উত্তর-পূর্বে বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্কট। ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সাল থেকে পিছিয়ে ১৯৫১ সালে নিয়ে যাওয়ার দাবি উঠেছে অসমে, উচ্চতম ন্যায়ালয়ে মামলাটির নতুন করে শুনানি শুরু হয়েছে। সম্প্রতি, দু’হাজার বিদেশিকে বন্দি রাখার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন দেশের সর্ববৃহৎ ট্রানজ়িট ক্যাম্পটি চালু হয়েছে অসমের গোয়ালপাড়ার মাটিয়া অঞ্চলে, যেখানে দেশভাগের পর স্বল্প সময়ে দু’শতাধিক বাংলা মাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি এক ফরমান জারি করে বলা হয়েছে যে, অসমে জমি কিনতে হলে ১৯৬৫ সালের আগে অসমে বসবাস করার প্রমাণ দেখাতে হবে। অসমের বাইরে উত্তর-পূর্বের জনজাতি-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাকি রাজ্যগুলোতে বাঙালিদের অবস্থান এর থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। তার মধ্যেও একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে চলেছে উত্তর-পূর্বের বাঙালি সমাজ— প্রান্তিকায়নের বিপত্তিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থেকেও।
উত্তর-পূর্বে বাঙালির কেন এই অস্তিত্বের সঙ্কট? এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপট থেকে বাঙালির স্থিতি পর্যালোচনা করতে গেলে বলতে হয়, বাঙালি তার ভাষাগত পরিচয়কে সম্বল করে একটা ঐক্যের বলয় অক্ষত রাখতে তৎপর হয়নি কখনও। স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙালি দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ভাষাগোষ্ঠী। কিন্তু বাংলা দেশের বাইশটি সরকারি ভাষার একটি, এইমাত্র। বাংলাকে দ্বিতীয় প্রধান রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবি পঁচাত্তর বছরে শোনা যায়নি! সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে অন্তর্লীন বিভাজন। এর থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে বাঙালির উপর। উত্তর-পূর্ব ভারতে যেন সেটা বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান।
উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি ছড়িয়ে রয়েছে। যদিও ত্রিপুরাকে বাদ দিলে উত্তর-পূর্বের বাকি রাজ্যে বাঙালি সংখ্যালঘু, কিন্তু সেখানেও অর্থনীতির বনিয়াদ রক্ষা করে যাচ্ছে বাঙালিরাই। দুর্ভাগ্য, এই রাজ্যগুলোতে এখন বাঙালির শিকড় নড়বড়ে, বরং পিঠে লাগছে ‘ঘুসপেটিয়া’ পরিচয়। এখানে তারা প্রান্তিকায়িত, তাদের এই সামাজিক পরিচয়-সঙ্কোচনের মূল কারণ অবশ্যই তাদের ভাষা। ত্রিপুরা বা অসম বাদ দিলে বাকি পাঁচটি রাজ্যে বাঙালি জনসংখ্যা ১০ শতাংশের কম (ত্রিপুরাতে ৬৫ শতাংশ, অসমে ২৯ শতাংশ)। বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা বা চর্চার অবকাশ বা পরিসর দুই-ই সেখানে অনুপস্থিত।
অসমেও বাঙালির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান খুব উজ্জ্বল নয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে কেটে এনে নবগঠিত অসম প্রভিন্সের সঙ্গে সিলেটের সংযুক্তি (১৮৭৪), তার পর দেশভাগ এবং সিলেট বিভাজন (১৯৪৭), রাজ্য ভাষা আইন প্রণয়ন (১৯৬০), বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন অতঃপর রাজ্য ভাষা আইন সংশোধন (১৯৬১), নাগরিকপঞ্জি নবায়ন (২০১৫-২০১৯), অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা রূপায়ণের দাবি (২০২০), রাজ্য ভূমি আইনের সংস্কার— সব মিলিয়ে অসমে বাঙালির পরিস্থিতি এখন দুর্বল। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। স্বাধীনতার পর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলো পুনর্গঠিত হলেও ১৯৫৬ সালের রাজ্য পুনর্গঠন আয়োগের প্রতিবেদন অনুসারে অসম একটি বহুভাষিক রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ২০১১ সালের জনগণনা বলছে, বরাক উপত্যকা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, এই দুই ভূখণ্ড মিলিয়ে অসমে বাঙালি জনসংখ্যা নব্বই লক্ষ। তবে, এই দুই উপত্যকার বাঙালির চাল-চরিত্রে খানিকটা ফারাকও রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় বিভাজনের শিকার, বরাক উপত্যকার বাঙালির মধ্যে তা তত প্রকট নয়। বরাকে বসবাসকারীদের আশি শতাংশ বাঙালি এবং তাঁদের সিংহভাগই এক অখণ্ড জাতিসত্তায় বিশ্বাসী, এখনও পর্যন্ত। স্বস্তির পাশাপাশি বিড়ম্বনাও কম নয়। এই অঞ্চলের ভূগোল বা সামাজিক বুনোটকে তোয়াক্কা না করে, কালস্রোতে বারংবার এই অঞ্চলের মানচিত্রে যে যথেচ্ছ দাগ টানা হয়েছে, কালি মাখা হয়েছে, তার ক্ষত এখনও প্রশমিত হয়নি।
ব্রিটিশ আমলে যা ছিল সুরমা ভ্যালি ডিভিশন, দেশভাগের পর সিলেটের কাটা অংশ নিয়ে সেটি হয় কাছাড় জেলা। পরে তিনটি জেলায় বিভক্ত হয়ে বরাক উপত্যকা নামে এক স্বকীয় অভিধা পায়। বিভিন্ন সময়ে ক্ষতবিক্ষত ভূভাগটি এতে কিছু স্থায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, উপত্যকার রাজনৈতিক ইতিহাস তার প্রাকৃতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক দিকগুলোকে পুষ্টি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
উত্তর-পূর্বের বাঙালিদের মূল গড় যে বরাক উপত্যকা, সেখানেই যখন বাঙালির অস্তিত্ব সঙ্কটে, এর থেকে পুরো উত্তর-পূর্বের বাঙালির হালহকিকত সহজেই অনুমেয়। বরাক উপত্যকার বাইরে বাঙালি সংখ্যালঘু, যার মধ্যে আবার ধর্মগত বিভাজন প্রকট।
এই বহুমাত্রিক দোলাচলেও উত্তর-পূর্বের বাঙালি তার স্বভাবসুলভ উদার বহুত্ববাদে আস্থা রেখে ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করে যাচ্ছে। বহুবিধ আগ্রাসনে বিধ্বস্ত হলেও বিছিন্নতাকামী শক্তির সঙ্গে হাত মেলায়নি। কিন্তু টিকে থাকতে হলে নিজের অখণ্ড জাতিসত্তায় অবিচল থেকে নতুন করে নিজের পরিচয় গঠন করা জরুরি। যে বাঙালি ১৯৫২ সালের গৌরবগাথা রচনা করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করেছে, যে বাঙালি অসমের মাটিতে নিজের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় বারংবার আত্মাহুতি দিয়েছে, সে যে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সেটা নিশ্চিত। কেবল বিভাজনের কূটচালকে প্রতিহত করে সম্মিলিত ভাবে বলতে হবে ‘আমরা আছি’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy