Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ভোটের মুখে সিএএ করে বিজেপি কি প্যাঁচে পড়ল
Citizen Amendment Act

‘ভয়’ বনাম ‘অভয়’

বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ কেন সর্বার্থে শক্তপোক্ত জোট হয়ে উঠতে পারল না, সেই আলোচনার সময় আজ বোধ হয় পেরিয়ে গিয়েছে।

CAA

— ফাইল চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ ০৮:১৮
Share: Save:

ভোট-প্রবণতার বিভিন্ন জনসমীক্ষা অনুযায়ী দেশের শাসনক্ষমতায় কোনও বদলের আভাস নেই। অর্থাৎ, বিজেপির ফিরে আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। পাশাপাশি আরও একটি ইঙ্গিত মিলছে। তা হল, বাংলায় লড়াই কার্যত সরাসরি— মোদী বনাম মমতা।

সমীক্ষার ফলাফলে অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাটুকু মেনে নিয়ে এটাই আপাতত বাস্তব পরিস্থিতি। এনডিএ চারশো আসন ছুঁতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সমীক্ষকদের অবশ্য নানা মত রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সেটা তত গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য নয়।

বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ কেন সর্বার্থে শক্তপোক্ত জোট হয়ে উঠতে পারল না, সেই আলোচনার সময় আজ বোধ হয় পেরিয়ে গিয়েছে। ভোট-পরবর্তী কালে তা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে কি না, হলে কী কী হতে পারে সে সব পরের কথা। তবে একটি ব্যাপার এড়ালে চলবে না— বিরোধীপক্ষের ‘মুখ’ হিসাবে দেশের কোনও নেতা অন্তত জনসমীক্ষায় পছন্দের পাল্লা ভারী করতে পারলেন না। এটা ভেবে দেখার।

পশ্চিমবঙ্গে যে জোট হচ্ছে না, সেই আভাস গোড়া থেকেই মিলছিল। সবাই জানেন, কংগ্রেস হাই কম্যান্ড যা-ই ভেবে থাকুন, রাজ্যের কংগ্রেস কখনও তৃণমূলের সঙ্গে জোট চায়নি। সিপিএমের সঙ্গই তারা ধরে রাখতে চেয়েছে। অন্য দিকে, তৃণমূল নেতৃত্বও আসন রফা নিয়ে কোনও ‘সম্মানজনক’ শর্ত দেয়নি কংগ্রেসকে। সিপিএমের সঙ্গে জোটে থাকা তো বহু দূরের কথা। ফলে এই রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’র পঞ্চত্বপ্রাপ্তি সম্পর্কে সংশয়ের কিছু ছিল না।

প্রসঙ্গত স্মরণে থাক, দেশে ভোট ঘোষণার দিন পার করেও বাংলায় কোনও প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেনি কংগ্রেস। তাদের জন্য অপেক্ষারত সিপিএম অগত্যা আগেই কিছু কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা করে দেয়! আর তখন পর্যন্ত বিজেপিও বাংলায় প্রথম দফার তালিকা প্রকাশ করেছে।

‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম উদ্যোগী হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আপন দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে একা লড়তে চেয়েছিলেন। আঞ্চলিক দলের মর্যাদা ও ‘উত্থান’-এর বিষয়ে তিনি যে সর্বদা সরব, সেটাও জানা। তিনি বলেই থাকেন, এখানে বিজেপির মোকাবিলায় তৃণমূল একা যথেষ্ট। এ বার সাম্প্রতিক জনসমীক্ষাগুলির পূর্বাভাস যদি প্রকৃত ফলের সঙ্গে মিলে যায়, তা হলে বুঝে নিতে হবে, এই রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী শক্তি হিসাবে কংগ্রেস, সিপিএম কেউই ভোটে জেতার মতো মান্যতা পাচ্ছে না এবং এই ব্যাপারে মমতার মূল্যায়নে খুব একটা ভুল নেই।

এ কথা সত্যি যে, আসনসংখ্যার বাইরেও কোন দল কত শতাংশ ভোট পেল, তার একটি পৃথক মাহাত্ম্য আছে। ভোটের বিশ্লেষণেও সেগুলি অপরিহার্য তথ্য। তবে নির্বাচনে জনসমর্থনের প্রকৃত বিচার হয় আসন সংখ্যায়। যেখানে ৪৯ এবং ৫১-এর ফারাকটাই শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়। তাই আসন পাওয়া, না-পাওয়া হল ভোটের কার্যকর অঙ্গ। বাকিটা তত্ত্ব।

এখন লড়াই প্রধানত দ্বিমুখী হয়ে গেলে ভোট ভাগের হিসাবও অন্য রকম হতে বাধ্য। কারণ তখন তৃতীয় পক্ষের ভোট কাটার, সোজা কথায় ‘নষ্ট’ করার, পরিসর সাধারণত কিছুটা ছোট হয়ে আসে। ভোটারদের সিংহভাগ এ-পক্ষে বা ও-পক্ষে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। শুভবুদ্ধি যতই পিছু টানুক, সাম্প্রতিক কালে রাজনীতির নামে ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক বা অন্যতর জাতপাতভিত্তিক মেরুকরণের ভোট তারই এক অনিবার্য পরিণতি।

এই পরিস্থিতিতে প্রচার থেকে প্ররোচনা, ভোট ‘করার’ হিসাবনিকাশ সবই সেই একটি বৃত্তে ঘুরপাক খায়। কে কোন সম্প্রদায়-জাত-গোষ্ঠীর কত পরিমাণ ভোট ‘নিশ্চিত’ করতে পারছে, সেটাই হয়ে ওঠে জেতা-হারার অন্যতম নিয়ামক। ধারণা, রাজ্যে এ বার তেমনটাই হতে চলেছে। যেখানে উভয় তরফেই পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভাজনের তিরে আক্রমণ শাণানোর মতো পরিসর প্রসারিত।

বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দল। হিন্দু-ভোট তাদের মাছের চোখ! দেশ জুড়ে তাদের অগ্রগতির পিছনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভূমিকা আছে বলেই অযোধ্যার রামমন্দির এই নির্বাচনে তাদের অন্যতম ধারালো হাতিয়ার। বস্তুত অযোধ্যায় মন্দির প্রতিষ্ঠা শুধু নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতি পালনই নয়, বহুলাংশের কাছে এ হল ভোট মেশিনে বোতাম টেপার নির্ণায়ক। এর মধ্যে লুকোচাপা কিছু নেই।

আবার ধর্মীয় মৌলবাদকে রাজনীতির মূলস্রোতে মিশিয়ে দেওয়ার কাজটি ‘সুচারু ভাবে’ সম্পন্ন হচ্ছে বলেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এখন ধর্মভিত্তিক নিপীড়ন ও অসহিষ্ণুতার মাত্রা বেড়েছে। প্রতিবাদ বা প্রতিবিধানের হার কমেছে! কে কী খাবেন, কী পরবেন থেকে শুরু করে স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার হরণ পর্যন্ত সব কিছু কতখানি বেপরোয়া জায়গায় পৌঁছেছে, ক’দিন আগে গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে নমাজ পড়তে যাওয়া বিদেশি পড়ুয়াদের উপর হামলা তার হাতেগরম এবং আতঙ্কজনক একটি উদাহরণ।

অপর দিকে, এই রাজ্যে সামাজিক শৃঙ্খলাভঙ্গ, অন্যায়-অপরাধ, দুষ্কর্ম, দুর্নীতির যত ঘটনা ঘটে তার একটি বড় অংশের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়ে যায় একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের নাম। সমাজবিরোধীদের এ ভাবে জাত-পরিচয়ে দাগিয়ে দেওয়া অবশ্যই অনুচিত। কিন্তু সেই যুক্তিতে চোখ চাপা দিয়ে নির্মম কিছু সত্যকেও তো আড়াল করা যাবে না। ঘটনা যা, তা তো ঘটনাই।

বেশি দূরের কথা থাক। হাতের কাছে এখনই বা কী ঘটছে? সমাজ যখন দেখে, আদালত হস্তক্ষেপ না-করলে শাহজাহানদের কোমরে দড়ি পরানো হয় না, বা কলকাতা শহরে বেআইনি বাড়ি ভেঙে কতকগুলি প্রাণ চলে গেলেও স্থানীয় কাউন্সিলর ‘অপাপবিদ্ধ’ থেকে যেতে পারেন, তখন কিছু প্রশ্ন কি উঠতে পারে না? এই রকম দৃষ্টান্তও তো নেহাত কম নেই। খুঁজলে অনেক।

তবে কিনা, এই সব এখন এক প্রকার গা-সওয়া। এতটাই যে, দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে আলাদা করে ভোটারদের চেতনায় বিষয়গুলি কোনও বাড়তি মাত্রা যোগ করে বলে মনে হয় না। বিজেপি হিন্দু-ভোটে ঝাঁপায় এবং তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোট যত দূর সম্ভব আঁকড়ে ধরতে চায়, এর কোনওটিই চেনা ছকের বাইরে নয়।

কিন্তু সিএএ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে এই রাজ্যে ভোটের আবহে সহসা বড়সড় পরিবর্তন সূচিত হল। অনেকেরই ধারণা, বিষয়টি শুধু সাম্প্রদায়িক বিভাজন অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম ভোট ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পরে এনআরসি-র সম্ভাবনা নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে ‘সব হারানো’র ভয় দানা বাঁধছে। এবং এঁদের সকলেই সংখ্যালঘু নন। সেখানে অমিত শাহের সরকারি ‘অভয়’ দান তাঁদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য, না কি মমতার ‘ভয়’-এর যুক্তি ও প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ, ভোট-মেশিন সেই ‘পরীক্ষা’র আসন্ন ক্ষেত্র।

বস্তুত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ ২০১৯ সালেই ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’ বলে রেখেছিলেন। জানিয়েছিলেন, প্রথমে সিএএ হবে। তার পরে আসবে এনআরসি। ফলে প্রথম পর্ব করে ফেলার পরে আজ বা কাল নাগরিকত্ব প্রমাণের জায়গাটিও যে খুলে যাচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভুললে চলবে না, বিজেপি-শাসিত অসমে নাগরিকত্ব ‘প্রমাণ’ করতে না-পেরে শিবির-বন্দি যে কয়েক লক্ষ মানুষ, তাঁদের সিংহভাগই বাঙালি হিন্দু। তাই সাধারণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হলে তাকে অমূলক বলে ওড়ানো কঠিন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে বলছেন, সিএএ মমতার কাছে একপ্রকার ‘শাপে বর’! কারণ, তৃণমূল এটি প্রচারে ‘বড়’ করতে পারলে রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার (অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি) অন্য বিষয়গুলি ক্রমে পিছনে চলে যেতে পারে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু-সহ অ-বিজেপি ভোটের ভাগাভাগিতেও তাদের বাড়তি সুবিধা জুটতে পারে।

রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে ভোট-প্রার্থী তৃণমূলকে মূলত ‘রক্ষণাত্মক’ প্রচারে যেতে হত। এখন সিএএ আসার পরে এই রাজ্যে বিজেপি যদি খানিকটা ‘রক্ষণাত্মক’ অবস্থান নেয়, তাতে হয়তো বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Citizen Amendment Act BJP CAA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy