—প্রতীকী ছবি।
ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার দু’লক্ষের বেশি। ফেসবুক পেজে লাইক ৮৩ হাজারের বেশি। এই পরিসংখ্যান যে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’-এর, তাঁর পণ্যের নাম ঘৃণা। রাজনৈতিক ঘৃণা। তিনি মনু মানেসর— হরিয়ানায় সাম্প্রদায়িক হিংসার ও প্রাণহানির জেরে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে যাঁর নাম। ফেব্রুয়ারিতে গরু পাচারের অভিযোগ তুলে রাজস্থানের দুই যুবককে পুড়িয়ে মারার ঘটনাতেও প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন এই স্বঘোষিত গোরক্ষক। তার পরে পাঁচ মাস কেটেছে, তিনি গ্রেফতার হননি।
ইটকাঠের দুনিয়ায় ঘৃণার বেসাতিকেই ইন্টারনেটে পণ্য করে তুলেছেন মনু। তাঁর ইউটিউব চ্যানেল থেকে গোরক্ষার নামে হিংসাকে প্রশ্রয় দেওয়ার, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ভাষণ ছড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। স্বঘোষিত গোরক্ষকদের গরু উদ্ধার করা, জেরা করা, মারধর করার একাধিক ছবি, ভিডিয়োও ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখেছেন অনেকে। গত বছর অক্টোবরে তাঁর চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়ায়, ইউটিউবের তরফে তিনি ‘সিলভার প্লে বাটন’ স্বীকৃতিও পান।
ফেব্রুয়ারি মাসে মনু খুনে অভিযুক্ত হওয়ায় নড়াচড়া পড়ে তাঁর সমাজমাধ্যমে উপস্থিতির চরিত্র নিয়ে। তবে, ভারতে নয়, প্রশ্ন তোলে আমেরিকার এক সংবাদমাধ্যম। ইউটিউব মনুর চ্যানেলের ন’টি ভিডিয়ো মুছে দেয়। তার আগে অবশ্য ইউটিউব এবং মেটা কর্তৃপক্ষ অভিযোগ শুনেও দীর্ঘ সময় নিরুত্তর ছিলেন বলে দাবি করে ওই সংবাদমাধ্যম।
সমাজমাধ্যমে মনুর এই বিপুল সাবস্ক্রাইবার থাকার অর্থ, এক দিকে বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে নিজের মনোভাব, বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাঁর; অন্য দিকে, বহু মানুষ এই ভিডিয়োগুলি দেখেন বলে সেখান থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোটা আয়ও হয়। বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া টাকার একটা ভাগ পায় সেই সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মটি, আর একটি অংশ পান ইউটিউবার। ভেবে দেখলে, মনু মানেসর দাঁড়িয়ে আছেন একটা সন্ধিস্থলে— যার এক দিকে রয়েছে উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতি, সেই রাজনীতির প্রতি দেশের একাংশের মানুষের সুতীব্র আকর্ষণ; আর অন্য দিকে রয়েছে সেই রাজনীতির প্রশ্রয়ে সেই মানুষদের আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে চলা সুবৃহৎ বাজার।
সমাজমাধ্যমের সমস্ত সংস্থার কাছেই ভারত বিরাট বাজার। বিশ্বে ইউটিউবের সবচেয়ে বড় বাজার ভারতে। প্রায় ৪৭ কোটি মানুষ ইউটিউব দেখেন। সংখ্যাটা আমেরিকার দ্বিগুণ। তাই যখন কোনও নির্দিষ্ট ভিডিয়ো জনপ্রিয় হয়, বাজারের নিয়মেই বোঝা যায় তার চাহিদা রয়েছে। ঘৃণার চাহিদা না থাকলে মনুর ভিডিয়ো জনপ্রিয় হত না। কেবল হরিয়ানার মনু নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এমন আরও অনেকে। বিকাশ পাঠকের চ্যানেল ‘হিন্দুস্থানি ভাউ’ বন্ধ করার আগে সাবস্ক্রাইবার ছিল ৮ লক্ষ। হুমকির অভিযোগে সেই চ্যানেল বন্ধের পর পরই তিনি রাতারাতি প্রায় এক লক্ষ সাবস্ক্রাইবার জোগাড় করে নিতে পেরেছিলেন নতুন করে খোলা চ্যানেলে। এই জনপ্রিয়তার জন্যই কি সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলি ব্যবস্থা করতে চায় না? ‘বাজার’ চলে যাবে বলে?
উত্তর মেলে না। উত্তর নেই কেন্দ্রীয় সরকারি নজরদারির দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নেরও। মণিপুরে প্রকাশ্যে দুই মহিলাকে যৌন নিগ্রহের ঘটনা সামনে আসতেই কেন্দ্রীয় সরকার তড়িঘড়ি নির্দেশ দিতে পারে সমাজমাধ্যম থেকে ভিডিয়োগুলি সরিয়ে দিতে। বিরোধীরা দাবি করেন, মণিপুরে ‘কী চলছে’ তা ফাঁস হওয়া ঢাকতেই ওই তৎপরতা! সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জেরে রেল পুলিশকর্মী গুলি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠলে সেই ভিডিয়ো সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতেও অসম্ভব তৎপরতা দেখা যায়। অথচ, বছরের পর বছর ধরে বিদ্বেষ-হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ উঠলেও সেই সব ভিডিয়ো রয়ে যায়। চলতে থাকে বিদ্বেষ-অর্থনীতি।
বিপদটা তাই অক্টোপাসের মতো নানা শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরছে। এক দিকে, বিদ্বেষের ব্যবসা, বেসাতি। তারও আবার নানা ক্ষেত্র, নানা রূপ। অন্য দিকে, সরকারি তরফে সেই বিদ্বেষ ঠেকানোর বিষয়ে তৎপরতা না দেখতে পাওয়া। বরং তৎপর হওয়া সরকারের মুখ পোড়ে এমন কোনও বিষয় সমাজমাধ্যমে সামনে এলে তা চাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে।
যে সব রাজনৈতিক দল এই বিদ্বেষ ঠেকাতে চায় বলে অন্তত প্রকাশ্যে দাবি করছে, তাদের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের বিষয়, সেই ভূমিকার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনও তেমন একটা দেখা মিলছে না। একটা কথা মনে রাখা দরকার, এই সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলির প্রত্যেকেরই প্রধান দফতর বিদেশে এবং তারা ভিডিয়ো বা যে কোনও বার্তা ছড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি মানার কথা বলে। তাই নিয়ম না মানলে পদক্ষেপ তাদের করতেই হবে। কারণ, প্রথমত তারা সে দেশের আদালতের কাছে দায়বদ্ধ। দ্বিতীয়ত, তা না করলে বাজারের নিয়মেই অন্য পক্ষের বাজার হারানোর সম্ভাবনা তার রয়েছে। কোনও ব্যবসায়ীই কি চাইবেন কিছু ক্রেতাকে বাদ রেখে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে? তাই যদি সংবাদমাধ্যমে চর্চা এবং ইউটিউবের সদর দফতরে অভিযোগ হওয়ার জেরে মনু মানেসরের ইউটিউব চ্যানেল শেষ পর্যন্ত বন্ধ হতে পারে, তা হলে এই ধরনের অন্য সব অভিযোগের ক্ষেত্রেই সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
সমাজমাধ্যমে বিদ্বেষ-বার্তা দেখলেই তা নজর করা, যথাযথ জায়গায় অভিযোগ জানানো, কাজ না হলে আবার জানানো দরকার। তাতেও টনক না নড়লে বার বার জানানো চালিয়ে যাওয়া উচিত। প্রয়োজনে আদালতে যাওয়া উচিত। ঘৃণা-ভাষণের ভিডিয়োতে বিজ্ঞাপনদাতা সংস্থাগুলিকে জানানো উচিত। প্রয়োজনে দল বেঁধে কোনও ঘৃণা-ভাষণের ভিডিয়োকে, অভিযুক্ত প্রোফাইলকে রিপোর্ট করাও দরকার। ঘৃণাকে হারাতে হলে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়লে চলবে না। লড়াইটা কোনও ব্যক্তির সঙ্গে নয়। লড়াই ঘৃণার বাস্তুতন্ত্রের বিরুদ্ধে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy