অপচেষ্টা: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ-শেষে দার্জিলিঙের রাজভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন সুবাস ঘিসিং, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭।
উত্তরবঙ্গ ভেঙে পৃথক রাজ্যের জিগির উঠেছে আবার। গুজব, গুঞ্জন, স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা যা-ই হোক, এর ফলে ‘অন্য রকম’ হাওয়া পাক খায়। অন্য রকম ভুজুং দেওয়ার ফাঁকও পাওয়া যায়। এ এক পুরনো কৌশল। ইদানীং বাড়ছে। কোনও বড় নির্বাচনের সময় এগোলে বিষয়টি বেশি করে শোনা যায়।
পাহাড়ে পৃথক ‘গোর্খাল্যান্ড’ রাজ্যের দাবি ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায়। ১৯৮৬ সাল থেকে জিএনএলএফ নেতা সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে সেই আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী চেহারা ভোলার নয়। তাঁর পরে বিমল গুরুং-এরও দাবি ছিল একই।
এখন কোচবিহারের ‘গ্রেটার’ নেতা অনন্ত মহারাজ ময়দানে! উত্তরবঙ্গে বিজেপির একাধিক সাংসদ, বিধায়কেরও ‘মন’ পৃথক হওয়ার দিকে। তবু এটা বলতেই হবে, গত চল্লিশ বছরে বাংলা ভাগ করতে চাওয়া কোনও শক্তিই সফল হয়নি। সেই সঙ্গেই বলার, বিজেপি তার জনপ্রতিনিধিদের বাংলা ভাগের দাবি থেকে সরে আসার সুস্পষ্ট নির্দেশ আজও দেয়নি!
বাংলাকে ভাঙতে না পারলেও ঘিসিং থেকে গুরুং শুধু নিজেদের ক্ষমতাভোগের অঙ্ক কষে কখনও কলকাতা, কখনও দিল্লির শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন এবং ভেঙেছেন। রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসকেরাও নিজ নিজ হিসাবমতো তাঁদের ‘ব্যবহার’ করেছেন। আজও একই খেলায় আপাতত রাজবংশী নেতা অনন্ত মহারাজ কেন্দ্রীয় চরিত্র! নেপথ্যে অন্য কার কী ভূমিকা, সে সব হয়তো ক্রমশ প্রকাশ পাবে।
ঘিসিং-এর পৃথক রাজ্যের দাবি রাজ্যের বামফ্রন্ট, বা কেন্দ্রের কংগ্রেস, কোনও সরকারই মানেনি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সক্রিয়তায় ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে ১৯৮৮-র অগস্টে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ তৈরি করে দেওয়া হয়। জিএনএলএফ তাতে স্বশাসনের কিছুটা পরিসরও পেয়ে যায়।
পরের কয়েক বছরে জিএনএলএফ-এ ভাঙন, ঘিসিং-এর পতন, গুরুং-এর উত্থান, তাঁর নেতৃত্বে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গঠন থেকে শুরু করে পার্বত্য পরিষদের বদলে জিটিএ এবং তাতে গুরুং-এরই ক্ষমতালাভ পাহাড়ে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছিল।
তা বলে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে গুরুং মানসিক ভাবে সরে এসেছিলেন, তেমন নয়। বরং পাহাড় থেকে ডুয়ার্সের কিছুটা অঞ্চল নিয়ে সাড়ে ছ’হাজার বর্গ কিলোমিটারব্যাপী আলাদা রাজ্যই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে কেন্দ্র, রাজ্য এবং জনমুক্তি মোর্চার মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী জিটিএ তৈরি হলেও তাই সমাধান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০১৭ সালে পাহাড় ফের অগ্নিগর্ভ হয়। কেন্দ্রে তত দিনে বিজেপি সরকার এসে গিয়েছে।
পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন অভিযুক্ত বিমল। তখন পাল্টা চালে জনমুক্তি মোর্চায় ভাঙন ধরিয়ে বিনয় তামাংকে জিটিএ চেয়ারম্যান পদে বসান মমতা। এবং দেখা যায়, দেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বিমলের সঙ্গেই বৈঠক করছেন!
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে দার্জিলিং থেকে বিজেপির জয়ের পিছনেও গুরুংদের ভূমিকা অস্বীকার করার নয়। যদিও পাহাড়ে ফিরে গুরুং একুশের বিধানসভা ভোটে মমতার পাশে দাঁড়ান। তবে মমতা-সমর্থক জনমুক্তি মোর্চাকে হারিয়ে পাহাড়ের তিনটি আসনের দু’টিই বিজেপি পায়। বলা হয়, তামাং-গুরুং বিরোধই নাকি এর কারণ।
এই বিরোধের ক্ষেত্র ‘প্রস্তুত’ করে দেওয়া মমতার কৌশলগত ‘ভুল’ ছিল কি না, কেউ সেই প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু এটা লক্ষ করার যে, পৃথক রাজ্যের দাবি তোলা গুরুং-এর প্রভাব আজকের পাহাড়ে দৃশ্যতই নগণ্য হয়ে গিয়েছে। জিটিএ-র শীর্ষপদেও এখন তামাং-এর বদলে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ অনিত থাপা। দু’টি বিধানসভা আসনে বিজেপি জিতলেও তাই ‘লাভ-ক্ষতি’র আর এক হিসাব হয়তো ফেলনা নয়!
‘গ্রেটার কোচবিহার’ আন্দোলনের নেতা অনন্ত রায় এখন বিভাজনের যে ছবি দেখাচ্ছেন, তার ভূগোল ও রাজনীতি, দুই-ই আলাদা। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি সম্প্রদায়ের প্রায় কুড়ি শতাংশ রাজবংশী। প্রধানত কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে তাঁরা ভোটে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
অনন্ত মহারাজের ‘স্বপ্ন’ অবশ্য আরও বিস্তৃত। তিনি পাহাড়-সহ কোচবিহার থেকে মালদহ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের আটটি জেলাকে নিয়েই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করতে চান। এই দাবি মানলে মালদহ থেকে দার্জিলিং সবটাই বাংলার বাইরে চলে যাবে। সব মিলিয়ে যার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি প্রায় ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার। মূলত একই দাবি কামতাপুরিদেরও।
কোচবিহারের অনন্ত ‘মহারাজ’কে বিজেপি এবং মমতা, উভয়েই বিস্তর প্রশ্রয় জুগিয়ে থাকেন। অনন্ত সেই ‘সুযোগ’ সদ্ব্যবহারে বিলক্ষণ চতুর। রাজ্য ভাগের দাবি না ছেড়েও তিনি রাজবংশী ভোটের আঙুরফল দেখিয়ে দুই পক্ষকে বেশ ‘মানিয়ে’ চলতে পারছেন! গত লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে রাজবংশীদের সমর্থন হারানোর পর থেকে ‘গ্রেটার কোচবিহার’ আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। রাজবংশীদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে মান্যতা দিতে বিবিধ সরকারি পদক্ষেপ করেছেন মমতা। আবার এখানেও ‘গ্রেটার’ ভেঙে আসা বংশীবদন বর্মন তৃণমূলের ‘ছায়াতলে’। যদিও অনন্তের সঙ্গে তিনি তুলনীয় হয়ে ওঠেননি।
অনন্ত কী চান, মমতার তা অজানা নয়। আবার মমতা যে কিছুতেই ‘বঙ্গভঙ্গ’ মানবেন না, অনন্তের চেয়ে ভাল তা আর কেউ বোঝেন না। বস্তুত দু’জনের বক্তব্যও এ ক্ষেত্রে প্রকাশ্য। তথাপি অনন্ত মহারাজকেই ‘প্রভাবশালী’ মনে করে শিলিগুড়িতে মমতার বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারও কয়েক মাস আগে মহারাজের ডাকে তাঁদের পূর্বপুরুষ, রাজবংশীদের ‘আইকন’ চিলা রায়ের ৫১১তম জন্মোৎসবে যোগ দিতে কোচবিহারে যান মুখ্যমন্ত্রী। অনেকের মতে, রাজ্য ভাগের আন্দোলন থেকে অনন্তকে সরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই মমতা তাঁর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ স্থাপনে আগ্রহী। রাজবংশী ভোটের ভাবনা তো আছেই।
একই কারণে লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অনন্ত-ভজনায় আকুল হতে দেখা গিয়েছিল। বিজেপির শীর্ষ নেতারা অনন্ত মহারাজকে এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। কয়েকদিন আগেই শিলিগুড়িতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসলের কাছে ‘মহারাজ’কে নিয়ে গিয়েছিলেন কোচবিহারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক। তার আগে নিশীথের বাড়িতেও গিয়েছিলেন অনন্ত।
রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে তাঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছে, সেটা অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু প্রশ্ন হল, অনন্ত মহারাজ এখনও খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার যে প্রতিশ্রুতি শোনাচ্ছেন, দেশের শাসকরা সেই বিষয়টিকে রহস্যময় ভাবে এড়িয়ে থাকছেন কেন? রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব পাশের দোহাই দিয়ে কেন দিল্লির এই ধরি মাছ, না-ছুঁই পানি কৌশল? নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে কিসের এত দ্বিধা? রাজ্য ভাগের বিরুদ্ধে বলছেন শুধু দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। আসলে বালুরঘাট থেকে ফের জিতে আসার ‘চাপ’ তিনি বোঝেন!
২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূল উত্তরবঙ্গে ৪৩ শতাংশ রাজবংশী ভোট পেয়ে আধিপত্য দেখিয়েছিল। ২০১৯-এর লোকসভায় তা নামে ৮ শতাংশে। বিজেপি ৯ থেকে বেড়ে ৭৫। মালদহের একটি বাদে আসনও সব তাদের। একুশের বিধানসভায় আবার তৃণমূল ৩৮ শতাংশে। বিজেপি কমে ৫৯।
লড়াই ছিল হাড্ডাহাড্ডি। খোদ কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ দিনহাটা বিধানসভায় জিতলেন মাত্র ৫৭ ভোটের ব্যবধানে। তিনি সাংসদ থেকে যাওয়ায় উপনির্বাচনে তৃণমূল জিতল ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ভোটে।
উত্তরবঙ্গে রাজবংশী-জমি আলগা হওয়ার সঙ্কেতে বিজেপি হয়তো মনে করছে, লোকসভার আগে স্পষ্ট কথার ‘কষ্ট’ অনেক! বাংলার পক্ষে এটাই দুর্ভাগ্যের রাজনীতি। সবচেয়ে বড় কথা, বিয়াল্লিশটির মধ্যে উত্তরে লোকসভা আসন মাত্র আটটি! তা হলে ‘ভাগের গুড়’ খাবে কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy