সমরেশ মজুমদার। ফাইল চিত্র।
অদূরে তিস্তার গায়ের গন্ধ। কাছেই আংরাভাসা নদী। গয়েরকাটার নিঝুম চা-বাগানে সমরেশ মজুমদারের শৈশব কাটে। নদীর জলে কান পেতে শুনেছেন নুড়ির সঙ্গে নুড়ির ঠোকাঠুকির শব্দ। বয়স বছর তিনেক হতেই ভর্তি করা হল ভবানী মাস্টারের পাঠশালায়। সেখানে সমরেশের হয়ে পরীক্ষায় লিখে দিলেন বয়সে বড় এক দিদি। ধরা পড়ল শিশু সমরেশ। ভবানী মাস্টার উপদেশ দিলেন, ‘তোমার তো অনেক দূর যাওয়ার কথা। আর কাউকে অ্যালাও করবা না।’
কৃষ্ণদাস মজুমদার, শ্যামলী দেবীর সন্তান সমরেশ মাস্টারমশাইয়ের এই নির্দেশটিই তাঁর সৃষ্টির ক্ষেত্রে জীবনভর অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছেন। আর তা করেছেন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিকে দেখার পাকদণ্ডী বেয়ে।
সমরেশের জন্মের কালে বাতাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পোড়া গন্ধ। দেশে উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলন। এমন একটি সময়ে বড় হওয়া, উত্তরবঙ্গকে দেখা, জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, কলকাতায় আসা, স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা— সামগ্রিক ভাবে সমরেশের মনন ও কথন-বিশ্বটি তৈরি করেছে। আর এই বিশ্বের ভৌগোলিক সীমা মূলত উত্তরবঙ্গ ও কলকাতা। তবে কালবেলা-য় বীরভূম, ঠিকানা ভারতবর্ষ-এ পুরুলিয়া, দক্ষিণবঙ্গের অনুষঙ্গও এসেছে নিজের মতো করে।
বস্তুত, ভৌগোলিক সীমা নয়, বরং সমরেশের কথার কারখানার মূল উপাদান মানুষ। আর সেই মানুষকে দেখার ক্ষেত্রে নির্মম ও নির্মোহ ভাবে সাহিত্যিকের অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া আর কিছু ‘অ্যালাও’ করেননি। তা সে উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ এবং মৌষলকাল-এর চতুর্ভুজ হোক বা সাতকাহন-এর নারী-কথা হোক।
এই কথা ও দেখার শুরুটা দেশ পত্রিকায়। ১৯৬৭ থেকে সমরেশের দেশ-সংযোগ। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় সমরেশ পড়েছিলেন, ‘শুরু করা উচিত চূড়া থেকে।’ তা, পত্রিকার বিমল কর জানালেন, সমরেশের গল্প মনোনীত হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সেটি অমনোনীত বলে ফেরত চলে গেল। মাঝে বিমল করকে ফোন করে বেশ কড়া ভাষায় কথা বললেন সমরেশ। বিমল জানালেন, ওটা পিয়নের ভুল ছিল। ছাপাখানায় যাওয়ার বদলে ফেরত চলে গিয়েছে! শেষে ছাপা হল গল্পটি। এর পর থেকে আট বছরে প্রায় চব্বিশটা ছোটগল্প বেরোয় দেশ-এ।
তবে এই দেশ-এর লেখা নিয়ে এক বার বেশ বিড়ম্বনাতেও পড়েছিলেন সমরেশ। আনন্দবাজার পত্রিকার কিংবদন্তি সাংবাদিক ও অ্যাসোসিয়েট এডিটর রমাপদ চৌধুরী সম্পাদনা করেছেন ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগটি ও পত্রিকার পুজো সংখ্যা। তা এক দিন রমাপদের কাছে গেলেন সমরেশ। বললেন, ‘দেশ-এ লিখি। একটা গল্প নিয়ে এসেছি।’ রমাপদের জবাব, ‘গল্পটা দেশ পত্রিকাতেই নিয়ে চলে যান!’ অবশ্য এই রমাপদই এক দিন হঠাৎ বললেন, ‘একটা লেখা দেবেন তো!’ সঙ্গে সংযোজন: ‘বিকেলে মুড়ি খেয়ে যাবেন!’ পাশাপাশি, সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে দেশ-এই প্রকাশ প্রথম উপন্যাস দৌড়-এর।
এই সান্নিধ্যগুলি কী ভাবে সমরেশের অন্তর্দৃষ্টিকে তৈরি করেছিল, তা বোঝা যায় উত্তরাধিকার লেখার প্রেক্ষাপটটি থেকে। সাগরময় চেয়েছেন ধারাবাহিক উপন্যাস। সঙ্গে পরামর্শ দিলেন, ‘নিজেকে নিয়ে লেখো। তোমার জীবনী নিয়ে ইন্টারেস্টেড নই, জীবনে যাঁদের দেখেছ, তাঁদের নিয়ে গপ্পোতৈরি করো।’
এই পরামর্শটা বোধহয় মাথায় রেখেছিলেন সমরেশ। আর তাই তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস-চতুষ্ক, গর্ভধারিণীতে বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে দেখেন নিজস্ব আঙ্গিকে। আবার নারীকেও ভাবেন, দেখেন নিজের মতো করে। তাই মাধবীলতাকে ৪২ বছর ধরে ভাবিয়েছিল দু’টি অপমান। একটি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় অত্যাচার। আর অন্যটি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে অনিমেষের দেওয়া বিবাহ-প্রস্তাব। আবার সাতকাহন-এ চা-বাগানে বড় হওয়া দীপাবলির ব্যক্তিজীবনের লড়াই ও আত্মপ্রতিষ্ঠা আমাদের সমাজের বহু নারীর কথা মূর্ত করে। শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজটাকেও নারী কী ভাবে বদলাতে চায়, তার প্রমাণ ঠিকানা ভারতবর্ষ। সেই সঙ্গে নির্মোহ ভাবে দেশের অর্থনীতির ফোঁপরা অবস্থাটাকে দেখতে ও দেখাতে পারেন দৌড়-এর বিকাশ চরিত্রটির মধ্যে। মৌষলকাল-এ দেখেন চারপাশে মূল্যবৃদ্ধি, জনতার দীর্ঘশ্বাস।
এই ভাবনা ও চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার অবলম্বন— ভাষা। চারপাশটাকে সমরেশ যে খুব ভাল চেনেন, তা বোঝা যায় তাঁর ভাষা ব্যবহারেও। কালপুরুষ-এর ঈশ্বরপুকুর লেনে বস্তিবাসী ছেলেদের সংলাপগুলি এর প্রমাণ। আবার উল্টো দিকে, কিশোর মনের জন্য তৈরি করেন‘অর্জুন’-গোয়েন্দার গল্প।
তবে শুধু গল্প, উপন্যাসই নয়, প্রবন্ধ, সমালোচনাতেও সমরেশের কলম মনস্বী। এখানেও তিনি স্বাধীন একটি দেখার চোখের অধিকারী। তাই শেষ বয়সের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে পারেন, ‘এখন ওঁর উচিত গান না গেয়ে সুর দিয়ে যাওয়া।’
বহুল সংখ্যক সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতিও এসেছে নিজের নিয়মেই— আনন্দ পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি-সহ আরও নানা কিছুই। তবে শেষ পর্যন্ত সমরেশ একটি যাত্রাপথের পর্যটক। যিনি দিয়ে যান আগামীর জন্য পরামর্শও: ‘জন্ম থেকেই দৌড়ে যাচ্ছি আমরা। প্রত্যেকেই একটা লক্ষ্যের দিকে ছুটছি। একটু অসতর্ক হলেই হেরে যেতে হবে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy