Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Vladimir Putin

কর্তৃত্বের আসনে পুতিনই

পুতিনের একদা-ঘনিষ্ঠ অনুগামী জেনারেল প্রিগোঝিন গত জুন মাসে ইউক্রেনের রণাঙ্গন থেকে বিনা নোটিসে তাঁর ওয়াগনার বাহিনীর ভাড়াটে সেনাদের নিয়ে সটান রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এসে হাজির হন।

putin

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। —ফাইল চিত্র।

প্রণয় শর্মা
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪৮
Share: Save:

মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবুর্গ যাওয়ার পথে বিমান ভেঙে পড়ায় প্রাণ হারিয়েছেন রাশিয়ার বেসরকারি সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন, ও তাঁর শীর্ষস্থানীয় সেনাকর্তাদের কয়েকজন। তার পরেই রাশিয়া ও পশ্চিমি দুনিয়ায় তুমুল চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে— এর জের রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের উপর কতটা পড়বে?

পুতিনের একদা-ঘনিষ্ঠ অনুগামী জেনারেল প্রিগোঝিন গত জুন মাসে ইউক্রেনের রণাঙ্গন থেকে বিনা নোটিসে তাঁর ওয়াগনার বাহিনীর ভাড়াটে সেনাদের নিয়ে সটান রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এসে হাজির হন। যা ছিল কার্যত পুতিনের প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন। সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলেও, তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। কারণ, রুশ সেনাবাহিনীর অধিকাংশ কমান্ডার এবং সেনা পুতিনের প্রতি অনুগত।

ওয়াগনার সামরিক গোষ্ঠীর প্রধানের মৃত্যুর পিছনে তাদের কোনও ভূমিকা থাকার অভিযোগ মস্কো অস্বীকার করেছে। কিন্তু অন্তর্ঘাত, গুপ্তহত্যা, নাশকতা ইত্যাদির যে দীর্ঘ ইতিহাস রুশ সরকারের রয়েছে, সে দিকে তাকিয়ে রাশিয়ার সমালোচকরা মস্কোর সরকারি বয়ান মেনে নিতে নারাজ। রাশিয়া কমিউনিস্ট শাসনাধীন থাকার সময়েই দেখা গিয়েছে যে সেখানে বিরোধীদের পদত্যাগ করার সুযোগ দেওয়া হয় না। তাঁদের কাজ থেকে, এমনকি জীবন থেকেও বরখাস্ত করা হয়। স্তালিনের আমলে রাশিয়ায় বিরুদ্ধ-মতের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ইতিহাস নথিভুক্ত রয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পরেও সেই ধারা বজায় আছে। পুতিনকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার পরে বিরোধী পক্ষের রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষদের হত্যা করা হয়েছে, এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে।

প্রিগোঝিনের মৃত্যুকে যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, এ কথা সকলেই স্বীকার করছেন যে এর ফলে রাশিয়ায় পুতিনের কর্তৃত্ব আবারও মজবুত হয়েছে। এর আগে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং জেনারেল প্রিগোঝিনের মধ্যে বেশ কিছু দিন টানা বিতণ্ডা চলছিল। এই বিবাদ থামাতে না পারায় রাশিয়ার মানুষের মনে এমন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছিল যে, পুতিন যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে পারছেন না। ফলে রাশিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার ভিতর থেকে দুর্বল হয়ে অচিরেই ভেঙে পড়বে, এমন আশা পশ্চিমি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে জেগেছিল। কিন্তু এখন পুতিনের নৃশংসতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, তাঁর দুর্বলতার কোনও ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুতিন এত দিন কাজ করেছেন এক জন স্বৈরাচারী একনায়কের মতো নয়, একটা কোম্পানির প্রেসিডেন্টের মতো। সে কোম্পানির ডিরেক্টররা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত, আর পুতিন সেই সব বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজটা দক্ষতার সঙ্গে করেন। ফলে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিভিন্ন নেতার মধ্যে বিবাদের খবর প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেনি। নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে এই আপাত-ঐক্যের ভান বজায় রাখা পুতিনের দরকার ছিল। পুতিন সাফল্যের সঙ্গে প্রশাসন চালাচ্ছেন ভারসাম্য বজায় রাখা, এবং গোপনীয়তা বজায় রাখার দৌলতে।

ঠিক কোন পথ দিয়ে প্রিগোঝিনের মৃত্যু এগিয়ে এসেছিল, সে কথা জানা যায়নি, হয়তো কোনও দিনই জানা যাবে না। তবে এটা ঠিক যে প্রিগোঝিনের তরফে আচমকা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের সেনা নিয়ে মস্কোতে ঢুকে পড়ার ঘটনা পুতিনের এত দিনের সাবধানি ভারসাম্যের খেলাকে গুরুতর আঘাত করেছিল। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রাশিয়াতে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশীদাররা পুতিনের এই কর্তৃত্ব ও নমনীয়তা মিশ্রিত রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে সমর্থনই করেন। তাঁরা মনে করেন যে, পুতিন বা তাঁর মতো কোনও দৃঢ়চেতা মানুষ ক্ষমতার হাল ধরে না থাকলে, নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, মতবিরোধকে সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাঁদের আরও আশঙ্কা, পুতিনের হাত দুর্বল হলে, বা তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলে ক্ষমতাসীনদের শরিকি ঝগড়া একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসবে, আর তা রাষ্ট্র পরিচালনার বর্তমান স্থিতাবস্থাকে নড়িয়ে দেবে। তাতে তাঁরাই বিপদে পড়বেন।

পশ্চিমি পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে, প্রিগোঝিনের মৃত্যু থেকে একটা বার্তা পুতিন-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীদের কাছে পৌঁছেছে। তা হল, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে, বা অন্য কোনও বিষয়ে বেশি বিরুদ্ধাচরণ করলে কড়া শাস্তি প্রাপ্য। তবে এ-ও মনে করা হচ্ছে যে, প্রিগোঝিনের মৃত্যু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করবে না। বরং ইউক্রেনের মনোবল বাড়াবে। তবে সেটা না-ও হতে পারে। শোনা যাচ্ছে, ওয়াগনার-এর ভাড়াটে সেনাদের এখন রুশ সেনা কর্তৃপক্ষ আলাদা করে চুক্তিবদ্ধ করছে, যাতে সেই জঙ্গি নেতারা রুশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না করে। এর পরে প্রিগোঝিনের মৃত্যুতে রাশিয়া খুব বেশি বিচলিত হবে বলে মনে হচ্ছে না।

এই অবস্থায় ইউক্রেন-যুদ্ধ কোন বাঁক নেবে, তা অনিশ্চিত। বেশ কিছু দিন ধরেই পুতিন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকছেন। সেপ্টেম্বরে আসন্ন জি২০ শীর্ষ বৈঠকেও তিনি থাকবেন না। তাঁর অনুপস্থিতিই হয়তো হতে চলেছে এই বৈঠকের সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়। তবে রাশিয়ায় পুতিন জমানার দ্রুত অবসান ঘটানো যাবে, এমন কেউ মনে করছেন না।

অন্য বিষয়গুলি:

Vladimir Putin Russia Ukraine War Yevgeny Prigozhin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy