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই। পশ্চিমবঙ্গে এক বিধায়ক বিধানসভার ভিতরে এক দলের, বাইরে আর এক দলের! একটা হিসাবে দেখাচ্ছে যে, ২০১৪ থেকে ২০২১-এর মধ্যে ভারতে পাঁচশো সাংসদ-বিধায়ক দলত্যাগ করেছেন, এবং ১১৩৩ জন প্রার্থী নির্বাচনের আগে দলত্যাগ করেছেন।
কেবল দল বদলের খেলাই নয়। প্রশ্ন উঠছে, ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ভিতটাই নড়ে গিয়েছে কি? আইনসভার গুরুত্বই ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, তার নিদর্শন অনেক। এ পর্যন্ত সতেরো বার লোকসভা গঠন হয়েছে, এগারোটি পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছে। কিন্তু অধিবেশনের মেয়াদ ক্রমাগত কমে গিয়েছে। প্রথম লোকসভা ৬৭৭ দিন কাজ করেছিল, ষোড়শতম লোকসভা ৩৩১ দিন। সপ্তদশতম লোকসভা তিনশো দিন পেরোবে না। আইনসভায় আলোচনা, প্রশ্নোত্তরের সময় কমছে, এমনকি বিল পাশের সংখ্যাও উত্তরোত্তর কমেছে। ১৯৫২ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত বাজেট নিয়ে আলোচনা হত গড়ে একশো ঘণ্টা, তার পর থেকে কমতে কমতে তা এখন পনেরো থেকে কুড়ি ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। এ বছর আলোচনা হয়েছে আঠারো ঘণ্টা। লোকসভায় জরুরি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিনটি ব্যবস্থা আছে। মুলতুবি প্রস্তাব, স্বল্প সময়ের আলোচনা, আর আধ ঘণ্টার আলোচনা। এই তিনটি উপায়ে প্রথম ত্রিশ বছরে গড়ে পঁচাত্তর থেকে একশোটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, এখন কুড়ি-ত্রিশটিও হয় না। প্রশ্নোত্তর পর্বও ব্যতিক্রম নয়— গত ২০ বছরে প্রশ্নোত্তরের জন্য ধার্য সময় কমে এখন দাঁড়িয়েছে অর্ধেক, বা তারও কম। ২০১০-২০২০, এই দশ বছরে ন’টি সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্ব সংঘঠিতই হয়নি।
রাজ্যগুলিও একই পথের অনুগামী। ২০১৫-২০১৭, এই সময়ে গুজরাতে বিধানসভা বছরে গড়ে ৩২ দিন, উত্তরপ্রদেশ ২২ দিন, দিল্লি ২১ দিন, তেলঙ্গানা ২৮ দিন অধিবেশন করেছে। বিল পাশের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, বিধানসভাগুলিতেও একই দিনে বিল পেশ ও পাশ হওয়ার নজির ভূরি ভূরি। এখান থেকে যে চিত্রটা বেরোয় তা হল, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বেশ কিছু ব্যাপারে মিল আছে। পার্টি-নির্বিশেষে লোকসভা, বিধানসভার গুরুত্ব কমেছে। প্রতিনিধিদের মূল কাজটাই যেন এলেবেলে হয়ে আসছে।
নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের ভিত্তি হয়, তা হলে প্রশ্ন, নির্বাচনের উপর সাধারণের নিয়ন্ত্রণ কতটা? ‘নিয়ন্ত্রণ’ নানা ভাবে বোঝা যেতে পারে। মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারছেন কি না, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যকলাপের উপর নির্বাচকদের মতামতের প্রভাব রয়েছে কি না, সব দল নির্বাচনের ময়দানে সমান পরিসর পাচ্ছে কি না ইত্যাদি। নির্বাচনে যোগদানের প্রশ্নে দরিদ্র যে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে, তা স্পষ্ট। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে জেতা প্রতিনিধিদের ৫৪২ জনের মধ্যে লাখপতি মাত্র ৪৫ জন, বাকিরা কোটিপতি। দশ কোটি টাকার বেশি সম্পত্তি রয়েছে ১৭৩ জন সাংসদের। পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এ নির্বাচিত ২৯৪ জন বিধায়কের মধ্যে মাত্র ১৫ জনের সম্পত্তি দশ লক্ষ টাকার কম। দেশের সবচেয়ে গরিব রাজ্য ওড়িশার ১৪৮ জন বিধায়কের মধ্যে মাত্র ২৪ জনের সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ লক্ষের কম। মাত্র ৫ জনের সম্পদ ১০ লক্ষ টাকার কম। সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আছে, নির্বাচনে দাঁড়ানো সাধ্যের বাইরে চলে গেছে।
কিন্তু হয়তো এ সবেরও উপরে স্থান পাবে আর একটি উদ্বেগ— ব্যক্তিতন্ত্রের উত্থান। রাজনৈতিক দল, সরকার এবং মিডিয়ার একাংশ— এই ত্রয়ীর মধ্যে এক অদ্ভুত জোট তৈরি হয়েছে। দল এক জন ব্যক্তির নামে ভোট চাইছে, একাংশ মানুষ সেই নামেই ভোট দিচ্ছে। প্রশাসনও সরকারি ব্যবস্থার বদলে ব্যক্তিকেই আশ্রয় করেছে, সারা ক্ষণ আমাদের শোনাচ্ছে ব্যক্তি কী করছেন, কী বলছেন, বা করতে চলেছেন। মূলধারার মিডিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশও তাই করছে। সেই একই ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রেরও একমাত্র প্রতীক হয়ে উঠছেন। বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দর, পেট্রল পাম্প, খবরের কাগজের পাতা, টেলিভিশনের পর্দা— সবেতেই এক ব্যক্তির ছবি।
কোনও এক জন ব্যক্তির কথা নয়, একটা প্রবণতার কথাই বলছি। সম্প্রতি প্রকাশিত অন্তত আটটি রাজ্যের বিজ্ঞাপন ক্রোড়পত্রে এক জনেরই ছবি দেখেছি, যেন এই সব রাজ্যে এক জনই আছেন! শৌচাগার থেকে গ্যাস, পেট্রল পাম্প থেকে জন-ঔষধি, মন্দিরে, গুহায়, সংসদ ভবনে শুধুই তিনি। রাজ্যগুলিতেও একই অবস্থা— কোনও এক ব্যক্তির ছবি না দেখে ঘর থেকেবেরিয়ে ঘরে ফেরা অসম্ভব। রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের রাজনীতি প্রতিনিধি-কেন্দ্রিক থেকে ব্যক্তিতান্ত্রিক হয়েই গিয়েছে। সংসদে, বিধানসভায় বা পঞ্চায়েতে যে প্রতিনিধিদের আমরা নির্বাচনে জেতাচ্ছি, তাঁরা যেন আছেন হাততালি দেওয়ার জন্য, আর হাততালি নেওয়ার জন্য রয়েছেন এক জন। বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রে তাঁর চেহারা আলাদা, কিন্তু সত্তাটি এক। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রস্থানের পথটি যেন ক্রমশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy