গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটির পর, সমে ফিরতে না ফিরতেই, স্কুল আবার বন্ধ! —ফাইল চিত্র।
বর্ষার জল পেয়ে স্কুলের মাঠটি আরও সবুজ হয়ে উঠেছিল। এত সুন্দর লাগছিল যে বলবার নয়। সারা বছর মাঠের নানা পরিবর্তিত রূপ দেখি আর বিস্মিত হই। এ দিকে পঞ্চায়েত ভোটের দিন এগিয়ে আসতেই মাঠের সবুজ ঢেকে গেল বাঁশ আর কাপড়ের অস্থায়ী ছাউনিতে। ফেলা হল বেশ কয়েক গাড়ি মাটি। ক্লাসরুম-সহ হেডমাস্টার চেম্বার, স্টাফরুম সবই চলে গেল নির্বাচন কমিশনের দখলে!
স্কুল এই বারও পঞ্চায়েত ভোটের জন্য একটি ব্লকের ডিস্ট্রিবিউশন ও রিটার্নিং ও কাউন্টিং সেন্টার হিসাবে অধিগৃহীত। ফলে গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটির পর, সমে ফিরতে না ফিরতেই, স্কুল আবার বন্ধ! ভোট গণনার এক দিন পর খুললেও, স্কুলের যে দশা থাকবে তাতে অন্তত আরও দু’-তিন দিন লেগে যাবে সাফাইয়ের কাজে।
প্রায় ফি বছর বাৎসরিক উৎসবের মতো, নির্বাচনের কাজে লাগানো একটি স্কুলের কী হাল হয়, সেটি একমাত্র সেই স্কুলের সঙ্গে জড়িতরা জানেন! নারকীয় সেই অবস্থায় কোনও সচেতন অভিভাবকই তাঁর সন্তানকে পাঠাতে চাইবেন না। এমনিতেই সরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো যথেষ্ট খারাপ। তার উপর নির্বাচনের পরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজপত্র, চায়ের কাপ, পান ও গুটখার পিক, ঘিনঘিনে শৌচাগার ইত্যাদি দেখলে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে।
শুধু পঞ্চায়েতের জন্য নয়, যে কোনও নির্বাচনের ক্ষেত্রেই রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ইলেকশন কমিশনের দখলে চলে যায়। কোনও কোনও স্কুল ভোট কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কোথাও কোথাও নিরাপত্তা রক্ষীদের থাকার ব্যবস্থা হয়। তৈরি হয় ব্যালট রাখার স্ট্রং রুম, চলে ভোটের ট্রেনিং ক্লাস। ফলে বন্ধ রাখতে হয় সেই সব স্কুল ও কলেজ। লক্ষণীয়, যে স্কুল-কলেজ এ সবের জন্য নেওয়া হয় না, সেগুলিতেও কিন্তু পড়াশোনা ব্যাহত হয়। কেননা, প্রায় প্রত্যেক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীই তো ভোটকর্মী। ফলে ক্লাস নেবেন কে!
যেমন, সে দিন ভোটের ট্রেনিং-এর শেষে এক সঙ্গে ফেরার পথে সহযাত্রী প্রাথমিক শিক্ষক জানালেন, তাঁদের স্কুলে মাত্র তিন জন শিক্ষক। প্রত্যেকের ডিউটি এসেছে। ট্রেনিং ক্লাসে আসবার জন্য স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে তাই। কিন্তু এলাকার লোক তো সেটা বুঝবেন না। তাঁর আশঙ্কা, পর দিন ঝামেলা পোহাতে হবে।
কেন যে একটি গোটা স্কুলে মাত্র তিন জন শিক্ষক, সেটা একটা ভাবার বিষয়। সেটা কেউ ভাবছেন কি না জানি না। তবে প্রশ্ন হল, সব শিক্ষককেই যদি এই ভাবে ভোটের কাজে এতটা সময় নিজেদের কাজ থেকে সরে আসতে হয়, তা হলে ‘শিক্ষা’র ক্ষতি হয়, এটাও কি কেউ ভাবেন না? মাঝে মাঝে ভাবি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কি স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে ভোটপর্ব চলে? বহু দেশে তো শুনি রাস্তার মধ্যেই নাকি ভোট যন্ত্র রেখে দেওয়া হয়। অফিস যাত্রী ভোটদাতারা নিজেদের মতো ভোট দিয়ে যান! সে সব রাষ্ট্রে গণতন্ত্র কম বলে তো কিছু শুনিনি। শিক্ষা সেখানে এতটা গুরুত্ব পায় যে, কোনও নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা থাকে না স্কুল-কলেজ নিয়ে ছেলেখেলা করবার।
অন্য দিকে, আমাদের রাজ্য তথা দেশে যে কোনও বিষয়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা রীতিমতো একটা রেওয়াজ। কিছু হলেই সবার আগে কোপ পড়ে স্কুল-কলেজগুলির উপর। আর নির্বাচন এলে তো কথাই নেই! দিনের পর দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে গণতন্ত্র রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। চুলোয় ওঠে লেখাপড়া।
প্রশ্ন হল, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারের উপর এই অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ আদৌ কি সমর্থনযোগ্য? রাষ্ট্র অবৈতনিক শিক্ষা প্রদান করছে বলেই যখন ইচ্ছে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিতে পারে?
এই বিষয় নিয়ে কিন্তু ভাবার সময় হয়েছে। এমনিতেই সরকারি স্কুল-কলেজে করোনা অতিমারির পর ড্রপ-আউটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা বহু বিষয়ে পিছিয়ে পড়েছে। অনেক পাঠ তারা আত্মস্থ করতে পারছে না। এই মুহূর্তে তাদের আরও যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। দরকার নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পঠনপাঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা। কিন্তু সেটি আর হচ্ছে কোথায়!
গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি সাধারণ ঘটনা। প্রক্রিয়াটি চলবেই। কিন্তু তার জন্য কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করা? বিকল্প কিছু কি ভাবা যায় না? তৈরি করা যায় না পৃথক ভোটগ্রহণ ও গণনাকেন্দ্র? বিভিন্ন ক্ষেত্রে তো অনর্থক প্রচুর ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ না করে, ভোটগ্রহণ ও গণনার পৃথক ব্যবস্থা করার কথা আমরা কি এক বার ভাবতে পারি না? ছাপা ব্যালটের জায়গায় ইভিএম যদি আসতে পারে, তবে ভোটকেন্দ্র বা ডিসিআরসি হিসাবে অন্য কোনও জায়গা অবশ্যই ব্যবহৃত হতে পারে। পূর্ণ নিরাপত্তা-সহ ভোটগ্রহণের অস্থায়ী কেন্দ্রও তো তৈরি করা যেতে পারে!
বছরের পর বছর ধরে, একই পদ্ধতিতে, ভোটগ্রহণের জন্য স্কুল-কলেজকে কিছু দিনের জন্য অধিগ্রহণ করার বিষয়টি কিন্তু আমাদের ভাবনার দৈন্যেরই পরিচয়। বিভিন্ন বিষয়ে আমরা পরিবর্তনের ডাক দিই। এই ব্যাপারেও সেটা করলে বোধ হয় একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারব। তাতে হয়তো খুনোখুনি মারামারি করা আমাদের এই কুৎসিত চেহারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে খানিকটা হলেও বদলাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy