বিধ্বংসী বন্যায় ভাসল সিলেট। ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশের সিলেট শহরের গা ঘেঁসে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদীতে পাশাপাশি নোঙর করা দু’টি নৌকার মানুষজনের মধ্যে বাক্যালাপ চলছিল; কী কারণে ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী বন্যায় এ বার ভাসল সিলেট (ছবি), যার ফলে অকূলপাথারে পড়লেন প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষ? “নদীকে গুরুত্ব না দিলে, নিয়মিত নদীর পানির উপর অত্যাচার চালালে এটাই ভবিতব্য; আজ এখানে, কাল হয়তো অন্য কোনওখানে”— বললেন পাশে বসা এক স্থানীয় পরিবেশ কর্মী।
পরের দিন আন্তর্জাতিক জল সম্মেলনের চার দেওয়ালের মধ্যেও একই কথার প্রতিধ্বনি— কী ভাবে কলকাতা থেকে ঢাকা, করাচি থেকে কলম্বো, গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে নদীকে নর্দমা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, নদী দখল করে বাড়ি বা কারখানা তৈরি হচ্ছে, বালি তোলা হচ্ছে; এক কথায় স্রেফ খুন করা হচ্ছে চটজলদি ব্যবসায়িক লাভের জন্য। আর এই ভাবে লাভের ভাগীদার হওয়া, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে ‘পলিটিক্যাল রেন্ট সিকিং’, অর্থাৎ নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তিকে ভাড়া খাটিয়ে বেআইনি রোজগার, তা চলছে কখনও পর্দার আড়ালে, কখনও খোলাখুলি। অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রে এ মডেল কাজ করলেও পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে— জলবায়ু পরিবর্তন, বাতাস, শব্দ থেকে নদী— এই দুর্নীতির প্রবণতা বেশি। এক দিকে চটজলদি বড় ‘রিটার্ন’, অন্য দিকে তুলনামূলক ভাবে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকায়।
কথা উঠল, হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বেন এই নদীগুলির প্লাবনপথের চৌহদ্দিতে থাকা অসংখ্য মানুষ। অন্য উদাহরণের সঙ্গে উঠে এল আদিগঙ্গার কথা, যেটি গোটা বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র উদাহরণ যেখানে দেশের জাতীয় নদীর একাংশ ভরাট হয়ে স্রেফ ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এখন থেকে ব্যবস্থা না করলে হয়তো সে দিন খুব দূরে নয়, যখন গত কালের সিলেটের মতো দিনের পর দিন বন্যাবন্দি থাকবে কলকাতা। এক প্রবীণ পরিবেশবিদ তুললেন জোশীমঠের ‘ম্যান মেড’ বিপর্যয়ের কথা। প্রশ্ন তুললেন, পাহাড়ের পর এ বারে কি নদী বিপর্যয়ের পালা? মনে পড়ে গেল প্রায় এক দশক আগে চিপকো আন্দোলন-খ্যাত সুন্দরলাল বহুগুণাজির কাছে শোনা এক মন্তব্য— যত দিন না দেশে অভিন্ন হিমালয় ও গঙ্গা নীতি তৈরি হচ্ছে, তত দিন ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলিতে পরিবেশের সঙ্কট ক্রমেই গভীর হবে। কিন্তু পূর্বতন কংগ্রেস সরকার বা গঙ্গাকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা বর্তমান বিজেপি সরকার সে প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখায়নি। বরং নদী সংযুক্তিকরণের মতো আত্মঘাতী পরিকল্পনাকে যাবতীয় সমালোচনা সত্ত্বেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। মনে পড়ে, বহুগুণাজি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ভাগীরথীর উপরে তৈরি হওয়া দানবের মতো চেহারার টিহরী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যখন তাকাই, তখনই মনে হয় প্রকৃতির নিয়মকে উল্টে দেওয়ার এমন স্পর্ধা আমরা সামলাতে পারব তো?
সামলাতে যে পারেনি, তা স্পষ্ট। নদী ঘিরে সঙ্কট ক্রমেই গভীরতর হয়েছে দেশ জুড়ে, এ রাজ্যেও। সমীক্ষা বলছে, দেশের ২২টি নদী উপত্যকার মধ্যে মাত্র ছ’টি হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে পারবে। নীতি আয়োগের হিসাব, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য সঙ্কটে পড়তে পারেন প্রায় ৬০ কোটি ভারতীয়। অন্য সব নদী তো দূর স্থান, এমনকি জল কমছে গঙ্গারও। এ রাজ্যে তেমন ভাবে কোনও সরকারি তথ্য না থাকলেও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সবুজ মঞ্চের হিসাব, রাজ্যে পঁচাত্তরটির উপর নদী ‘বিপন্ন’; যার মধ্যে আদিগঙ্গা বাদ দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে যেমন রয়েছে সরস্বতী, বিদ্যাধরী, ইছামতীর মতো নদী; তেমনই উত্তরবঙ্গে রয়েছে মহানন্দা, আত্রেয়ী, পুনর্ভবা বা শ্রীমতী। জীবন-জীবিকার সঙ্কটে এই সব নদীর উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মৎস্যজীবী, চাষি ও সাধারণ মানুষ।
সমস্যা হল, ভাল ভাল কথা অনেক বললেও পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নেমে কাজ করা তো দূর, যা করা প্রয়োজন তার ঠিক উল্টোটাই অধিকাংশ সময়ে বিভিন্ন সরকার করছে। আর কেন কাজ হচ্ছে না, এ কথা মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করলে বলছে ‘মানুষ সচেতন না হলে কিছু হবে না’! কেন্দ্রীয় সরকার এক দেশ, এক রেশন, এক আইনিব্যবস্থা, এক নির্বাচনের নীতির কথা বললেও কখনও এক হিমালয় বা এক গঙ্গা নীতির কথা বলে না। সৌরশক্তি থেকে স্টার্টআপ ব্যবসা; ডিজিটাল দক্ষতা থেকে অত্যাধুনিক সামরিক বিমান শক্তিতে বিশ্বে সামনের সারিতে থাকার দাবি করলেও; মুখ ফুটেও এই আলোচনা করে না, কেন পরিবেশের কাজ করার ক্ষেত্রে দেশ একেবারে পিছনে! হইহই করে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদ্যাপন আর জি২০ দেশগোষ্ঠীর প্রধান হওয়ার প্রচারের বেলুন জোশীমঠ বিপর্যয়ের ফলে সামান্য হলেও চুপসে গিয়েছে। কিন্তু যদি না পরিবেশের উপর এমন দাঁত-নখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া উন্নয়নকে অবিলম্বে সামলানো যায়, যদি না দেশ ও রাজ্যে ক্রমহ্রাসমাণ নদী, জলাভূমিকে রক্ষা করা যায়; তবে স্বাধীনতার একশো বছরের ‘অমৃত’ কালে শুধু গরল উঠবে। তখন আজকের রাজনীতিকরা থাকবেন না, কিন্তু ফল ভুগবে আগামী প্রজন্ম।
ঋণস্বীকার: বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ও রাহুল রায়, পরিবেশ অপরাধ, পরিবেশ আকাদেমি, ২০২২
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy