বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনা। —ফাইল চিত্র।
বালেশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন-দুর্ঘটনার আতঙ্ক এখনও কাটেনি। এই দুর্ঘটনার কারণ কী, তা নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ আর সিবিআই-এর অনুসন্ধান চলছে। তার আগে চোখ রাখা যেতে পারে ২০২২ সালে প্রকাশিত ক্যাগ-এর মূল্যায়নে (রিপোর্ট অব দ্য কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া)। এপ্রিল, ২০১৭ থেকে মার্চ, ২০২১— এই সময় কালে রেলের সামগ্রিক কাজের খতিয়ান মেলে এই রিপোর্টে। ভারতীয় রেলের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের মূল্যায়ন করেছে ক্যাগ, তার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।
ভারতের রেলপথগুলির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করতে চালানো হয় বিশেষ ধরনের যান, ‘ট্র্যাক রেকর্ডিং কার’। বিভিন্ন জ়োন-এ যত পরিদর্শন হওয়ার কথা, পরিদর্শনের সংখ্যায় খামতি রয়েছে তার ত্রিশ থেকে একশো শতাংশ। ইস্টার্ন রেলওয়ে-র সর্বোচ্চ গতিবেগের ট্রেনগুলির জন্য উপযোগী লাইনের পরিদর্শনের সংখ্যায় ঘাটতি আছে পঞ্চাশ শতাংশ। চারটি জ়োনে দেখা গিয়েছে, ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেনের লাইনে গত চার বছরে একটিও পরিদর্শন হয়নি। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, রিসার্চ ডিজ়াইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজ়েশন (আরডিএসও), লখনউ-এর তরফ থেকে ট্র্যাক রেকর্ডিং কার চালানোর পরিকল্পনাই নাকি জমা পড়েনি! ফলে, ট্রেন লাইনচ্যুতির সম্ভাবনা-সহ অন্যান্য ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা ধরাও পড়েনি, সতর্ক হওয়ার সুযোগও মেলেনি।
২০১৭-১৮ সালে বাজেটে রেলের সুরক্ষার জন্য ‘রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষা কোষ’ গঠন করা হয়, যার লক্ষ্য সংস্কার, প্রতিস্থাপন, সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত নিরাপত্তার কাজে টাকা জোগানো। এই টাকার একটা অংশ আসবে রেলের নিজস্ব পুঁজি (রেলওয়েজ় ইন্টারনাল রিসোর্সেস) থেকে— প্রতি অর্থবর্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, চার বছরে মোট কুড়ি হাজার কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত এই খাতে এসেছে মাত্র ৪,২২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সুরক্ষার জন্য বরাদ্দে খামতি রয়েছে ৭৯ শতাংশ। এমন বিপুল ঘাটতি থাকলে যে জরুরি নিরাপত্তার কাজ ব্যাহত হবে, তা বলা বাহুল্য। প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষা কোষের মোট পুঁজিও (পাঁচ বছরের জন্য এক লক্ষ কোটি টাকা) রেলের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার জন্য যে যথেষ্ট নয়, তার উল্লেখ এই রিপোর্টেই আছে।
রেল-দুর্ঘটনাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে সেই সব দুর্ঘটনা, যাতে মানুষের জীবনহানি ও জখম হওয়া, রেলের সম্পত্তিহানি, রেল ট্র্যাফিকের গোলযোগ হয়। আর দ্বিতীয় ভাগে থাকে অন্যান্য ছোটখাটো দুর্ঘটনা, যাতে ক্ষয়ক্ষতি তুলনায় কম। ২০১৭-২১, এই সময় কালে ভারতীয় রেলে প্রথম ধরনের ২১৭টি, ও দ্বিতীয় ধরনের ১৮০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বড় মাপের ১৬৩টি দুর্ঘটনা, এবং ছোট মাপের ১২২৯টি দুর্ঘটনা ঘটে ট্রেনের লাইনচ্যুতির কারণে। অর্থাৎ, মোট দুর্ঘটনার ৬৯ শতাংশের কারণ লাইনচ্যুতি। অথচ, পুরনো রেলপথগুলি নতুন করার কাজের জন্য বরাদ্দ ২০১৮-১৯ সালে ৯৬০৭ কোটি টাকা থেকে কমে ২০১৯-২০ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪১৭ কোটি টাকা। উপরন্তু, রেলের ১৮টি জ়োনের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে বরাদ্দ টাকার সদ্ব্যবহার করা হয়নি। ২০১৭-১৮ সালে সাতটি জ়োন মিলিয়ে মোট ২৯৯ কোটি টাকা অব্যবহৃত থেকে গিয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে ন’টি জ়োন মিলিয়ে ১৬২ কোটি, আর ২০১৯-২০ সালে পাঁচটি জ়োন মিলিয়ে ১২ কোটি অব্যবহৃত টাকা জমা করা হয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, রেল-দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যে লাইনচ্যুতি, তার নিরসনে প্রয়োজনীয় অর্থ যেমন দেওয়া হয়নি, তেমনই যেটুকু অর্থ দেওয়া হয়েছে তাও সম্পূর্ণ ব্যবহার করা হয়নি। এ ছাড়াও ১২টি জ়োন মিলিয়ে ২৭ হাজারেরও বেশি নন-এসি কোচে (৬২ শতাংশ) অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। টেন্ডার করা হয়নি, যন্ত্রের জোগানে ঘাটতি, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অব্যবস্থা— নানা কারণ দর্শিয়েছে রেল।
ভারতীয় রেলের লাইনচ্যুতির কারণ তদন্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয় ‘সুইস চিজ় মডেল’। এই মডেল অনুসারে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পর পর কয়েকটি স্তরে এমন ভাবে সাজানো হয়, যাতে একটিতে ছিদ্র থাকলে পরের স্তর তাকে আটকে দেয়। বিধি-নিষেধের পালন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ, কাজের তদারকি, বিভিন্ন বিভাগের কর্মীদের মধ্যে সংযোগ-সমন্বয় এবং নিরীক্ষণ— লাইনচ্যুতি মোকাবিলার পাঁচটি স্তর। এর মধ্যে একাধিক স্তরে একই জায়গায় ছিদ্র, অর্থাৎ গলদ থাকলে লাইনচ্যুতি ঘটে। দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই পাঁচটি স্তরের প্রতিটিতেই একই সঙ্গে ছিদ্র ছিল। ২০০৬ সালে রেল কর্তৃপক্ষ এই তদন্তের সময় নির্দিষ্ট করে দেন। আঞ্চলিক স্তরে তদন্তের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার দিনের পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে তা শুরু করতে হবে, সাত দিনের মধ্যে ফলাফল নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জমা করতে হবে, দশ দিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করবেন। আর কেন্দ্রীয় স্তরে তদন্ত করতে হলে দুর্ঘটনার দিনের পরবর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সমাধা করতে হবে। ক্যাগ রিপোর্ট বলছে, বিভিন্ন জ়োন মিলিয়ে গড়ে ২২ শতাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয়নি, ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ফলাফল সময়ে জমা পড়েনি, এমনকি ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ফলাফল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রহণও করা হয়নি।
প্রতি দিন গড়ে ২ কোটি ৩০ লক্ষ ভারতীয় রেলে যাতায়াত করেন। যাত্রী নিরাপত্তা কোথায় দাঁড়িয়ে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy