আজ থেকে বহু যুগ আগে, অধিকার অর্জনের লড়াই শুরু হয়েছিল মেয়েদের। বৈষম্য ছিল বলেই আদায়ের প্রশ্ন উঠে এসেছিল। তাই, ৮ মার্চ যে তাৎপর্যপূর্ণ, এটা আমাদের বার বার বলতে হবে। এই আলো তো সরলরৈখিক ভাবে সোজাসুজি এসে পৌঁছয়নি, বেঁকেচুরে, দুমড়েমুচড়ে আসছে। এখনও, আজও। মেয়েদের জন্য, আলোকিত বৃত্ত এখনও কোথাও কোথাও গাঢ় মসিলিপ্ত। হত্যার মতো, ধর্ষণের মতো, নিগ্রহের মতো ভয়ঙ্কর সব কালো এসে ঘুরিয়ে দিচ্ছে আলোর গতিপথ।
না, নারীদিবসের গুণ-গাওয়া একঘেয়ে কাজ নয়। বার বার সংসারে, শোয়ার ঘরে, রান্নাঘরে, কলতলায়, রাস্তায়, মিছিলে, অফিসে, আদালতে এই চর্চা উঠে আসবেই। এই দিনটির কথা বলতে চেয়ে সরব হব আমরা, মেয়েরা। তুলে আনব পূর্বনারীদের ভাবনাচিন্তার ঝলক। আলো কমে আসছে। আমাদের জানালা-দরজা ফুটিয়ে তুলতে হবে না!
স্যাফোর কথা ধরি যদি, জন্মকাল ৬০০ থেকে ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনও এক সময়। হোমার তাঁকে অভিধা দিয়েছিলেন ‘নারী কবি’। তাঁর লেখাপত্র যত না আলোকিত, যে হেতু এক জন মহিলা, তাই যৌন-অবস্থান অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যে হেতু তিনি নারীকে কাছে টেনেছেন বেশি, অথচ নিজে বিবাহিতা ছিলেন, তাই তিনি সমকামী না উভকামী— এ নিয়ে আজও কথাবার্তা চলে। সৃজনশীল কাজ গৌণ হয়ে দিগন্তে মিশে যায়। কারণ, চিরকালীন মুখরোচক বিষয়— নারীর যৌনতা। নারীদের পক্ষে প্রায়ান্ধকার যুগেও নিসর্গ, কুসুমকোমল প্রেম ইত্যাদি নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক, নান্দনিক কবিতা লেখার বদলে স্যাফো লিখেছেন, নিজেকে উন্মোচনের অতি ব্যক্তিগত কথন। সাহসে ভর করে বলেছেন, “আই ডিজ়ায়ার অ্যান্ড আই ক্রেভ”, “ইউ সেট মি অন ফায়ার”! নারীলেখনীতে এ সব চিরকালীন নির্লজ্জতা। কিঞ্চিৎ শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে লেখেন যখন, “ভার্জিনিটি, ভার্জিনিটি/ হোয়্যার উইল ইউ গো, হোয়েন ইউ হ্যাভ লেফট মি/ আই শ্যাল নেভার কাম ব্যাক টু ইউ ব্রাইড/ আই শ্যাল নেভার কাম ব্যাক টু ইউ,” পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই ঔদ্ধত্য মেনে নিতে পারে কি?
এর অনেক পরে হলেও, আমরা একই সঙ্গে ঘেন্না পাব, পরম বিতৃষ্ণায় মার্গারেট অ্যাটউড দ্য হ্যান্ডমেডস টেল-এ যখন লিখবেন, “কমান্ডারদের সঙ্গে একা-একা সময় কাটানো নিষেধ আমাদের। আমরা নিচু বা অভিজাত কোনও জাতেরই বেশ্যা নই। আমরা শুধুমাত্র দু’পেয়ে এক-একটি গর্ভ। পবিত্র রক্তবাহী শিরা। বীর্যবাহিকা।”
মনে চলে আসবে কবিতা সিংহের উদ্ধৃতি, যা প্রথমে বেদনার মতো, অপমানের মতো বুকে বাজবে, তার পর বজ্র হয়ে যে কোনও সৃজনশীল নারীরই মনে জ্বলে উঠবে। “বাংলাদেশ আমাকে স্বীকার করে নেবার আগে... একবারে আমার আবেদন মঞ্জুর করেনি। বারবার অন্যায়ভাবে বাজিয়ে নিয়েছে।... অনেকের ধারণা কবিতা সিংহ ছদ্মনামে কোনো পুরুষ, কুদর্শন বা স্বামীপরিত্যক্তা, কিংবা বিধবা। কারণ তাদের চেতন বা অবচেতন মনে কাজ করে যাচ্ছে যে, এইসব গুণাবলীসম্পন্ন অসাধারণ মহিলারাই মাত্র সাহিত্যকে অবলম্বন করে থাকেন। কেউ কেউ বলেন, আমার স্বামী বিমল রায় চৌধুরী নাকি আমার সব লেখা লিখে দেন।...”
আমরা পড়ব একদম হাল আমলের সামান্য আগের মেরি বেয়ার্ডের লেখা। তিনি লিখবেন, এক জন পুরুষের প্রথম কাজই হল নারীকে ‘শাট আপ’ বলে তার চার পাশে কোলাপসিবল গেট টেনে-দেওয়া। তার কণ্ঠস্বর আমজনতার দরবারে প্রকাশ করা চলবে না। যুগ যুগ ধরে পাশ্চাত্যের সাহিত্যে, শিল্পে, যে কোনও ঘরানায় এই-ই রীতি ও রেওয়াজ। উনি যখন বলছেন, আমাদের মনে পড়ছে খনার কথা। ওঁর বচনের তীব্রতায়, সার্থকতায় পিতৃতন্ত্র অতিষ্ঠ হয়ে সহজ, নিষ্ঠুর সমাধানে উপনীত হয়। স্বামী জিব কর্তন করেছিলেন এই মহীয়সী নারীর।
মেরি বেয়ার্ড লিখছেন, যতই নারীদিবস নিয়ে হইচই করি না কেন আমরা, মেয়েদের প্রকৃত উদ্যাপনের দিন আসতে এখনও ঢের দেরি। যেমন, বাকি আছে সমান অধিকার পাওয়ার, এই হাই-টেক যুগেও। মেয়েদের চুপ করিয়ে দেওয়া, সিরিয়াসলি না-নেওয়া, এ সব লিঙ্গ রাজনীতির ষড়যন্ত্র। ক্ষমতার মূল থেকে নারীকে বিকেন্দ্রীকরণের পরোক্ষ অস্ত্র।
হোমারের ওডিসি-র কথা তুলেছেন মেরি বেয়ার্ড। ওডিসিয়সকে নিয়ে মহিমাকীর্তন হয়েছে। অথচ, তাঁর স্ত্রী পেনিলোপ, শুধু অপেক্ষার পর অপেক্ষায় থেকেছেন। অন্তরাল থেকে আলোয়, সভাকক্ষে এসে যখন নিজের চিন্তন পেশ করতে চেয়েছেন তিনি, ওঁদের সন্তান টেলিমেকাশও বাধা দিয়ে বলে উঠেছে, “মা, তুমি অন্দরে নিজের মহলে যাও। হাতের কাজ কিংবা যা কিছু মেয়েদের পক্ষে শোভন, তাই করো গিয়ে...!” টেলিমেকাশের মুখ দিয়ে হোমার বলিয়ে নিয়েছেন, শুধু তাঁরই নয়, প্রতিটি পুরুষের মনোগত বাসনাময় সেই অমোঘ উক্তি, “স্পিচ ইজ় দ্য বিজ়নেস অব ম্যান।” প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিলেমিশে এক হয়ে যায় এই বিশ্বায়নে, নারী-পুরুষের স্পষ্ট মেরুকরণে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy