Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
আমেরিকার বন্ধুত্বে অন্য দেশকে ভুললে ভারতের চলবে না
Globalization

বিশ্বায়নের উল্টো পথে

বর্তমান বিশ্বে মোটামুটি সব দেশেই যত ধরনের শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার পুরোটা কোনও একটি দেশের একার পক্ষে সম্পূর্ণ রূপে উৎপাদন করা অসম্ভব।

An image of Globalization

—প্রতীকী চিত্র।

বিশ্বজিৎ নাগ
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৩ ০৫:১০
Share: Save:

অতিমারি-পরবর্তী সময়ে, বিশেষত গত দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিকায় বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার তীব্রতা বেড়েছে। প্রশ্ন উঠছে, গত তিন দশকে বিশ্বায়নের যে ছবিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেটি কি আমূল বদলে যাচ্ছে? আমেরিকা-সহ যে শিল্পোন্নত দেশগুলি বিশ্বায়নের মূল প্রবক্তা ও উদ্যোক্তা ছিল, সেই দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখন নিজেদের সঙ্কীর্ণ সুবিধার কথা মাথায় রেখে ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেন’-এর চেহারাটাই বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিশ্বায়নের অন্যতম দিক এক বৈশ্বিক জোগানশৃঙ্খল। তার চরিত্র পাল্টে গেলে বিশ্বায়নের চেনা চেহারাটাও স্বাভাবিক ভাবেই পাল্টাবে।

বর্তমান বিশ্বে মোটামুটি সব দেশেই যত ধরনের শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা রয়েছে (ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে ওষুধ, কারখানার যন্ত্রপাতি, সামরিক খাতে ব্যবহৃত পণ্য ইত্যাদি), তার পুরোটা কোনও একটি দেশের একার পক্ষে সম্পূর্ণ রূপে উৎপাদন করা অসম্ভব। কারণ, সেই সব পণ্যকে ব্যবহারযোগ্য বা বাজারজাত করে তোলার আগে উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে যত রকম কাঁচামাল, প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়, অথবা যে ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তি লাগে, দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত সব পণ্যের জন্য তত কাঁচামাল, প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি বা শ্রমশক্তির জোগান দেওয়া কোনও একটি দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়; ব্যাপারটা খুবই ব্যয়বহুলও বটে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবার নিয়ম মেনে এবং বিশ্বায়নের হাত ধরে তাই পণ্য তৈরির বিভিন্ন ধাপ এখন বহু দেশে বিস্তৃত।

এই বহুধাবিস্তৃত ও পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ধাপগুলির শৃঙ্খলকেই বলা হয় পণ্যের গ্লোবাল সাপ্লাই চেন, বা বৈশ্বিক জোগানশৃঙ্খল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ এবং তাদের কারবারি সংস্থাগুলি এই জোগানশৃঙ্খলের অংশীদার হয়। এই ব্যবস্থা বিভিন্ন দেশকে একে অপরের উপরে নির্ভরশীল ও পারস্পরিক ভাবে অপরিহার্য করে তুলেছে। বিশ্বায়নের কাঠামোও এই ভাবে হয়ে উঠেছে বিস্তৃত ও সুদৃঢ়। বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৭০% হয় জোগানশৃঙ্খল মারফত। এবং তার সিংহভাগ হল বিভিন্ন উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোনও উৎপাদন শিল্পের চূড়ান্ত পণ্য অন্য উৎপাদন শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় বহু ক্ষেত্রে। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি বিভন্ন পণ্যের জোগানশৃঙ্খলের এক মহাজাল রচনা করে চলেছে পৃথিবী জুড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশগুলির আর্থিক অগ্রগতিও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

স্পষ্টতই, বর্তমানের উৎপাদন ব্যবস্থা বেশ জটিল। জটিল ব্যবস্থার দুর্বল দিকও অনেক। যে কোনও সমস্যা— গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে অতিমারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়— জোগানশৃঙ্খলের কোনও একটা অংশকে এক বা একাধিক দেশে প্রভাবিত করে জোগানশৃঙ্খলের বৈশ্বিক আন্তর্জালকে বিঘ্নিত করতে পারে। কারণ, বহু দেশের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত থাকবার ফলে জোগানশৃঙ্খলগুলি সেই সব দেশের সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। সে কারণে নীতিনির্ধারকদের কাছে উৎপাদন ব্যবস্থাকে চালু রাখবার জন্য জোগানশৃঙ্খলের রেজ়িলিয়েন্স বা পুনরুত্থানের ক্ষমতা খুব জরুরি। সহজ ভাবে বললে, যে কোনও সমস্যা থেকে জোগানশৃঙ্খলগুলিকে আবার কর্মক্ষম অবস্থায় নিয়ে আসবার ব্যবস্থা হল এই রেজ়িলিয়েন্স। সমস্যাগুলি ভাল ভাবে বোঝা বা আগে থেকে আঁচ করে দরকারি পদক্ষেপ করা, উন্নত পরিকাঠামো এবং উপযুক্ত পরিচালন ব্যবস্থা তৈরি করা, সরকার ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি এই রেজ়িলিয়েন্সের বিভিন্ন কৌশল।

বিশ্বে প্রযুক্তিনিবিড় পণ্যের বাণিজ্য বহু গুণ বেড়েছে। পণ্য যত প্রযুক্তিনির্ভর হবে, ততই তার জোগানশৃঙ্খলের উপর বাহ্যিক সমস্যার প্রভাব বাড়বে। কারণ প্রযুক্তিনিবিড় পণ্যের উৎপাদন ও বাণিজ্য বিভিন্ন শর্তনির্ভর হয়। কিছু উন্নত দেশ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার ও স্বার্থের নামে এই ধরনের বিভিন্ন পণ্যকে ‘সংবেদনশীল তালিকা’ভুক্ত করছে। যেমন ওষুধ, উন্নত যন্ত্র, সামরিক খাতে ব্যবহৃত পণ্য, শিল্পক্ষেত্রে অতীব প্রয়োজনীয় রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস ইত্যাদি। পণ্য সংবেদনশীলতার তকমা পেলে তার জোগানশৃঙ্খল অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সঙ্কীর্ণ স্বার্থের প্রয়োগ অনেক সহজ হয়। রেজ়িলিয়েন্সের নতুন ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে কিছু প্রভাবশালী উন্নত দেশ তাদের পণ্যের জোগানশৃঙ্খলকে নির্দিষ্ট কিছু দেশের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলতে চাইছে।

তার দুটো পরিচিত পথ আছে। প্রথমটা হল ‘ফ্রেন্ড-শোরিং’, যেখানে শুধু রাজনৈতিক ভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গেই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এবং ‘সংবেদনশীল’ পণ্যের জোগানশৃঙ্খল তৈরি করা হয়। এটি বৈষম্যমূলক শুল্কব্যবস্থা, ভর্তুকি ও প্রবিধানের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয় পথটি হল ‘রি-শোরিং’— বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে বাধ্য করা, যাতে তারা নিজের দেশেই পণ্য উৎপাদনের বেশির ভাগ বা পুরো কাজটাই সারে। পন্থাটি স্পষ্টতই ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রবাদ’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাবটা এমন, যেন এই পদ্ধতিগুলির অনুসরণে জোগানশৃঙ্খলগুলি গুটিয়ে নিলেই সেগুলি সুরক্ষিত থাকবে, দেশের আর্থিক বিকাশ নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাবে, উন্নতির প্রতিযোগিতায় দেশটি সর্বদা সামনের সারিতে থাকবে, গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও প্রযুক্তি নিজেদের আওতায় থাকবে এবং কোনও সমস্যা হলে রেজ়িলিয়েন্স মসৃণ হবে।

অথচ, বিশ্ব বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা অনুসারে দেখা যায় যে, সরবরাহকারী দেশের সংখ্যা বাড়লে জোগানশৃঙ্খলের রেজ়িলিয়েন্স বাড়ে, দুর্বলতা কমে। উল্লিখিত দুটো পন্থাই আসলে রেজ়িলিয়েন্সকে আরও শক্তপোক্ত করবার অজুহাতে পণ্যের জোগানশৃঙ্খলগুলির উপরে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করার চেষ্টা। ফলে বিভিন্ন পণ্যের অধিকার ক্রমাগত নাগালের বাইরে যেতে থাকবে অন্য বহু দেশের। একই সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য মানচিত্রে ইতিমধ্যে প্রায় কোণঠাসা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈষম্যবিরোধী নীতিকে এড়িয়ে তাকে আরও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবার মোক্ষম ফিকির যেন এইগুলি। কিছু গবেষণা ইতিমধ্যেই জানাচ্ছে যে, এই সব পন্থার মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ মন্দা আসতে পারে।

রেজ়িলিয়েন্সকে যত সঙ্কীর্ণ ভাবধারার লেন্স দিয়ে দেখা হবে, ততই জোগানশৃঙ্খলগুলি ছোট হতে শুরু করবে, শাখাপ্রশাখা গুটিয়ে অববিশ্বায়নের দিকে পথ চলা শুরু হবে। বিশ্ববাণিজ্য বিশ্বায়নের উল্টো দিকে হেঁটে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার পরিপন্থী একটা অবস্থা তৈরি করবে, যা তাত্ত্বিক ভাবে অসম্ভব, ও গবেষণামূলক অভিজ্ঞতার পরিপন্থী। বিশ্বে প্রবল অসামঞ্জস্য তৈরি হতে থাকবে পণ্যের উৎপাদন, বাজারিকরণ বা বণ্টন ব্যবস্থার মধ্যে। নির্দিষ্ট কিছু উন্নত দেশ এবং জোগানশৃঙ্খলের ক্ষেত্রে কিছু প্রভাবশালী বাণিজ্যিক সংস্থা এই ধরনের অবস্থায় থেকে লাভের অংশ বাড়িয়ে নিতে পারবে।
ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। ফলস্বরূপ জাতীয় অর্থনীতিতে অস্থিরতার নিশ্চিত রাস্তা তৈরি হবে অধিকাংশ দেশে।

ভারতে বৃহদায়তন উৎপাদন প্রকল্পগুলির সাফল্য জোগানশৃঙ্খলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং উন্নত প্রযুক্তির উপর খুবই নির্ভরশীল। এমনকি চিনের সঙ্গে বাণিজ্য খাতে ঘাটতি ভয়ানক ভাবে বাড়ছে জেনেও আমদানি বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গত মাসে আমেরিকার ট্রেজ়ারি সেক্রেটরি জ্যানেট অ্যালেন অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ভারত আমেরিকার ফ্রেন্ড-শোরিং উদ্যোগের অপরিহার্য অংশীদার। দুই দেশের ক্রমাগত উষ্ণতর সম্পর্কের আবহে উক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন ওষুধ, উন্নত যন্ত্র ও প্রযুক্তি প্রভৃতির সুরক্ষিত জোগানশৃঙ্খল আমেরিকার সঙ্গে তৈরি করা ভারতের পক্ষে খুবই জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি ফ্রেন্ড-শোরিং, রি-শোরিং’এ সম্পূর্ণ নিমজ্জিত না হয়ে মুক্ত বাণিজ্যকে সম্মান জানিয়ে অন্যান্য দেশ বা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যবসায়িক আদানপ্রদান বজায় রাখা। না হলে ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বিশ্বায়নের পথে দশ পা এগিয়ে বিশ পা পিছিয়ে আসার সমান হবে। ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত অর্থব্যবস্থা করে তোলার উদ্যোগও বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। মনে রাখা ভাল, কূটনীতি বা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনও চিরস্থায়ী বন্ধু হয় না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy