—ফাইল চিত্র।
গত মাস দেড়েকে ঘটনার ঘনঘটা। প্যালেস্টাইনে হত্যালীলা চলছে। তাইওয়ান সীমান্তে চিনের সেনার গতিবিধি বেড়েছে বলে খবর। কানাডার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে। উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গে আটকে ছিলেন ৪১ জন শ্রমিক। দেশের মানুষের অবশ্য এই ক’দিন এ সবে নজর দেওয়ার ফুরসত ছিল না। তাঁরা বুঁদ হয়েছিলেন ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নে। ভারতীয় দল একের পর এক ম্যাচ জিতে যত ফাইনালের দিকে এগিয়েছে, উদ্দীপনার বেলুনও ফুলেফেঁপে বিপুল আকার নিয়েছে। উন্মত্ত সেই উত্তেজনার সঙ্গে কিছুটা সময়ের চাহিদা মেনেই সঙ্গী হয়েছে ঘৃণার চাষ।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই ঘৃণা-বিদ্বেষের সলতে পাকানো বর্তমান শাসক পক্ষ তাদের জমানার গোড়া থেকেই করছে। হিন্দুত্ববাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ইসলাম বিদ্বেষ ধুনো পাচ্ছে গত এক দশক ধরেই। তার জন্য সহজ লক্ষ্য পড়শি মুসলিম দেশ। সীমান্তে চিনের আগ্রাসনের থেকেও পাকিস্তানের টুঁ শব্দে তাই আসমুদ্র হিমাচল গর্জন ওঠে। পাকিস্তানের প্রতি ভারতের অসূয়া নতুন নয়। তবে দেড় দশক পিছিয়ে গেলে শত্রুতার মধ্যে কিছু সৌজন্যও খুঁজে পাওয়া যায়। অন্তত খেলার মাঠে।
এ বার বিশ্বকাপে ভারতে খেলতে এসেছিল ন’টি দেশ। বিশ্বকাপ শুরুর আগে সব দলের ক্রিকেটারেরা সময়মতো ভিসা পেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। ভারতে পৌঁছনোর অনুমতি পেতে দেরির কারণে তাঁদের বাতিল করে দিতে হয়েছে দুবাইয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি সেরে আসার পরিকল্পনা। দেরিতে ভিসা পেয়ে ক্রিকেটারেরা পৌঁছলেও, পাক সাংবাদিক ও দর্শকদের ভাগ্যে জুটেছে আরও টালবাহানা। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তাঁদের। আমাদের ক্রিকেটপ্রেমী দেশ অবশ্য তাতে কোনও দোষ দেখেনি। গর্জে ওঠেনি সমাজমাধ্যম।
হেয় করার সুযোগ পেয়ে অবশ্য সেই সমাজমাধ্যমই বেশ সরব। হায়দরাবাদে পাকিস্তানের ক্রিকেটারেরা কেমন বিরিয়ানিতে মজেছেন, সেই খবরে হাসির রোল উঠেছে। জনতা মজা করেছে, ‘বুভুক্ষু’ দেশ থেকে এসে ওঁরা এখানে হামলে পড়ে খাবেন, আশ্চর্য কী! যদিও অন্য দেশের ক্রিকেটারেরা কী খাচ্ছেন, সে খোঁজ জনতা রাখেনি। রাজনৈতিক টানাপড়েনকে কারণ দেখিয়ে কিছু দিন আগেই পাকিস্তানে এশিয়া কাপ খেলতে যেতে অস্বীকার করেছিল ভারত। মেনে নিয়েছিল নিয়ামক সংস্থা। আমদাবাদের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস মনে করিয়ে বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে ম্যাচ অন্যত্র সরানোর আর্জি জানিয়েছিল পাকিস্তান। তা অবশ্য গ্রাহ্য হয়নি। লক্ষাধিক দর্শকের উপস্থিতিতে, ক্রমাগত ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের আবহে সেখানে পাকিস্তানকে হারিয়ে উল্লাসে মেতেছেন দেশবাসী। তবে যেখানে নিজের দেশের মুসলমান ক্রিকেটারকে উত্ত্যক্ত করার জন্য কানের কাছে ‘জয় শ্রীরাম’ শোনানো হয়, সেখানে এসে বাবর আজ়ম-শাহিন আফ্রিদিরা পার পেয়ে যাবেন, এটা আশা করা হয়তো বাড়াবাড়ি।
ক্রিকেটের মাঠে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলে রাজনৈতিক সম্পর্কের ছায়া বরাবরই পড়ে। তবে চলতি বিশ্বকাপে পড়শি দেশের ক্রিকেটারদের ঘিরে সমাজমাধ্যমে যে ঘৃণার আবহ তৈরি হয়, ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও বিশ্বকাপে দুই দেশের দ্বৈরথ তার জন্ম দেয়নি। বরং, রাজনৈতিক সমস্যার বাইরে বেরিয়ে খেলোয়াড়দের প্রতি সম্মানের ছবিই আঁকা হয়েছে বার বার। ওয়াসিম আক্রম, ইনজ়ামামেরা যেমন বেশ কয়েক বার ভারত সফর উপভোগ করেছেন, তেমনই সচিন-সহবাগেরাও দীর্ঘ দিন পরে ২০০৪ সালে পাকিস্তানে গিয়ে উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছেন। এ বার বিশ্বকাপ চলাকালীন পাকিস্তানের প্রাক্তন তারকাদের অনেকেই ভারতের খেলার প্রশংসা করেছেন মুক্ত কণ্ঠে। বিরাট কোহলি, যশপ্রীত বুমরাদের ভাল ক্রিকেটের ব্যাখ্যা উঠে এসেছে আক্রম, ওয়াকার ইউনিসদের আলোচনায়। কিন্তু সে সব এড়িয়ে সমাজমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়েছে শুধু হাসন রাজ়ার কিছু তির্যক মন্তব্য। আমাদের ঘৃণা কেবলই ওঁদের পাল্টা— এই তত্ত্ব তাতে পোক্ত করা সুবিধা।
ভারত ও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের একাংশের মধ্যে সমাজমাধ্যমে বিদ্রুপের আদানপ্রদানও মাত্রা ছাড়ানোর পর্যায়ে পৌঁছেছে। তা হয়তো বিশ্ব জুড়ে চলা ধর্মীয় চরমপন্থারই ফল। ভারতের যে কোনও পদস্খলনে বাংলাদেশ জনতার একাংশের সাম্প্রতিক উল্লাস বেশ দৃষ্টিকটু। পাল্টা দিতে ছাড়েন না এ-পার বাংলার কিছু সমর্থকও। এই আকচাআকচির মাঝে পড়ে বিপক্ষ ব্যাটারকে ক্রিকেটের নিয়মের গণ্ডিতে থেকে আউট করেও সাকিব আল হাসনদের জোটে ‘অভদ্র’, ‘অসভ্য’ তকমা। পারদ চড়ে উল্টো দিকেও। ফাইনালে ভারতের হারে ও-পার বাংলায় দেখা যায় বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসের ছবি।
এই বিশ্বকাপ যদি এখন এ দেশে আয়োজন না হত, ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের সমর্থকদের ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, হয়তো এতটা টের পাওয়া যেত না। ফাইনালে হারের পরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারের পরিবারকে খুন-ধর্ষণের হুমকিও তার আর এক প্রমাণ।
দিনের শেষে কাপ নিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। আমাদের পড়ে রইল শুধু বিদ্বেষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy