Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Assembly Election 2021

এ বার তবে বন্দুকের মুখে ভোট?

হিংসা ঠেকাতে নাকি হাজার কোম্পানি পুলিশ নেমেছে বাংলায়? যত হিংসা হবে, তত কোম্পানি আসবে।

অনিতা অগ্নিহোত্রী (লেখক)
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৪
Share: Save:

আজকাল চোখে জল আসে না। ভিতর থেকে উঠে আসে অবিমিশ্র ক্রোধ। কোচবিহারের নির্বাচনযজ্ঞে নিহতদের পরিজনদের জন্য কাঁদতে গেলে জ্বালা করে ওঠে চোখ। কী হতভাগ্য আমার বাংলা! নির্বাচনে হিংসা ছিল, ছিল বুথ জ্যামিং, ছাপ্পা ভোট— আজ নয়, তিন দশক ধরেই। কিন্তু এ বারের নির্বাচনে? ১৮ বছর বয়সি তরুণ মারা গেছে ছুটে আসা গুলিতে। আর চার জন নিহত সশস্ত্র কেন্দ্রীয় পুলিশের গুলিতে। শেষ কবে কেন্দ্রীয় পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্রের প্রাণ গিয়েছিল?

হিংসা ঠেকাতে নাকি হাজার কোম্পানি পুলিশ নেমেছে বাংলায়? যত হিংসা হবে, তত কোম্পানি আসবে। নির্বাচনের অনেক আগে থেকে আমাদের শান্ত লোকালয়ে রুট-মার্চ হয় দিনদুপুরে। উৎকন্ঠিত মানুষ পালাতে পথ পায় না। কেন এই যুদ্ধের মহড়া? আমরা কী করেছি হে? এখানে সন্ত্রাসবাদীরা লুকিয়ে আছে, না পুরো বাংলা এক বোমার কারখানা ?

আমাদের চোখের সামনে বাংলার নির্বাচন পরিণত হল এক সামরিক মহড়ায়। হাজার হাজার সশস্ত্র কেন্দ্রীয় পুলিশ নামে, আকাশে ওড়ে ড্রোন, হেলিকপ্টার। ভোটারদের যে শতকরা ৯৯ জন আমোদ-আহ্লাদ করে সেজেগুজে ভোট দিতে যান, তাদের জন্য কষ্ট হয় আমার। তবু হিংসার ঘটনা ঘটতেই থাকে। আট পর্বে নির্বাচন। কার লাভ এতে? তবু আমরা কিছু করতে পারি না। চেয়ে চেয়ে দেখি। না, নির্বাচন কমিশন মৃত্যুর দায় নেবে না। চিকিৎসা না পাওয়া দরিদ্র কোভিড-আক্রান্তেরও না। তবে?

“পশ্চিমবঙ্গ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্য”: মৃণাল সেনের কলকাতা একাত্তর-এর সেই চেঁচিয়ে টেক্সটবই-পড়া বালক, শোনো, না, পশ্চিমবঙ্গ একটি ক্ষমতাহীন, বুদ্ধিহীন, হাতপা-বাঁধা উপনিবেশ। বিজিত, আক্রান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।

বাইরের রাজ্য থেকে আসা সশস্ত্র পুলিশ, স্থানীয় মাটির কোনও জ্ঞান নেই তাদের। তারা হিন্দি বলে, এক বর্ণ বোঝে না স্থানীয় ভাষা। তাদের খবরদারি দেখে নিজেদের নাবালকত্বে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছে আমাদের। ফণিমনসার মত গজিয়ে উঠেছে তারা নির্বাচন ও ভোটারের মাঝখানে। হ্যাঁ, তারা মানুষ মারতে পারে, মেরে পার পেয়ে যায়, কারণ গুলি তো নাকি সর্বদাই চলে ‘আত্মরক্ষার্থে’! তার উপর, এরা তালিম পাওয়া কেন্দ্রীয় পুলিশ। চারটে তরতাজা প্রাণ নিয়ে নিল? জখম করতে পারত, পায়ে মারতে পারত, ন্যূনতম ক্ষমতার ব্যবহার-তত্ত্ব তো তাই বলে। ‘সবক’ শেখাতে একেবারে প্রাণ নিয়ে নিল? বাংলার বাইরে রাজ্যের, কেন্দ্রের সশস্ত্র পুলিশ এক কয়েক বছর এমনই করে এসেছে। মেয়েদের উপর অত্যাচার, বিনা ওয়ার‌্যান্টে মানুষ হাপিস করা। এদের কোনও শাস্তি হয় না। কে শাস্তি দেবে, এরাই তো শাসকের ডান হাত।

হায় বাংলা, এই যারা পাছদুয়ার দিয়ে ঢুকে এল, তাদের আমরা বার করতে পারব তো? না কি নির্বাচন গণতন্ত্রের এমন এক অব্যর্থ চিহ্ন, যার জন্য সব কিছু মেনে নিতে হবে? তাই গুলি চালানোর সময় ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার ছিল কি না আমরা জানতে চাইব না, দেখতে পাব না পোস্টমর্টেমের ভিডিওগ্রাফি। নির্বাচিত সরকার নিজেই ঘটনাস্থলে যেতে পারবে না। ইভিএম নিয়ে কারও ঘরে রাখলে পোলিং অফিসার সাসপেন্ড— কিন্তু সশস্ত্র রক্ষী মানুষ মারলে কিছু হবে না। কারণ এক বার শাস্তি দিলে সে দ্বিতীয় বার মানুষ মারতে রাজি হবে না!

বাংলার দুর্ভাগ্য, আগুনকে কাদার তাল ভেবে পদসঞ্চার চলেছে। মাসের পর মাস বাংলাভাষী ভোটার শুনছে, নির্বাচনী প্রচারের নামে রাস্তার মস্তানদের নিকৃষ্ট হিন্দি, কী বুঝেছে তারাই জানে। মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর জন্য ছুঁড়ে দেওয়া কুৎসিত মন্তব্য শুনতে শুনতে হাততালি তে ফেটে পড়ছে ‘পাব্লিক’।

ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় যাদের এই রূপ, তারা চেয়ারে বসলে তো হাতে মাথা কাটবে। রাজনীতির লোকেরা অনেকেই বয়স্ক ‘সাক্ষর’। ইতিহাস পড়েননি, স্বাধীনতার ইতিহাস পড়েননি। না হলে বুঝতেন, হাতে মাথা কাটার দল বেশি দিন টেঁকেনা, তাদের ঔদ্ধত্যের গোবরের ঝুড়ি মাথায় চাপিয়ে, সদর দরজা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়।

কিন্তু কী করে অস্বীকার করি, আজকের পরিণতি আমাদেরই ধারাবাহিক নির্মাণ! তিন দশক হল কোনও শাসক দলই ক্ষমতা-দখল ছাড়া নির্বাচনের মধ্যে আর কিছু দেখে না। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ৪০ শতাংশ আসন জেতা হয়ে যায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। নিজেদের রক্ত আমরা কিছু কম ঝরাইনি এত বছরে। ক্ষমতাসীনের জন্য নির্বাচন আজ এক মরণ-পণ খেলা। কারণ ক্ষমতাই টাকা আর জনগণ, শাসক জানে, ভর্তুকিতেই বশ। কবে থেকে যেন নির্বাচন হয়ে উঠেছে আমাদের একমাত্র অর্থনীতি, সত্তরের মুখে ছাই দিয়ে পুলিশ হয়ে উঠেছে ‘আমার পুলিশ।’ তাই অন্ধকার খাটের তলা থেকে বেরিয়ে ক্ষমতার স্বাদ নিতে যাঁরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছেন, তাঁরা কেউ পাবেন পুরস্কার, জিন্দগি বন যায়েগি, কেউ বাঁচাবেন গ্রেফতারি, কিন্তু ভুলুন্ঠিত করে যাবেন বাংলার চেতনার ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য।

বাঙালির ভারতীয়ত্ব সন্দেহাতীত নয়; তার আন্তর্জাতিকতা মেকি। এই বাহানায় হিন্দির দাদাগিরি দিয়ে বাঙালিত্বকে কেটেকুটে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা চলেছে। টাকার খেলায় হীন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলেছে আমাদের মেধাকে। এই চেষ্টায় এবার শামিল হল বহিরাগত সশস্ত্র বাহিনীও। ক্ষমতার কালো চশমা পরে নিহতের পতাকার রং খোঁজার দীর্ঘ দিনের কারিগরি বাংলাকে বানিয়ে তুলেছে এক সুস্বাদু শিকার! তার জন্য বুঝি বন্দুকের নলের নীচে নির্বাচনের ব্যবস্থাই উপযুক্ত ‘দাওয়াই’?

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Assembly Election 2021 CRPF Jawan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy