Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
সাদা সাদা নীলা নীলা, পশ্চিমবঙ্গের পথে পথে রং ছড়ানো
Politics

এই আজব ‘পথ-সন্ত্রাস’

মেট্রো স্টেশনের নাম বদলে বা পথনিরাপত্তার রং বদলে কোনও অর্থনৈতিক লাভ লোকসানের ব্যাপার নেই, ফলে বিরোধীরা উৎসাহ পাচ্ছেন না।

রঙের গুরুত্ব পৌঁছে গিয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে।

রঙের গুরুত্ব পৌঁছে গিয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে। ফাইল চিত্র।

মোহিত রায়
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:২৭
Share: Save:

সম্প্রতি একটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হাওয়া কলকাতায় বেশ ঝড় তুলে গেল কয়েক দিন। সেই ঝড়ে যে গানটি অনেককেই আলোড়িত করল, সেই সহজিয়া গানটির প্রথম কলি দু’টি হল, সাদা সাদা কালা কালা/ রং জমেছে সাদা কালা। এই সহজ কথাটা গুনগুন করেছে আশপাশে। এক মাছধরা নৌকার সমুদ্রে জালে ধরা পড়ে এক আশ্চর্য নারী, আর তার পর দর্শক পৌঁছে যান এক রূপকথার রাজ্যে। সেই নাবিকেরা গান গায়, সাদা সাদা কালা কালা। কলকাতার পথের কিছু মানুষ কোনও আধিভৌতিক জগতে পৌঁছে গেলে তাঁরা গান গাইবেন, সাদা সাদা নীলা নীলা। কারণ, নীল সাদায় রঙিন পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় পথ দুর্ঘটনা তাঁদের পৌঁছে দিয়েছে সেই জগতে। সবিস্তারে বলি।

আমরা সবাই রঙিন পৃথিবী ভালবাসি, নিজেদের বাড়িঘর থেকে নিজের মুখ রং করি আরও সুন্দর হতে। কিন্তু রঙের প্রাথমিক কাজ বস্তুর সুরক্ষা। বিশ্বের প্রথম নৌকাটি, মহাপ্লাবনের আদমের নৌকাটি কালো রং করা হয়েছিল নৌকার কাঠের সুরক্ষার জন্য। এখনও নৌকা সেই আলকাতরায় কৃষ্ণ বর্ণ হয়ে জলে ভাসে। আমাদের বিশাল রং শিল্পের কাজ বিভিন্ন বস্তুকে রঙের আবরণে ঢেকে তাকে আবহাওয়ার আক্রমণ, বিভিন্ন অণুজীবের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। তা হতে পারে সেতু, রেলের কামরা, জলের ট্যাঙ্ক, বাড়ির দেওয়াল থেকে কাঠের রকমারি জিনিস, আমাদের বস্ত্র। রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রং করে তোলে রঙিন সুন্দর পৃথিবী।

রঙের প্রতি ভালবাসা, কখনও শ্রদ্ধা রংকে দিয়েছে অন্য স্তরের মর্যাদা, গুরুত্ব। শ্বেত হয়েছে শান্তির প্রতীক, গেরুয়া হয়েছে ত্যাগের প্রতীক, কৃষ্ণ বর্ণ শোকের প্রতীক, সবুজ তারুণ্যের প্রতীক। রঙের এই গুরুত্ব পৌঁছে গিয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে। লাল, সবুজ, নীল, গেরুয়া, কালো, হরেক রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে কোনও বিশেষ রঙের প্রাধান্য বৃদ্ধিও স্বাভাবিক বলেই গৃহীত হয়। কিন্তু তবু এই প্রাধান্যকে কোথাও থামতে হয়।

সুরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রং দিয়েছে সাবধানতার বার্তা। যেমন লাল হচ্ছে বিপদ, কমলা হচ্ছে কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা, হলুদ হচ্ছে সামান্য দুর্ঘটনার সম্ভাবনা, সবুজ হচ্ছে নিরাপদ। এই বার্তা এখন হয়েছে বিশ্বজনীন। যেমন আমাদের অতি পরিচিত ট্র্যাফিক লাইট। রাস্তায় ট্র্যাফিক আলো লাল মানে চলাচল নিষেধ, কমলা মানে চলার জন্য প্রস্তুতি এবং সবুজ অর্থ চলাচলে বাধা নেই। অবুদ্ধিজীবী মানুষজন, যাঁরা কলে-কারখানায় কাজ করেন বা কর্মসূত্রে যাতায়াত করেন, তাঁদের জেনে রাখতে হয় কারখানার কোন পাইপের রঙের অর্থ কী। জলের পাইপ হবে ঘন সবুজ, বাষ্পের পাইপ হবে অ্যালুমিনিয়াম রং, অ্যাসিডের পাইপ হবে গাঢ় বেগুনি, হাওয়ার পাইপ হবে আকাশি নীল। এ সবই নিরাপত্তার কারণে প্রয়োজনীয়, এবং আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। এ রকম বিভিন্ন ক্ষেত্রে রং ব্যবহারের বিশেষ নির্দেশ রয়েছে— পথের ধারে বা রাস্তার উপরে রং করার ক্ষেত্রেও।

আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, এই রঙের নির্দেশ সাধারণত বিশ্বজনীন (দেশ অনুযায়ী কিছু ব্যতিক্রম থাকে) এবং আমাদের ক্ষেত্রে এই সব রঙের নির্দেশ ভারতীয় নিয়ম অনুযায়ী সারা দেশেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ, চিনে বিপ্লব ঘটে গেলে ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলো নীল হয়ে যায় না। ইটালিতে বছর বছর প্রধানমন্ত্রী বা সরকার পাল্টালেও ট্র্যাফিক লাইট থেকে কারখানার পাইপের রং অপরিবর্তিত থাকে। ভারতেও বামপন্থী কেরল বা হিন্দুত্ববাদী গুজরাতে ভারতীয় আইন অনুযায়ী ট্র্যাফিক লাইট বা কারখানায় রঙের ব্যবহার একই রকম। সরকার পরিবর্তন হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে। আপনি যদি সারা দেশ ঘুরে পশ্চিমবঙ্গে আসেন, দেখবেন এখানে বিভিন্ন সরকারি বাড়ির নীল-সাদা রঙের সঙ্গে পথের পাশে করা রংও নীল-সাদা যা সারা দেশে কোথাও নেই। আপনি পথের পাশে বিরাট বোর্ডে লেখা ও লোগো দেখবেন, বিশ্ব বাংলা। আপনি বিশ্ব বাংলায় এসেছেন। তাতে বিশ্বের ছবি আছে, ভারতের উল্লেখ নেই। কিন্তু বিশ্বের কোথাও পথের এমন রং পাবেন না। আপনি এসেছেন আজব দেশ বহির্বিশ্ব বাংলায়।

ট্র্যাফিক লাইট, কলকারখানার কথা বলেছি। এখনও বলিনি, পথের সতর্কতার জন্য রঙের ব্যবহারের কথা। এই রঙের নিয়মকানুন ঠিক করে ভারত সরকার গঠিত ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস। এই সংস্থার কোড অব প্র্যাকটিস ফর রোড মার্কিং-এ জানানো আছে এই সব নিয়ম কানুনের কথা। যে কমিটি এই সংশোধিত নিয়ম করেছে, তার শীর্ষে ছিলেন ভারতীয় পথ-গবেষণা কেন্দ্রের (ইন্ডিয়ান রোড রিসার্চ ইনস্টিটিউট) তৎকালীন পরিচালক শুভময় গঙ্গোপাধ্যায়।

এই দলিলের শুরুতেই বলা আছে যে, এই রং করার নিয়ম পথ নিরাপত্তা ও সঠিক যান চলাচলের জন্য অপরিহার্য। আরও মনে রাখতে হবে যে, এই রং নির্বাচন করা হয়েছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, যা গাড়ির চালক ও পথচারীদের সতর্ক করতে সবচেয়ে ভাল সাহায্য করবে। এই দলিলের ২.৬ ধারাটি পথ চিহ্নিতকরণের জন্য রং-সংক্রান্ত। এর প্রথমেই ২.৬.১-এ ভাল দৃশ্যমানতা ও বৈপরীত্যের জন্য পথের কালো রঙের বিপরীতে সাদা রং ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। ২.৬.২-এ বলা হয়েছে বিশেষ বিশেষ স্থানে হলুদ রং ব্যবহারের কথা। ২.৬.৩-এ বলা হয়েছে, প্রচলিত নয় কেবলমাত্র সেই রকম বিশেষ ক্ষেত্রেই নীল রং ব্যবহার করা যেতে পারে। ২.৬.৪-এ সাইকেল ও মোটরচালিত নয় এমন বাহনের পথের জন্য সবুজ ও ২.৬.৫-এ বিপজ্জনক স্থানের জন্য লাল রং ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। এর ৩.৮.২ ধারায় বলা হয়েছে যে, কংক্রিটের রঙের সঙ্গে তীব্র বৈপরীত্য আনতে হলুদ রং ব্যবহার করতে হবে। কংক্রিটের রাস্তার ধার ও ফুটপাতের অংশ এই ভাবেই রং করতে হবে। ১৪.৩.৫ ধারায় বলা আছে ও ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে, রাস্তার ধার সাদা-কালো রং করতে হবে। ১৪.৩.৬-এ বলা আছে সেতু, উড়ালপুলের রাস্তার পাশে সাদা-কালো রং করতে হবে। অর্থাৎ, এক কথায় পথের ধারে ও বিশেষ স্থানে একমাত্র সাদা, কালো ও হলুদ রংই থাকবে।

তা হলে নীল এল কোথা থেকে? বরং বলা যাক কবে থেকে— তাতেই উত্তরটা সহজেই পাওয়া যাবে। ২০১১-র মে মাসে তৃণমূল কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতা দখলের পরেই এই নীল-সাদার প্রাদুর্ভাব। সরকারি বাড়ির রং নীল-সাদা হল, তা নিয়ে কিছু বলার নেই, যার বাড়ি তার পছন্দই শেষ কথা।

কিন্তু সেই রং গড়িয়ে নামল পথে। রাজপথ থেকে গলি, পথিপার্শ্বের বিভিন্ন গঠনে কেবলই নীল-সাদা। পথনিরাপত্তাকে একেবারে চুলোয় পাঠিয়ে করা হল এই নীল-সাদা রং। নীল-সাদা তৃণমূলের প্রতীক না তার নেত্রীর প্রতীক, সে বিশ্লেষণ অপ্রয়োজনীয়, এর একটাই উদ্দেশ্য, ক্ষমতার বেলাগাম প্রকাশ। আর তার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা প্রত্যহ হাজার হাজার মানুষ ও বাহন। আইনকে বছরের পর বছর উপেক্ষা করে কী ভাবে এই ‘পথ-সন্ত্রাস’ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা এক বিস্ময়।

আরও বিস্ময় যে, পথের এই রং করার আইনি দায়িত্বে আছে মহানগরের ও অন্যান্য স্তরের পুলিশবিভাগ। তারা কি ভাবেনি যে, রাজনৈতিক আদেশ মানতে গিয়ে তারা আইনভঙ্গের বাইরেও এত মানুষজনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে? বিস্ময় বিরোধী দলগুলির ভূমিকাতেও। তারাও নীরব। প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বের কাছে বিষয়টি অনেক বার অবহিত করা হয়েছে, বিরোধী আইনজীবীদের এ নিয়ে জনস্বার্থ মামলার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও সাড়া মেলেনি। মনে হয়, মেট্রো স্টেশনের নাম বদলে বা পথনিরাপত্তার রং বদলে কোনও অর্থনৈতিক লাভ লোকসানের ব্যাপার নেই, ফলে বিরোধীরা উৎসাহ পাচ্ছেন না।

অবশ্য মানুষের জীবনের দাম ধরা হচ্ছে না, রাজনৈতিক মৃত্যু ছাড়া অন্য মৃত্যু এখন এ রাজ্যে মূল্যহীন। রাজ্যে এখন সুশাসনের জন্য আদালতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো এই আলোচনা কোনও বিচারপতির চোখে পড়লে আদালত একটি স্বতঃপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত নিয়ে পথ ব্যবহারকারীদের নিশ্চিন্ত করবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy