—প্রতীকী চিত্র।
চার পাশে বড় কথা। মেট্রোয়, বাসে, রাস্তায়। মেট্রোয় উঠেই ‘গুড মর্নিং স্যর বা ম্যাম’, দফতরের কূটকচালি ছাড়াও, ‘জানিস কী হয়েছে?’-তে কান যায়। ফোনে বন্ধুকে ‘গোপন’ কথা বলছে মেয়েটি, কিন্তু সে একেবারে হাটখোলা গোপন! বলার সময় তার মুখ এমন চলচ্ছবি হয়ে উঠছিল যে মেট্রোসুদ্ধ লোকে দেখছিল। মনে পড়ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অরন্ধনের নিমন্ত্রণ’-এর কুমীকে, যার কথায় কথায় খিলখিল হাসি, মুখে বকুনির খই।
“মেয়েটি হাত-পা নেড়ে একটা গল্প জুড়ে দিলে— নাপিত-বাড়িতে ছাগল ঢুকে, নাপিত-বউ যে কাঁথা পেতেছিল, সে কাঁথা চিবিয়ে খেয়েছে... কী সে বলবার ভঙ্গি,.. কৌতুকপূর্ণ কলহাসির উচ্ছ্বাস... হাত-পা নাড়ার ভঙ্গি...” হীরেন মুগ্ধ, বিস্মিত, পুলকিত এইটুকু মেয়ের ক্ষমতায়।
মেয়েদের বদনামের একটি— মেয়েরা বড় বেশি কথা বলে। লেডিজ় কামরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক পুরুষ বলেন, ‘মাছের বাজার!’ সত্যিই কি তাই? মেয়েরা বেশি বকে? বেশির ভাগটাই বাজে, তুচ্ছ কথা? মেয়েরা এমন কথায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন— ‘ওলো সই, ওলো সই,/ আমার ইচ্ছা করে তোদের মতন মনের কথা কই।’
ছেলেবেলা-য় তিনিই লিখেছিলেন সন্ধেবেলায় ছাদে মাদুরে বসে তাঁর মায়ের মেয়ে-মজলিশের কথা, যেখানে খাঁটি খবরের দরকার হত না। দরকার সময় কাটানো। গবেষণা জানাচ্ছে, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় বেশি কথা বলে— এই সিদ্ধান্তটি তর্কাতীত নয়। কোন পরিবেশে কথা বলছে, তা বিচার্য। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মেয়েরা নয়, অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে ছেলেরাই বেশি কথা বলছে।
কর্ণ যে তাঁদের বড় ভাই, গোপন করেছিলেন কুন্তী। রেগে যুধিষ্ঠির অভিশাপ দেন— মেয়েরা আর কোনও কথা গোপন করতে পারবে না। সেই ইস্তক মেয়েরা নাকি পেটে কথা রাখতে পারে না। পেট ফুলে ওঠে কথা বলতে না পারলে। না কি এই ‘বাজে কথা’গুলো আসলে মেয়েদের অবদমিত অস্তিত্বের সেফটি ভাল্ভ? মাঝে-মাঝে ভসভসিয়ে কথা বেরিয়ে আসে বলেই তারা বেঁচে থাকে? মেয়েলি বকবকানির কত নাম! আলফাল, আগডুম বাগডুম, হাবিজাবি, ফালতু কথা, প্যাঁচাল পাড়া, একা-একা কথা বলা। এত কথার পরেও গৃহান্তরালের নারী বলেন— ‘বুকে কত কথা জইমা আছে, কাউরে কইতে পারলাম না!’
কখনও তা বলা কাগাবগাকে, কখনও ডাকিনী ব্রাহ্মণীকে। ক্ষীরের পুতুল-এ ডাকিনী ব্রাহ্মণী ছিলেন ছোটরানির ‘মনের কথা’। হয়তো সেই ডাকিনীই মনোবিদের পূর্বসূরি। সংক্ষিপ্ত কথা বলার খ্যাতি শুধু তিতাস একটি নদীর নাম-এর অনন্তের মায়ের। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে শুধু বলেছিলেন ‘জানি না’।
বুকে গুমরে মরা কথা মাঝে-মাঝে অশোভন কৌতূহলেও পরিণত হতে পারে। ইসমত চুঘতাইয়ের ‘এক জন স্বামীর জন্য’ গল্পে তারই উদাহরণ। একাকী মহিলাটিকে ট্রেনের সহযাত্রিণীদের প্রশ্নের মূল থিম— ‘স্বামীর কাছে আসছ? না স্বামীর কাছে যাচ্ছ? ছেলেপিলে ক’টি? স্বামী কী করে?’ এক-এক জনের কাছে এক-একটি মিথ্যে বলতে বলতে ‘বছরে চার পাঁচটি বাচ্চা’-র অবাস্তব স্তরে পৌঁছে যায় গল্পটি! মজার মোড়কে ভারতীয় নারীর স্বামী-বাতিকগ্রস্ততার অসহায় রূপ। দেখিয়ে দেয় চরম বাস্তব— মেয়েদের সামাজিকীকরণের আবশ্যিক পাঠ এই স্বামীলগ্নতা।
এই ‘বাজে বকা’র আধুনিক রূপ মিলবে সমাজমাধ্যমে। সমীক্ষা বলছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা নাকি সমাজমাধ্যমে বেশি সক্রিয়। ব্রিটিশ মেয়েরা নাকি ছেলেদের তুলনায় মোবাইলে বেশি মেসেজ পাঠায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলিতে, যেমন স্কুল-কলেজের বন্ধু, পারিবারিক গ্রুপ বা সন্তানের স্কুল বা টিউশন গ্রুপেও মেয়েদের প্রবল উপস্থিতি। সেখানেও তুচ্ছ কথা, ছেঁদো কথা।
রাধারাণী দেবীর লীলাকমল প্রকাশিত হলে স্বর্ণকুমারী দেবীর বাড়িতে প্রমথ চৌধুরী বলেন— মেয়েদের নিজস্ব ভাষা নেই, নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি নেই, তারা শুধু পুরুষের অনুকরণে লেখে।
লিখিত মাধ্যমের আগে মেয়েদের নিজস্ব ভাষা খুঁজতে হবে তাঁদের মুখের ভাষায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কিন্নরদল’ গল্পে ডেঁপো মেয়ে শান্তি বলেছিল, এমন লঙ্কাপোড়া ব্যাপক মেয়েমানুষ আর দেখিনি। খুঁজতে জানলে মেয়েদের তুচ্ছ, বাজে কথায় এমনই লঙ্কার ঝাঁঝ মেলে।
মেয়েরা যদি বেশি বাজে বকে, তবে তারা কি বাজে কথা বেশি শোনেও না? ‘কী জিনিস বেরিয়েছে গুরু?’, ‘বড় হলে মাল হবে’, ‘কোন চালের ভাত খায়?’— এগুলি তো খুব ‘নিরীহ’ টিটকিরিমাত্র! রোবট মেয়েরাও বাজে কথার লক্ষ্য। তারাও এগুলো রক্তমাংসের মানবীদের মতো নীরবে হজম করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy