Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Supernova

নক্ষত্রের মৃত্যু ও তার পর

ঝলমলে তারাগুলিকে হঠাৎ ম্লান করে দিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটল, সারা আকাশ সেই আলোর ছটায় সন্ধ্যাকে যেন ভোর বানিয়ে দিল।

বিকাশ সিংহ
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৩৯
Share: Save:

বিজ্ঞানের গভীরে যেমন একটা ছন্দ আছে, এক অপূর্ব সৌন্দর্য আছে, তেমনই বিজ্ঞানের যাঁরা সাধক, তাঁদের মনে রহস্য মেশানো এক অসহ্য কৌতূহলও লুকিয়ে আছে। ব্যাপারটা কী? কেন? এই অদম্য কৌতূহলেরই প্রেরণায় বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায় শুরু হয়, আবিষ্কার হয় নতুনের।

আজ থেকে মোটামুটি তিনশো বছর আগে, ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে চিন দেশের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী খালি চোখেই সন্ধ্যার আকাশে শুধু জ্বলজ্বলে তারাগুলিকে দেখছিলেন— তাদের গতিবিধি, ঔজ্জ্বল্যের তারতম্য ইত্যাদি। ঝলমলে তারাগুলিকে হঠাৎ ম্লান করে দিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটল, সারা আকাশ সেই আলোর ছটায় সন্ধ্যাকে যেন ভোর বানিয়ে দিল। এই বিস্ফোরণের কী কারণ, তা আবিষ্কার হল বিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকে— অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের পরে এবং নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন নিউট্রনের চালচলন ভাল করে বুঝে ওঠার পর। এই বিস্ফোরণের নামকরণ হল সুপারনোভা। ওই সুপারনোভার ভয়ঙ্করী শোভাই চিন দেশের বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছিলেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭, আবার সেই খালি চোখেই সুপারনোভার বিস্ফোরণ দেখা গেল। নীল রঙের এক বিরাট তারা (সূর্যের ওজনের তুলনায় ১০ থেকে ২৫ গুণ ভারী) যার নাম ‘স্যানডুলিক-৬৯২০২’। আমাদেরই লার্জ ম্যাগলেনিক ক্লাউড-এ তার বাসস্থান। তারাটিতে কী ঘটল যে, ওই মাপের একটা বিস্ফোরণ হল?

দৈত্য তারার ওজন সূর্যের ১০-২৫ গুণ। কাজেই তার মাধ্যাকর্ষণ প্রচণ্ড। নিজেরই মাধ্যাকর্ষণকে আটকে রেখেছে বহু যুগ ধরে, বহু কাল ধরে। পারমাণবিক শক্তিই মাধ্যাকর্ষণের প্রচণ্ড আকর্ষণকে খিল দিয়ে রেখেছে, যেমন ঘরে খিল দেওয়া থাকলে বাইরে থেকে কেউ ঘরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু পারমাণবিক শক্তি যদি শেষ হয়ে যায়, খিলটা বাইরের মাধ্যাকর্ষণের চাপে খুলে যায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে দৈত্য তারার পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ হয়ে যায় এবং বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে বুঝেছেন যে, সেটাই হওয়া উচিত, অর্থাৎ এক কোটি বছর পর পারমাণবিক চুল্লি আপনা থেকেই প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে বন্ধ হবে। আমাদের সূর্যেরও এই দশাই হবে, আজ থেকে বহু কোটি বছর পরে। তখনই মাধ্যাকর্ষণের প্রবল আকর্ষণে দৈত্য তারা নিষ্পেষণের পথে যায়, আদি তারাটি মাধ্যাকর্ষণের অভাবনীয় চাপে সঙ্কুচিত হতে থাকে।

এই দৈত্য তারার নাম দেওয়া হল এসএন১৯৮৭এ (এসএন সুপারনোভা), সুপারনোভার মহাবিস্ফোরণের পর যা যা হওয়ার কথা, সে খুবই সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াগুলির কথা ইতিমধ্যে ছাপা হয়েছে। কিন্তু কতকগুলি মূল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। এই মূল প্রশ্নগুলির মধ্যে সব থেকে অমূল্য প্রশ্ন হল, আদি তারাটা গেল কোথায়? আর তা কী অবস্থাতেই বা আছে?

অনেকেরই ধারণা যে, আদি দৈত্য তারাটির ওই মাধ্যাকর্ষণের প্রচণ্ড চাপে নিউট্রন তারায় রূপান্তরিত হওয়া উচিত। কেমব্রিজে আমার মাস্টারমশাই টোনি হিউইস এবং তাঁর মাস্টারমশাই মার্টিন রাইলে ১৯৬০-এর শেষের দিকে আবিষ্কার করেছিলেন এই নিউট্রন তারা।

নিউট্রন তারা একটি অকল্পনীয় ভারী তারা। এক দেশলাই বাক্স নিউট্রন তারার পদার্থের ওজন ত্রিশ কোটি টন— পৃথিবীতে ০.৫ ঘন কিলোমিটার পরিসরের পার্থিব পদার্থের ওজনের সমান। কিংবা, এক চামচ নিউট্রন তারার পদার্থ গিজার বিখ্যাত পিরামিডের ৯০০ গুণ ভারী। ১০ কিমি তার পরিধি, ওজনে প্রায় দু’টি সূর্যের সমান। কিন্তু সেই নিউট্রন তারা ১৯৮৭ সালের এসএন১৯৮৭এ থেকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসএন১৯৮৭এ থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছোনোর আগেই পৃথিবীর বুকে পৌঁছল নিউট্রিনো নামে একটি মৌলিক কণা, আলোর গতিতে যাত্রা করেছিল দৈত্য তারা থেকে। ওই এসএন১৯৮৭এ যখন মাধ্যাকর্ষণের নিষ্পেষণে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তখন পারমাণবিক প্রক্রিয়ার ফলে নিউট্রিনোগুলো ধেয়ে আসে বিশ্বের আকাশে। জাপানের বিখ্যাত ক্যামিয়োকান্তে ডিটেক্টরে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, আলোর রেশটুকু পৌঁছোনোর আগেই। নিউট্রিনো এবং তাদের বিপরীত কণা অ্যান্টি নিউট্রিনো ওই জাপানি ডিটেক্টরে রাতদুপুরে তাদের পৌঁছে যাওয়ার খবর জাহির করে টেলিভিশন স্ক্রিনে। মুহূর্তে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। কিন্তু নিউট্রন তারার কোনও হদিসই পাওয়া গেল না।

আলো নিউট্রিনোর পরেই পৌঁছবে। আলো তখনই বেরোবে যখন নিষ্পেষণের প্রবাহ ঢেউ তারার সামনের দিকে পৌঁছবে। নিউট্রিনো সোজা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আসল কথা, আদি তারা তা হলে কোথায় গেল?

২০১৯ সালে চিলি দেশের ‘অ্যাটাকামা লার্জ মিলিমিটার অ্যারে’ (এএলএমএ) তারার অন্ত্যেষ্টি ছাই থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা রেডিয়ো ঢেউগুলি ধরা দেয়। ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল সিগান ওই রেডিয়ো ঢেউগুলি পরীক্ষা করে বুঝলেন যে, তার মাঝখানে আছে একটি বড়ি-ছোপ (ব্লব)। তা থেকে যা বিকিরণ হল সেটা বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিকরা বুঝলেন, নিউট্রন তারা যে সব কণাকে গতিশীল করে, ওই বিকিরণের চরিত্রও ঠিক তার মতো। অর্থাৎ, ওই ব্লব একটি নিউট্রন তারার বাসা।

ইটালির পালেরমো থেকে ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালে এই ধরনের একটা ব্যাপার ধরা পড়েছিল। তা হলে নিউট্রন তারা দেখা যায়নি কেন? যখন দৈত্য তারা নিষ্পেষণের পথে ছোটে এবং নিষ্পেষিত হয়, তখন মহাজাগতিক ধুলো নিউট্রন তারাকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছিল যে, কোনও রকমেরই আলো বেরোতে পারছিল না। ধুলোর ঝড় যেমন দিনকে সন্ধ্যা বানিয়ে দেয়, সে ভাবেই এই মহাজাগতিক ঘোমটা নিউট্রন তারাটিকে পুরো ঢেকে রেখেছিল। দীর্ঘ ৩৪ বছর লাগল ধুলোর ঘোমটাটি খুলতে। হয়তো চোখে দেখা আলোর কাছে নয়। কিন্তু এক্স-রে, বা অন্য কোনও বিকিরণের ক্যামেরায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম নিউট্রন তারার বিলম্বিত জন্মক্ষণ মহাজাগতিক পর্দায় চলচ্চিত্রের মতো ফুটে উঠল। এ চলচ্চিত্র বিচিত্র, এত বছর ধরে শুধু ঘোমটাই খোলা হল, মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, আশ্চর্য রহস্যের সমাধান হল।

অন্য বিষয়গুলি:

Supernova Destruction
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy