বিচ্ছিন্ন: মধ্যপ্রদেশের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কমল নাথ ও অন্য নেতারা, ভোপাল, ৫ ডিসেম্বর। পিটিআই।
সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে এক মোক্ষম শিক্ষা দিলেন কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির কর্ণধার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শিক্ষাটি হল: দেশ কখনও স্থাণু হয়ে থাকে না এক বিন্দুতে, প্রতি পাঁচ বছরে পাল্টায় মানুষের আকাঙ্ক্ষার দিগন্ত, তাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ইচ্ছেমতো ফরমান জারি করে নির্বাচন জেতা অসম্ভব। হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটল মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণেই, দু’টি রাজ্যে দল ক্ষমতাসীন হওয়া সত্ত্বেও। দক্ষিণী রাজ্য তেলঙ্গানাতে অবশ্য কংগ্রেস জয়ী হয়েছে, যদিও ১১৯ সদস্যের বিধানসভায় তার আসনসংখ্যা প্রাক্তন শাসক দল ভারত রাষ্ট্র সমিতি ও বিজেপি, মিম-সহ অন্যান্য বিরোধী ও নির্দল সদস্যের সমবেত সংখ্যার চেয়ে মাত্র একটি আসন বেশি। সুতরাং, ‘অপারেশন লোটাস’ নামক বিধায়ক পাকড়ানোর খেলায় সিদ্ধহস্ত বিজেপি বেশি দিন হায়দরাবাদে চুপ করে বসে না-ও থাকতে পারে।
শত্রু হিসাবে বিজেপি যেমন ক্ষমাহীন তেমনই দুর্ধর্ষ, কিন্তু তাই বলে রাজনীতির প্রবীণ সেনানী কংগ্রেস যদি দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে, তবে নতুন নতুন প্রজন্মের ভোটদাতার বহমান স্রোত তো রয়ে যাবে তার অপরিচিত! বিজেপি পর পর দু’টি লোকসভায় একক সংখ্যাধিক্যের ফলে, এবং কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ীর সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক ‘অতি বন্ধুত্বসুলভ’ হওয়ার দরুন, দলটি এখন এতই সঙ্গতিসম্পন্ন যে, পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানারের প্রথাগত নির্বাচনী লড়াইয়ে তার সঙ্গে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য দলের পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তবে যে লড়াই অসমঞ্জস হয়েও সম্ভাব্যতার সীমানা অতিক্রম করে না, তা হল বিভিন্ন শ্রেণির ভোটদাতার মনের কথা পড়বার ক্ষমতা প্রদর্শনের। মোদী আবার প্রমাণ করলেন যে, তিনি এই বিদ্যাতেও অন্যদের চেয়ে বেশি পারদর্শী। বিরোধীরা এই ঘাটতিটি পূরণ করতে ব্যর্থ হলে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ব্যতীত আর কোনও জাতীয় দল গণ্য হবে কি না, তা সন্দেহের বিষয়। এবং তার ফলে একদলীয় ভারতে অবশ্যই সুগম হবে রাশিয়া বা আরবশাহির মতো একনায়কতন্ত্রের পথ।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজ়োরামেও নির্বাচন হয়েছে। তবে সেটি বর্তমান আলোচনায় না এনে বলা যায় যে, নভেম্বরের চারটি রাজ্যে নির্বাচন ছিল কংগ্রেসের জন্য প্রাক্-২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় তিন রাজ্যে কংগ্রেসের মধ্যে লক্ষিত হয়েছে কোথাও পরিকল্পনার অভাব, কোথাও অধ্যবসায়ের, কোথাও উভয়েরই। ২০১৮ ও ২০২৩, দুই নির্বাচনে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের আসন কমেছে ২৮২ থেকে ১৭০-এ— প্রায় ৪০ শতাংশ পতন। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ (যেখানে অভাব যুগপৎ পরিকল্পনা ও অধ্যবসায়ের) ছাড়া অন্য দু’টি রাজ্যে বিজেপির ভোট শতাংশ কিন্তু কংগ্রেসের তুলনায় আকাশচুম্বী নয়। রাজস্থানে সেই তফাত মাত্র ২.১৬ শতাংশ। অথচ কংগ্রেসের মোট ভোট যথেষ্ট হলেও তা ছড়িয়েছে সীমিত কিছু ক্ষেত্রে। তার মূল কারণ, প্রায় এক দশক কেন্দ্রে ক্ষমতাচ্যুত থেকে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্যগুলির নাড়ির যোগ এখন ক্ষীণ। ফলে রাজ্যস্তরে দল এখন রাজ্যপ্রধান বা মুখ্যমন্ত্রীর খেয়ালখুশির উপর নির্ভরশীল। যেমন— মধ্যপ্রদেশে।
২০১৮-র নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের জয়ের পর মুখ্যমন্ত্রী হন সঞ্জয় গান্ধীর দূন স্কুল সহপাঠী কমল নাথ, কিন্তু পনেরো মাসের মধ্যে সহ-নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ও বিজেপির চক্রান্তে তাঁর সরকার ভেঙে গেলেও কংগ্রেস তাঁকেই মেনে নেয় রাজ্য দলের সভাপতি পদে। কিন্তু এর পর থেকে তিনি চিন্তাধারায় শুরু করেন বিজেপির অনুসরণ। লোকসমক্ষে প্রচার করেন তাঁর হনুমানভক্তি, নির্বাচনী ক্ষেত্রে নির্মিত হয় ১০১ ফুট উঁচু শ্রীহনুমানের মূর্তি। ক্রমশ কমল নাথ ঘনিষ্ঠ হন বাগেশ্বর ধামের বিতর্কিত সাধু ধীরেন্দ্র শাস্ত্রীর সঙ্গে। শাস্ত্রী ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ সমর্থক। তিনি নাকি জাদুমন্ত্রে সিদ্ধ। তাঁকে নিয়ে প্রচারমাধ্যমে শোরগোল হয় যখন যুক্তিবাদীদের জাদু প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ থেকে তিনি সত্যজিৎ রায়ের মহাপুরুষ ছবির মতো চম্পট দেন।
কমল নাথ যে একাই ‘নরম হিন্দুত্ব’-এর প্রচারক, তা নয়। পার্শ্ববর্তী ছত্তীসগঢ়ের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল সরকারি অর্থে বানিয়েছেন ‘রাম বনগমন পথ’, নির্মাণ করেছেন ‘কৌশল্যা মাতা’র মন্দির। ভোট-পণ্ডিতরা মনে করেন, কংগ্রেসের এই হিন্দুত্ব সন্ধানের মূলে রয়েছে তার উপর বিজেপির চিরাচরিত ‘হিন্দুবিরোধী’ তকমা লাগানোর প্রথা। কিন্তু বিজেপির দীর্ঘপ্রতিষ্ঠিত ও আগ্রাসী হিন্দুত্বের পাশে কংগ্রেসের এই ‘নরম’ হিন্দুত্বের দৌড় কতটা? মধ্যপ্রদেশে এ বার বিজেপির ভোট কংগ্রেসের চেয়ে একেবারে ৮ শতাংশ বেশি। হিন্দুয়ানি দিয়ে নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে লড়াই দরকার ছিল।
অপর দিকে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসের অলিখিত ‘চিন্তানায়ক’ রাহুল গান্ধী শুরু করলেন ওবিসি সংরক্ষণের ও জাতিগণনার জন্য হইচই, কিন্তু তার কোনও অভিঘাত দেখা গেল না ফলাফলে। আসলে ‘মণ্ডল রাজনীতি’ চার দশকের বাসি গল্প। মোদী বুঝেছেন তার অসারত্ব। সম্প্রতি বলেছেন, তাঁর বিচারে চার জাতি হল গরিব, যুবা, নারী ও কৃষিকর্মী। এইটিই হল ‘মণ্ডল’ ও ‘কমণ্ডলু’ অতিক্রম করে নির্বাচনের পথে যাত্রা।
কংগ্রেস নেতারা তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে দিয়েছেন অনেক আর্থিক প্রতিশ্রুতি। বাঘেলের অধীনে রাজ্যে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ২,৬০০ টাকা, যা রাজ্যের সর্বোচ্চ। উৎপাদকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, জিতে ফিরে এলে এমএসপি লাফিয়ে পৌঁছবে ৩,৬০০-তে। মধ্যপ্রদেশে কমল নাথ ও বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের মধ্যে চলছিল আশ্বাসের নিলাম ডাক। শিবরাজের বিখ্যাত ‘লাডলি বহেনা যোজনা’র (ল-ব-জ) জন্য— কন্যা ২১ বছরে পৌঁছে অবিবাহিতা রইলে সরকারি মাসোহারা— এক হাজার টাকা ধার্য হতেই কমল নাথ হাঁকেন ১,৫০০। শিবরাজ বাধ্য হন ১,২৫০ দিতে, এবং জানাতে যে ল-ব-জ বাড়তে থাকবে ৩,০০০ পর্যন্ত। তা সত্ত্বেও রাজ্যের ৮০ শতাংশ নারী-ভোটার পদ্মে ছাপ দিয়েছেন, এই সত্য প্রমাণ করে যে, জালে পড়া একটি মাছ নদীর লক্ষাধিক মাছের চেয়ে বেশি মূল্যবান। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় অনুকম্পা ব্যতীত যে প্রিয় ভগিনী বা ভ্রাতাদের জন্য সাহায্যের ফোয়ারা চলে না সে কথা বোঝে সকলেই। এই বছরের প্রথম দশ মাসে শিবরাজ সরকারের ল-ব-জ খাতে ব্যয় ১১,০০০ কোটি টাকা।
দরিদ্রকে একটি শ্রেণি বলে মনে করেন সব নেতাই, ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু সময়ের সঙ্গে চারিত্রিক পরিবর্তন হয় দরিদ্রের। ইন্দিরা ভেবেছিলেন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ফলে তৈরি হবে জীবিকা; হল কিন্তু ব্যাঙ্ক লুট ও অসম্ভব আর্থিক ঘাটতি। তবু বহু দশক ধরে কংগ্রেস শোনায় একটিই কথা: কৃষকের ঋণ মকুব। ২০০৪ থেকে সনিয়া গান্ধীর প্রযত্নে এল একশো দিন কাজের বিনিময়ে টাকার প্রকল্প। কিন্তু তাতে তো কপিরাইট নেই, দু’বেলা মহাত্মা গান্ধীকে গাল পাড়লেও দশ বছর ধরে তাঁর নামাঙ্কিত প্রকল্পটি মোদী ব্যবহার করে চলেছেন। দরিদ্র শ্রেণি যে হেলছে মোদীর দিকে, তার প্রমাণ দেশের আকাঙ্ক্ষা-বশবর্তী (অ্যাসপিরেশনাল) জেলাগুলির নির্বাচনী বাস্তবে। মোট ১১২টি এমন জেলার মধ্যে ২৬টিই আলোচ্য চার রাজ্যের। এদের মোট বিধানসভা ক্ষেত্র ৮১, যার মধ্যে বিজেপি জিতেছে ৫২টি। ২০১৮-র নির্বাচনে সংখ্যাটি ছিল ২৩।
এ কথা পরিষ্কার যে বিজেপির আয়ত্তে দল ও সরকারের মিশ্রিত যে বিশাল সাম্রাজ্য, অসংখ্য শ্রেণির আস্থা অর্জন করে তা ধরে রাখতে দক্ষ। তার জন্য জরুরি ‘ন্যারেটিভ’ হল হিন্দু জাতীয়তাবাদের। হয়তো পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে দীক্ষিত অল্প কিছু দেশবাসীর কাছে তা ক্ষুদ্রচিত্ততার পরিচায়ক। কিন্তু বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ঢের। কোথাও প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ দেখলেই প্রতিবাদী বিনা বিচারে কারারুদ্ধ হচ্ছেন। রাহুল গান্ধী বলে বেড়াচ্ছেন শিল্পপতি আদানির সঙ্গে মোদীর ‘সখ্য’ সম্পর্কে, অথচ তাঁর দলের দুই মুখ্যমন্ত্রী ‘মউ’ সই করেই চলেছেন আদানির সঙ্গে। বিরোধী রাজ্যে মোদী ও তাঁর দোসর অমিত শাহ পাঠাচ্ছেন এমন সব রাজ্যপাল, যাঁরা রাজ্য বিধানসভা থেকে পাঠানো বিলে কিচ্ছুটি না করে বসে থাকেন মাসের পর মাস। আদালত বেগতিক দেখলে যুগ পার করে দেয় শুনানির জন্য। সবই এখন যেন শুধু বিরোধী পক্ষের কয়েক জন আইনজীবীর মাথাব্যথা, বা বড় জোর রাহুল গান্ধীর।
মোদীকে ২০২৪ সালে উৎখাত করা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় পৃথিবী ধূলিমুক্ত করতে সমগ্র ধরাতল চর্মাচ্ছাদিত করার মতো। অস্তিত্ব বজায় রাখতে এখন ১৩৮ বছরের দলের চাই আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে জুতা আবিষ্কার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy