শাসনব্যবস্থা আসলে একটি জটিল যন্ত্রবিশেষ।
আফ্রিকার পশ্চিমে অতলান্তিক মহাসাগরের তীর থেকে শুরু করে গোটা উত্তর আফ্রিকা হয়ে পশ্চিম এশিয়া, আরও পূর্বে ইরান-পাকিস্তান পর্যন্ত প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রসারিত ইসলাম ধর্ম। পাকিস্তানের পূর্ব প্রান্তে এসে যেন তা খানিক স্তিমিত— মুসলিম নাগরিকের সংখ্যায় ভারত বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও দেশের জনসংখ্যায় তাঁরা মাত্র ১৫%।
ভারতের পূর্ব দিকে গুটিকয়েক দেশ বাদ দিলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নেই। তবে, এই দেশগুলি হেলাফেলার নয়। এক নম্বরে ইন্দোনেশিয়া— পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলমান জনসংখ্যা সে দেশে। দু’নম্বরে বাংলাদেশ, মুসলিম জনসংখ্যায় বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে ভারতের বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যা যোগ করলে পাওয়া যাবে মোট বাঙালি মুসলমান জনসংখ্যা। ভাষার নিরিখে বাঙালি মুসলমানদের স্থান দুনিয়ায় দু’নম্বরে, আরবি ভাষাভাষীদের পরেই।
ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে মুসলমানপ্রধান জেলা (অর্থাৎ যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মুসলমান) একটাও নেই। কিছু রাজ্য আছে, যেখানে একটা করে মুসলমানপ্রধান জেলা— কেরল, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা। একটার বেশি মুসলমানপ্রধান জেলা আছে মাত্র দু’টি রাজ্যে: পশ্চিমবঙ্গ আর অসম। এই দুই রাজ্যেই মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোর পিছনে আছেন বাঙালি মুসলমানেরা। অন্য দিকে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০% মুসলমান। একটা বাদে বাকি সব জেলাই মুসলমানপ্রধান। দক্ষিণ এশিয়ায় সংখ্যার বিপুলতার দিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানেরা তুলনারহিত। কাছাকাছি আসতে পারেন পঞ্জাবি মুসলমানরা, তবে তাঁদের সংখ্যা বাঙালি মুসলমানদের প্রায় অর্ধেক।
ইসলাম ধর্ম বাংলায় এত ব্যাপক ভাবে ছড়াল কী করে, এ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। হিন্দুত্ববাদীরা হয়তো ভাববেন, মুসলমান আমলে অত্যাচারের ফলে হিন্দুরা ধর্ম পরিবর্তন করেছেন। আবার কেউ ভাবতে পারেন যে, ইসলাম মুক্তির বাণী শুনিয়ে হিন্দুদের ধর্ম বদল করিয়েছে। প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক, কিন্তু আন্দাজে উত্তর দিলে চলবে না, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার দ্বারস্থ হতে হবে।
এমন নয় যে, বাংলায় প্রবল পরাক্রমশালী কোনও মুসলমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দিল্লির সুলতানি আমলই হোক, বা মোগল রাজত্বকাল, বাংলা সুবাকে বরাবর প্রান্তিক প্রদেশ হিসেবেই দেখা হয়েছে। বখতিয়ার খিলজির বাংলাবিজয়ের দশ বছরের মধ্যেই বাংলার প্রশাসক দিল্লির থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তী কালে দিল্লির পাঠানো সুবাদারেরা সুযোগ বুঝে নিজের মতো চলেছেন। স্বাধীন বাংলার মসনদে বসতেন মুসলমান সুলতানরাই। তবে, মেরে-ধরে বা লোভ দেখিয়ে হিন্দুদের মুসলমান বানানোর রাষ্ট্রনীতি ছিল বলে কোনও প্রমাণ মেলেনি।
শাসনব্যবস্থা আসলে একটি জটিল যন্ত্রবিশেষ। বাংলার রাজধানী থেকে যা ইচ্ছে ফরমান জারি করলে তা বাংলার গ্রাম-গঞ্জে তামিল হবে, যন্ত্রটি অত সরল ছিল না। যন্ত্রটিকে সচল রাখার জন্য মুসলমান প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় সমাজের হিন্দু ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হত, তাঁদের কথাও শুনতে হত। ১৪১০ সালে রাজা গণেশের বাংলার ক্ষমতা দখল, পরে গণেশের পুত্র যদুর (জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ) রাজত্ব প্রমাণ করে যে, তুর্কি-পঠানদের স্থাপিত শাসনযন্ত্রের মধ্যে বিত্তবান হিন্দুরা জায়গা করে নিয়েছিলেন। গণেশকে ধর্মীয় বিরোধের সম্মুখীন করতে হয়েছিল বটে। ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন সুফি ধর্মগুরুরা, কেননা শাসনের বৈধতার জন্য, সমাজের অনুমোদনের জন্য, সুলতানদের ধর্মের সম্মতি দরকার হত। গণেশের ক্ষমতা দখলের পর শেখ নুর কুতুবি আলম নামক ধর্মগুরু পড়শি রাজ্য জৌনপুরের সুলতানকে লিখলেন, ইসলামকে বাঁচান, বাংলাকে স্বাধীন করুন। জৌনপুরের সুলতান ফৌজ পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য ঘটনা হল, উপযুক্ত কাঞ্চনযোগে সন্তুষ্ট হয়ে ফৌজ ঘরে ফিরে গিয়েছিল। ইসলাম রক্ষার জন্য যুদ্ধ হয়নি।
বর্তমান রাজনীতির খেলায় লোকে হামেশাই অতীতকে জুড়ে দেয়। তাতে অতীতের কুশীলবরা নিজেদের সময়ের নয়, বর্তমানের লোকেদের লব্জে কথা বলেন। হালে বলিউডে ঐতিহাসিক ফিল্মের হিড়িক পড়েছে, তাতে এমন খেলা দেদার চোখে পড়ে। রাজা গণেশের উদাহরণের মতো অনেক ঘটনা বলে যে, ইতিহাসের ঘটনাগুলো শুধু ধর্ম দিয়ে নির্ধারিত হয়নি, বর্তমানের রাজনেতাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তো নয়ই। এমন নয় যে, বাংলায় কখনও কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়নি। তবে দুই-তৃতীয়াংশ বাঙালিকে (বর্তমান বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানদের অনুপাত) জোর করে, লোভ দেখিয়ে মুসলমান বানানো হয়েছে, এটা মানা শক্ত।
বঙ্গে ইসলাম প্রসারের পীড়ন বা প্রলোভনের তত্ত্বটিকে যদি বলি পুল থিয়োরি বা ‘টানা তত্ত্ব’, একটি বিকল্প তত্ত্বও আছে যার নাম দেওয়া যায় পুশ থিয়োরি বা ‘ঠেলা তত্ত্ব’। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ইসলামের জনপ্রিয়তার জন্য দায়ী হিন্দু ধর্মের জাতপাত প্রথা। উচ্চবর্ণের অত্যাচারে নিম্নবর্ণের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। বাইরে থেকে কেউ টানেনি, ভিতর থেকে ঠেলে বার করে দেওয়া হয়েছে।
এত ক্ষণ যা বললাম, তার খানিকটা আমেরিকার অ্যারিজ়োনা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটনের গবেষণার ফল— আগ্রহী পাঠক তাঁর দ্য রাইজ় অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার ১২০৪-১৭৬০ (১৯৯৬) এবং ইন্ডিয়া ইন দ্য পার্শিয়ানেট এজ ১০০০-১৭৬৫ (২০১৯), এই দু’টি বই পড়ে দেখতে পারেন। ইটনের মতে, ‘ঠেলা তত্ত্ব’তেও ঘাটতি আছে। যদি উঁচুজাতের অত্যাচারে ধর্মান্তরণ হয়, তবে ইসলাম কবুল করার পর তো লোকগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা। তা তো দেখা যায় না। বাংলার সাধারণ মুসলমানদের বেগতিক আর্থিক,সামাজিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলার ধর্মের বিন্যাসে স্পষ্ট ভৌগোলিক ভাগ আছে। পশ্চিমের তুলনায় পূর্বে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের অনুপাত বেশি। অথচ পশ্চিমের তুলনায় পূর্ববাংলা ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাব থেকে দূরে অবস্থিত ছিল। আবার, যে সম্প্রদায়গুলি থেকে বড় মাত্রায় ধর্মান্তরণ ঘটেছে, যেমন রাজবংশী, চণ্ডাল, পোদ— তাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার সম্পর্ক পোক্ত ছিল না। সম্পর্ক দুর্বল হলে বর্ণবাদী অত্যাচার কম হওয়ার কথা। তা হলে ধর্মান্তরণ কেন?
ইটন উত্তর খুঁজেছেন কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তনের মধ্যে। কোনও ধর্মকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছতে হলে তাকে কৃষিসমাজের মধ্যে জনপ্রিয় হতে হয়। ইটনের গবেষণা বলছে যে, ইসলাম কৃষিসমাজের গভীরে পৌঁছতে পেরেছিল। কী ভাবে? উত্তর আছে নদীদের মতিগতিতে। কপালকুণ্ডলা-য় বঙ্কিম লিখেছেন, “পূর্ব্বকালে সপ্তগ্রাম মহাসমৃদ্ধিশালী নগর ছিল। ...কিন্তু বঙ্গীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে সপ্তগ্রামের প্রাচীন সমৃদ্ধির লাঘব জন্মিয়াছিল। ইহার প্রধান কারণ এই যে, তন্নগরের প্রান্তভাগ প্রক্ষালিত করিয়া যে স্রোতস্বতী বাহিত হইত, এক্ষণে তাহা সঙ্কীর্ণশরীরা হইয়া আসিতেছিল; সুতরাং বৃহদাকার জলযান সকল আর নগর পর্য্যন্ত আসিতে পারিত না।” কপালকুণ্ডলার কালেই পথ পাল্টাচ্ছিল গঙ্গাও। আগে গঙ্গার মূল স্রোত দক্ষিণগামিনী হয়ে সমুদ্রে প্রবাহিত হত। দ্বাদশ শতাব্দীতে মূল স্রোত পূর্বে সরতে থাকে। ষোড়শ শতক নাগাদ দেখা যায়, মালদহের কাছে নদী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মূল স্রোত পূর্বগামিনী হয়ে পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে ঢুকে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার সঙ্গে মিশে সমুদ্রে পড়েছে। নদীর ভাঙচুর, বন্যা, পলিমাটিতে পূর্বের উর্বরতা বাড়ে, জনবসতি গড়ে ওঠে। অন্য দিকে, পশ্চিমের অবস্থা সপ্তগ্রামের মতো— নদী উজিয়ে জাহাজ আসার মতো জল থাকে না।
ওই ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতেই আকবর ও জাহাঙ্গিরের শাসনকালে বাংলায় মোগল শাসন কায়েম হয়। সুবিন্যস্ত মোগল প্রশাসন পূর্ববাংলার বিস্তীর্ণ জঙ্গল, নাবাল জমিকে আবাদ করায় গুরুত্ব দেয়, যাতে ভূমিরাজস্ব আদায় করা যায়। শ্বাপদসঙ্কুল বনে মহাল বানিয়ে চাষিদের বসতি তৈরি করা, পতিত জঙ্গুলে মাটি সাফসুতরো করে লাঙলের নীচে আনা, সমাজ থেকে দূরে প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসীদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, টানাপড়েন, দ্বন্দ্বকে ধারণ করা— কাজগুলো বিলক্ষণ শক্ত। সে কাজ সম্পন্ন হত উদ্যোগী মানুষদের নেতৃত্বে। ধার্মিক মানুষেরা সচরাচর নেতৃত্ব দিতেন, বিশেষত মুসলমান ধর্মগুরুরা। মৃত্যুর পর তাঁরা লোককাহিনি, লোকগীতি, কিংবদন্তির নায়ক হয়ে উঠতেন। পির, ফকির, বাবার আখ্যা জুটত— তাঁদের নামে গড়ে উঠত দরগা, মাজার, থান, মন্দির। পূর্ববাংলার স্থানীয় মানুষ ক্রমপ্রসারিত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজকে গ্রহণ করেন, সঙ্গে গ্রহণ করেন কৃষির সঙ্গে আসা ইসলামকে। কৃষিমাটির সীমানা পুবে এগিয়ে চলে, তাঁদের জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়ে। ইটনের মতে, ইসলামের ছড়ানোর পিছনে রয়েছে কৃষি অর্থনীতি প্রসারের এই প্রক্রিয়াটি।
প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে বাংলায় কৃষি সীমানা ও ইসলামের সীমানা এক সঙ্গে পূর্বমুখী অভিযানে নেমেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও ইতিহাসের উপর সেই অভিযানের গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, গুয়াহাটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy