অসমে প্রথম অ-কংগ্রেসি দল হিসেবে পর পর দু’বার জনতা ভবনে পা রাখল বিজেপি। রাজ্যে প্রাক্-নির্বাচনী আবহাওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত কোনও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ছিল না। ২০১৬-র ব্যর্থতার পর কংগ্রেস নিজেদের নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে, এমন কোনও ইঙ্গিতও কোথাও ছিল না। সে বার কংগ্রেস হেরেছিল হিমন্তবিশ্ব শর্মা (ছবিতে) ও হিন্দুত্বের জোড়া হানায়। এই দু’টি অস্ত্রকে কী ভাবে ভোঁতা করে দেওয়া যায়, সেই ভাবনা-চিন্তাও রাজীব ভবনে কেউ আর করেননি।
বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইটা হয় দুই ভাবে। মতাদর্শ এবং ব্যক্তি-আইকন, দুটোই দুই হাতে না থাকলে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রবল তোড় সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল মমতার মুখ এবং বাঙালিয়ানা দিয়ে মোদীমোহ ও আর্যাবর্তের হিন্দুত্ব রুখে দিল। কিন্তু অসমে হিমন্তবিশ্ব শর্মার প্রতিস্পর্ধী চেহারাই কংগ্রেস খুঁজে পেল না— মোদীকে সামলানো তো দূরের কথা! হিন্দুত্ব রোখার কোনও চেষ্টা না করে কংগ্রেস চাইল সহজ সমাধান। রাজ্যে পঁয়ত্রিশ শতাংশ মানুষ মুসলমান। রাজ্যের এগারোটি জেলায় তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় বিজেপি ও সঙ্ঘের মাথাব্যথা খুবই বেশি। কংগ্রেস এ বার সেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দল এআইইউডিএফ-র সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল। উদ্দেশ্য, বিনা পরিশ্রমে বাজিমাত। ২০১৬-য় ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোট আড়াআড়ি ভাগ হওয়ার ফলে তাদের দলের অভ্যন্তরীণ হিসেবে কংগ্রেস গোটা পঁচিশ আসনে বিজেপির কাছে হেরে যায়। তাই তারা চাইল, সরল পাটিগণিতে যেন এ বার জয় চলে আসে।
কিন্তু, এই সিদ্ধান্তে রাজ্যের ভোটের সম্পূর্ণ মেরুকরণ ঘটল। কংগ্রেসের আসন বাড়ল সাকুল্যে তিনটি। জোটের ফলে কম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে তুলনায় ভোটের ভাগও কমেছে এক শতাংশের বেশি। চার শতাংশের কাছাকাছি ভোট কমলেও বদরুদ্দিন আজমলের দলের আসনসংখ্যা তেরো থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ষোলো। বিগত পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গিয়েছে, রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে সংখ্যালঘুরা বিজেপি-বিরোধী শক্তি হিসেবে, আজমল নয়, বেছে নিয়েছিলেন কংগ্রেসকেই। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই হীনবল এইআইউডিএফ-কেই আঁকড়ে ধরে গলিপথে পৌঁছতে চাইল ক্ষমতার কুর্সিতে। লাভের লাভ কিছুই হল না, মাঝখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট আরও নিবিড় ভাবে বিজেপির ঝুলিতে ঢুকল।
ক্ষমতায় ফিরলেও ৩.৭ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি ছেড়ে দিলে বিজেপির যথা পূর্বং তথা পরম্ অবস্থাই হয়েছে। আসনসংখ্যা সেই গত বারের ষাটেই আটকে গিয়েছে। এ বারও কোনও অ-কংগ্রেসি দল অসমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ৬৪টি আসন একক ভাবে জোগাড় করতে পারল না। তবে মিত্রজোটের মোট আসনসংখ্যা কমেছে এগারোটি। ২০১৬-য় ছিল ছিয়াশি, এ বার তা পঁচাত্তর। তা হলে এই দফায় বিজেপির তেমন লাভ হল না?
উত্তরটা এত সরল নয়। অসমে ভোটের ফলাফলের উল্লেখযোগ্য দিকটি হল, রাজ্যের নির্বাচনী রাজনীতিতে আঞ্চলিক খণ্ডজাতীয়তাবাদের প্রভাব খুব দ্রুত কমছে। ২০১৬-য় যখন অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দল অসম গণ পরিষদকে জোটসঙ্গী করে বিজেপি প্রথম বারের মতো পূর্ব ভারতের কোনও রাজ্য দখল করল, তখনই সেই নির্বাচনী আঁতাঁত বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। এর মধ্যে মৌলিক প্রশ্নটি ছিল স্থায়িত্ব ও মতাদর্শগত সুস্থিতি নিয়ে।
আজ অগপ-র প্রাপ্ত আসন এক সংখ্যায় নেমে গিয়েছে। ভোটের ভাগ নেমে এসেছে আট শতাংশেরও নীচে। লোকসভা থেকে ২০১৯-এই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল দল। এ বারও যে নয়টি আসনে জয় এসেছে, তা মুখ্যত বিজেপি ভোটারের বদান্যতায়। অসমিয়া আত্মপরিচিতির জোরে ভাষা-নির্ভর জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ-বিরোধিতাকে আশ্রয় করে। একটি নয়, দু’টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছিল সিএএ-বিরোধী আন্দোলন থেকেই। কংগ্রেস দল হিসেবেও উজান অসমে লড়াই করার অক্সিজেন পেয়েছিল ওই সিএএ-বিরোধী অবস্থান থেকে।
অসমে সিএএ-বিরোধিতাকে দেশের বাকি অংশের আন্দোলনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের নানা প্রান্তে সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের মতাদর্শগত বুনিয়াদ ছিল সাম্য, ন্যায্যতা ও সাংবিধানিকতা। লক্ষণীয় যে, এই গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের চাপেই আজ অবধি কেন্দ্রীয় সরকার আইনটির পরিপূরক বিধি প্রণয়ন করা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু অসমে যে সিএএ-বিরোধিতা হয়েছে তার কারণ সাংবিধানিকতা নয়। আসু-র নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের বিকল্প দাবিতে ছিল, অসমকে এই আইনের আওতা থেকে বার করে আনতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দিতে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের কোনও আপত্তি নেই, শুধু এরা অসমে বসবাস না করলেই হল। তার মানে সেই স্থানীয়-বহিরাগত ঐতিহাসিক দ্বি-মাত্রিকতাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, আঞ্চলিক আবেগ-নির্ভর রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল— কোনওটাই অসমিয়া ভোটারদের কাছে কল্কে পায়নি। সিএসডিএস-লোকনীতি ভোট-পরবর্তী যে সমীক্ষা করেছে তাতেও স্পষ্ট, অসমে ৪৩ শতাংশ মানুষই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছিলেন। সরকারের কাজকর্মে নিট সন্তুষ্টির হারও গত পাঁচ বছরে পাল্টায়নি। অর্থাৎ, অসমিয়া জাতীয় আবেগের রাজনৈতিক পুনরুত্থানের পূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উজান অসমের মতো অসমিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলেও ওই দলগুলি জনসমর্থন পায়নি। বরং কংগ্রেসের ভোট কেটে বেশ ক’টি আসনে বিজেপিকেই এরা জয়ের সুবিধা করে দিয়েছে।
আসলে, ইতিহাসের নিয়মেই একটি বৃহৎ জাতীয়তাবাদ ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদকে গিলে খেয়েছে। ‘জয় আই অসম’ থেকে অনেক বেশি উঁচু তারে লুইতের দুই পারে ধ্বনিত হয়েছে ‘ভারতমাতা কি জয়’! রাজনৈতিক স্লোগানের এই পরিবর্তন শুধু প্রতীকী হয়ে থাকেনি। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের বেলায় অসমিয়া জাতীয়তাবাদের ‘নায়ক’কে হেলায় সরিয়ে যখন নির্বাচন-কুশলী হিমন্তকে বিজেপি নেতৃত্ব বরণ করে নিল, তখন বুঝতে আর বাকি থাকল না যে, আঞ্চলিকতাকে গিলে বড় হচ্ছে বিজেপির হিন্দুত্ব। অসমিয়া জাতীয়তাবাদের পোস্টার বয় হিসেবে ২০১৬-য় দরকার ছিল সর্বানন্দ সোনোয়ালকে। ২০০৫-এ সুপ্রিম কোর্টে বাঙালিদের নাগরিকত্বের রক্ষাকবচ আইএমডিটি আইন বাতিল করাতে পেরে তিনি তখন রাজ্যের নয়নের মণি। আসু-র সাবেক সভাপতি সেই সর্বানন্দকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে এবং অগপকে সঙ্গে করে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আসলে হিন্দুত্বের একটি স্থানীয় চেহারা দিতে সফল হয়েছিল। পাঁচ বছর পেরিয়ে এসে আজ ঘটনাস্রোত পুরো উল্টো খাতে বইছে। এখন আর অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে বিজেপির প্রয়োজন নেই। বরং হিন্দুত্বের ভরসায় টিমটিম করে টিকে আছে অসমের বহু-বিজ্ঞাপিত খণ্ডজাতীয়তাবাদ।
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy