আমাদের অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে অস্থির, মুহূর্তগামী, সদা মন্তব্যপিপাসু। প্রতীকী ছবি।
নিজের বলতে যতটা বা যা কিছু বোঝায়— পেটাই শরীর, প্রসাধন-লালিত মুখশ্রী, উচ্ছ্বসিত বন্ধুদল, অর্জিত সম্পত্তি, লব্ধ পণ্য— সব এখন নিজস্বী বা সেলফির আওতায়। যা কিছু নিজের নয় তাও তার গণ্ডিবদ্ধ: সাগরে বিমানে পাতালে, রাস্তায় বা রেস্তরাঁয় সবাই মগ্ন এক দৃশ্য-সাধনায়। শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে বেঁকে, অনবরত এক হাত প্রসারিত করে নিজের ছবি তুলে, তাতে রং চড়িয়ে ও তক্ষুনি বিলিয়ে নিজেদেরকেই তোল্লাই দিচ্ছি আমরা, এক নেশাতুর ডিজিটাল-ক্রিয়ায়।
নিজেকে নিয়ে, নিজেকে দিয়ে, নিজেকে দেখার ও দেখানোর এই আবিশ্ব প্রবণতা উস্কে দিয়েছে মুঠোফোনের সেলফি ক্যামেরা। এই দৃশ্যকেন্দ্রিকতা ইন্টারনেট-নির্ভর, যার দ্বারা নিমেষে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে দৃশ্য-তথ্য বণ্টন সম্ভব। তাই আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের প্রতিনিধিত্বের দায়ভার সঁপেছি নিজস্বীকে, প্রযুক্তি আমাদের অংশ-বিশেষ নিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিচ্ছে অন্যের মুঠো-পর্দায়। আমাদের অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে অস্থির, মুহূর্তগামী, সদা মন্তব্যপিপাসু। এই অস্থিরতা বাধ্য করে আমাদের চালচলন, পাশের মানুষজন ও পটভূমি পাল্টে-পাল্টে নিজেকে সচেতন ভাবে সাজাতে। গোটা পরিকল্পনাটাই নিজের দ্বারা, যদিও অধিকাংশ সময় তা অপরমুখী। সে কারণেই মুহূর্তে তার বিতরণ না হলে সমস্ত প্রয়াসটাই বৃথা।
নিজস্বী-স্পৃহায় উৎসাহ দিতে বাজারে আসছে নিত্যনতুন ‘সেলফি-এক্সপার্ট’ ক্যামেরা। উন্নততর মেগাপিক্সেল-মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে নিজ-দৃশ্য-আরতি, পরবর্তী নিজস্বীর তরঙ্গে বিলীন হচ্ছে খানিক আগে তোলা নিজের ছবিটি। এই অস্থায়িত্বই নিজস্বীর স্বভাব। সাময়িকতার দৈনন্দিন উৎসবে আমরা এতই মগ্ন যে, কোনও নিজ-ছবিই আলাদা করে দাগ কাটে না, দীর্ঘমেয়াদি হয় না। স্থিরচিত্রের নান্দনিক দর্শনে স্থান-কালের স্থিতির যে অনড়-ভাবনা ছিল, ডিজিটাল অঢেলপনা সেই স্থায়িত্বকে বাতিল করেছে। নিজস্বীর আধিক্যের সামনে অ্যালবামে সুরক্ষিত গুটিকয় ছবি এখন মূল্যবান হলেও ‘অচল’। অফুরন্ত, ওজনহীন ডিজিটাল সঞ্চয়-ভান্ডারের সামনে অ্যালবাম কোথায়! নিমেষে ও নির্বিঘ্নে কমকে বেশিতে, এক-কে একাধিকে পরিণত করাই উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির দর্শন। পারদর্শিতাও।
তবে কেবলমাত্র আধিক্যের যুক্তি দিয়ে আত্ম-দৃশ্যের এই জোয়ারকে ব্যাখ্যা করলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আরও কিছু বৈশিষ্ট্য মাথায় রাখা জরুরি। ‘মাধ্যমের গণতন্ত্রায়ন’-এর ফলে জনসাধারণের হাতে এসেছে সেই দৃশ্য-যন্ত্র এবং ছবি তোলার চরম সুবিধা, এক দশক আগেও যা ছিল বিশেষজ্ঞদের জিম্মায়। ক্ষমতার হাত ধরে এসেছে সমতা, সেই সঙ্গে ঘুচেছে ফোটোগ্রাফার ও নন-ফোটোগ্রাফারের তফাত ও দূরত্ব। ছোট পর্দায়, ভাল আলোয় মুঠোফোনের ক্যামেরা টেক্কা দিচ্ছে নামী-দামি বহু ক্যামেরাকে। অনেক মুঠোফোনের বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হয় তারা হয়তো ফোন নয়, ক্যামেরাই বেচতে চাইছে। সবার হাতেই এখন ক্যামেরা। সবাই ছবি তুলতে সক্ষম, সবাই ফোটোগ্রাফার। ছবির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন— সে অন্য প্রসঙ্গ।
কয়েক বছর আগেও দৃশ্য ও দর্শক, স্থিরচিত্র ও স্থিরচিত্রকারের বিভাজন ছিল প্রতিষ্ঠিত ও প্রশ্নাতীত। যে ছবি তুলছে ও যার ছবি তোলা হচ্ছে, প্রথাগত ভাবে এরা ভিন্ন না হলে স্থিরচিত্র নির্মাণ সম্ভব ছিল না। নিজস্বী এই সমীকরণ উল্টে দিল। এখন যার হাতে ক্যামেরা, মুঠোফোনের পর্দা জুড়েও সে-ই। নিজেকে নিজের মতো করে দেখার যে দৃশ্য মুঠোফোনের পর্দায় দেখা যাচ্ছে, সেটাই ছবি। অনেকে হয়তো বলবেন, তাবড় তাবড় ফোটোগ্রাফারও তো ‘সেল্ফ-পোর্ট্রেট’ তুলেছেন। তা নিশ্চয়ই, কিন্তু নিজস্বী এক অর্থে সেল্ফ-পোর্ট্রেট হলেও প্রযুক্তিগত ভাবে ও নান্দনিক বিচারে তা অনেকটাই আলাদা। এ অনেকটা আয়নায় মুখ দেখার মতো, বা সরাসরি আত্ম-সম্প্রসারণের মতো। নিজের ছবি তোলার সময় নিজেকে অনবরত দেখা এবং সেই দৃশ্যকেই ছবি-রূপে পেশ করা— এটাই নিজস্বী-নির্মাণের প্রণালী। দেখনদারির এই প্রচলিত মুদ্রায় নিজ-চিত্র ও স্থিরচিত্রকার একনিষ্ঠ।
ছবিটি তোলার মুহূর্তকে ক্যামেরায় দেখা আর ছবি তোলার পর সেটাকে মুদ্রিত অবস্থায় দেখার মধ্যে যে চিরাচরিত স্থান-কালের ফারাক ছিল, তা আজ বিলীন। কার্য, ক্রিয়া ও ব্যক্তির মধ্যে ছবি তোলার সময় যে ব্যবধান ছিল— নিজস্বীকালীন তৎপরতায় তা মুছে গিয়ে সেটাই আজ ছবির বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। অৰ্থাৎ, ছবি তোলার প্রক্রিয়াটাও এখন ছবি। ছবি তোলার প্রণালী বা চেষ্টা— নিজস্বী-পূর্ব যুগে যা ছিল ছবির অগোচরে—সেটাই এখন নির্দ্বিধায় নির্লজ্জ ভাবে ছবির অন্তরে-অভ্যন্তরে, আনাচে-কানাচে। বিবর্তন ঘটেছে এতটাই। এটাই রূপান্তর, এখানেই বিপ্লব— দৃষ্টি, দৃশ্য, দৃশ্যকার— মিলেমিশে একাকার।
নিজস্বীগ্রস্ত এই সভ্যতা নিজেকে দৃশ্য-পণ্যে পরিণত করে ও তাকে বিতরণ করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সদা উন্মুখ। নিজস্বী-ক্যামেরাটি এখন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে, প্রতিটি নিজস্বীই জরুরি এক ‘স্টেটাস আপডেট’। ছবি তুলে, বা তোলার মুহূর্তেই না জানালে যেন জীবন বৃথা। প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্তই এখন প্রচারযোগ্য ও মন্তব্যকামী; নিজের অস্তিত্ব, সঙ্গ ও একাকিত্বকে নিজস্বীর মাধ্যমে সম্প্রচার করাটা দাঁড়িয়েছে অভ্যাসে।
এই স্ব-মুদ্রণের মাধ্যমে জ্ঞানত বা অজানতে আমরা হয়ে উঠেছি একাধারে দৃশ্য এবং দর্শক। নিজস্বী-দর্শনের ধারক বাহক প্রচারকও আমরাই। আমরাই অংশগ্রহণকারী, আমরাই মূল্যায়নকারী। দৃশ্যগত ভাবে নিজের উপর নিজের ও অন্য সকলেরই রয়েছে কড়া আত্ম-প্রহরা— যা এক দিকে নিতান্ত নাছোড়বান্দা, অন্য দিকে চূড়ান্ত নজরবন্দি।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy