—প্রতীকী ছবি।
মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চন (এমসিকিউ) এই মুহূর্তে শিক্ষার্থী-মূল্যায়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদা যা শুরু হয়েছিল চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহজ ও নিরাপদ উপায় হিসাবে, তা আজ সর্বব্যাপ্ত। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রবেশিকা পরীক্ষা হোক বা ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ারিং, এমসিকিউ বিনা গীত নাই। সম্প্রতি এ রাজ্যে নতুন সিলেবাসে প্রথম ও তৃতীয় সিমেস্টারে পুরো পরীক্ষাটাই হবে সঠিক উত্তরের তলায় দাগ দেওয়ার আঙ্গিকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ যুক্তি হল কম্পিউটার যে কোনও মূল্যায়ন সহজে ও অতি দ্রুত করতে পারে। অবশ্য একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং প্রযুক্তির বিপর্যয় এই ধরনের পরীক্ষার নিরপেক্ষতার দাবিকে অনেকাংশে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটা জীবন্ত থাকছে, তা হল এই ভাবে শিক্ষার্থীর সঠিক মূল্যায়ন আদৌ সম্ভব কি!
এই এমসিকিউ মডেলকে সর্বরোগহর বলে বিবেচনা করার ভাবনার উৎস এক কল্পিত ধারণা যা মনে করে কম্পিউটার থেকে উৎসারিত সব কিছুই পবিত্র, এবং যে মূল্যায়নে মানবমেধা যুক্ত, তা দূষিত। এই মডেল শিক্ষার্থীর কাছে দাবি করে কুইজ়ের মতো জ্ঞান, মস্তিষ্কে জমা হবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ তথ্য একক যা শিক্ষার্থী তোতাপাখির মতো মুখস্থ করবে। শিক্ষার্থী অক্লেশে বলে দেবে কোন সালে এবং কোন তারিখে কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট ইস্তাহার প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সেই ইস্তাহারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার জানার দরকার পড়বে না। অনেকে বলবেন এমসিকিউ মডেলে ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নও থাকে। মজার কথা, সেই ব্যাখ্যা বা কোনও বিবৃতি পরবর্তী একাধিক সিদ্ধান্ত আসলে প্রশ্নকর্তা নির্ধারিত সমাধানমালা, যা থেকে প্রশ্নকর্তা মনোনীত ঠিক উত্তরটিকে চয়ন করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীর। এখানে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করার বা নিজের যুক্তিটিকে উপস্থিত করার কোনও সুযোগই নেই শিক্ষার্থীর। এই মডেলে তাই টেক্সট বই পড়ার কোনও উৎসাহ আর অবশিষ্ট থাকবে না। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় হাঁটলেই দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বিষয়-পিছু হাজার হাজার এমসিকিউ সম্বলিত রংবেরঙের সহায়িকা, বিষয়ভিত্তিক টেক্সট বই সেই সহায়িকার চাপে মুখ লুকিয়েছে।
শিক্ষাতত্ত্বের গুরুগম্ভীর আলোচনায় আমরা প্রায়শই সর্বাত্মক মূল্যায়নের কথা বলি। এই বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মূল কথা হল, যৌক্তিক ধারণার বিকাশ, বিচার করার ক্ষমতা, কল্পনাশক্তি, বিশ্লেষণের দক্ষতা। রচনাত্মক প্রশ্নোত্তর ছাড়া এই দক্ষতাগুলির একটিও অর্জন করা সম্ভব নয়। এক জন শিক্ষার্থী স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারবে না, বরং কতকগুলো নির্দেশ পালনে দক্ষ হবে, এই শিক্ষাব্যবস্থার দাবি আজ এটাই।
কয়েক দিন আগে স্নাতকোত্তর ও স্নাতক স্তরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষার ইংরেজি প্রশ্নপত্র নজরে এল। শতাধিক প্রশ্ন যাতে শিক্ষার্থীর সাহিত্যবোধ, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে বোঝার চেষ্টা নেই, আছে কেবল তথ্যের নির্ণয়। সমস্যাটা শুধু সাহিত্য বা সমাজ বিজ্ঞানের নয়,বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিষয় জ্ঞান বোঝার জন্য ‘স্টেপ মার্কিং’-এর ব্যবস্থা ছিল, যা এই মডেলে দরকারই পড়ে না। আশার কথা হল, দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্টের নতুন পরীক্ষাপদ্ধতির বিরোধিতায় সরব হয়েছেন।
বোঝা যায়, এই মডেলে শিক্ষার্থীরা ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পাবে, পাশের হার বাড়ার ফলে শিক্ষাকর্তাদের দুশ্চিন্তা কমবে, কিন্তু তৈরি হবে বিষয়ের গভীরতাহীন, যৌক্তিক ভাবনাহীন এক নতুন প্রজন্ম। যে যত মুখস্থ করতে পারবে, সে তত সফল হবে। প্রকৃত শিক্ষা তর্ক করতে শেখায়, প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখায়, শিক্ষার্থীকে কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে অজানা আকাশে উড়তে উদ্দীপ্ত করে। প্রথাগত শিক্ষার হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই সুযোগ কিছুটা হলেও ছিল। এমসিকিউ আসলে আজকের ভারতের জন্য অন্য তাৎপর্য বয়ে আনছে। আমরা আসলে তৈরি করতে চাইছি এক ধরনের তথ্যকেন্দ্রিক রোবট, সব কিছু যে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেবে, রাষ্ট্রনির্ধারিত ‘ঠিক উত্তর’টিকে চয়ন করা ছাড়া যে শিক্ষার্থীর আর কোনও কাজ অবশিষ্ট থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy