Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
জোটের রাজনীতি উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে
Politics

চাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা

১৯৮৯ সালে রাজীব সরকারের পতনের পর শুরু হয় ‘কোয়ালিশন’ বা পাঁচমিশালি সরকারের অধ্যায়।

—প্রতীকী ছবি।

স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৬
Share: Save:

সব রাজনৈতিক দলই এখন ভোটের মুখে ঘর গোছাতে ব্যস্ত। ঘর অর্থাৎ ‘জোট’ এবং জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আসন সমঝোতা, নিৰ্বাচন কৌশল নির্ধারণ এখন তুঙ্গে। স্বাধীন ভারতে জোট-রাজনীতির ইতিহাস তুলনায় নতুন। স্বাধীনতার পর ভারতে শুরুর দিকে কেন্দ্রে প্রধানত কংগ্রেস সরকার ছিল এবং তা ছিল মোটের উপর স্থায়ী। সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৭-এ গঠিত হয় প্রথম অকংগ্রেসি সরকার, মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা দলের সরকার। কিন্তু, সে সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তন, ইন্দিরা-হত্যার পর ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর বিপুল জয়— মোট ৪১৪টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। এর পর আর কোনও নির্বাচনে কোনও দল একক ভাবে তো নয়ই, জোটবদ্ধ ভাবেও এত আসন পায়নি।

১৯৮৯ সালে রাজীব সরকারের পতনের পর শুরু হয় ‘কোয়ালিশন’ বা পাঁচমিশালি সরকারের অধ্যায়। ১৯৯১ সালে তৈরি হল চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও তার থেকে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট। নরসিংহ রাও সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক উদারীকরণ ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না, যা এখন ইতিহাস। ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ভারত প্রধানত জোট সরকার পেয়েছে, কোনও রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, ফলে প্রায় সব সরকারই ছিল কিছুটা নড়বড়ে। ২০১৪ সালে প্রথম নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ২৮২টি আসন পেয়ে একক দল হিসাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, ও প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ভারত আবার একটি পোক্ত স্থায়ী সরকার পায়।

বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থায়িত্ব খুব জরুরি। একটি দেশের প্রগতির জন্য সময়বিশেষে সরকারকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্বভাবতই এই সিদ্ধান্তগুলি সবাইকে খুশি করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত একটি বড় জনগোষ্ঠীর কাছেও অপ্রিয় হতে পারে, বা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে অপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা হতে পারে। ধরা যাক, ভারতের কোনও অংশে মাটির নীচে কয়লার সন্ধান পাওয়া গেল, এবং সরকার সেখানে একটি কয়লা খনি গঠনের প্রস্তাব দিল। এতে দেশে কয়লার উৎপাদন বাড়বে ও একই সঙ্গে সেই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। আবার অন্য দিকে, কিছু স্থানীয় মানুষকে হয়তো অন্যত্র সরে যেতে হতে পারে। তাই কোনও নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই আছে। যদি ইতিবাচক দিক বেশি থাকে, তা হলে সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। সমস্যা হল, সমস্ত নতুন পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের দেশে রাজনীতি হয়। যেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসে, বিরোধী দল তার বিরোধিতা করে। কারণ, বিরোধী দল সব সময় শঙ্কিত যে, যদি মানুষ এই প্রকল্পে উপকৃত হয়, তা হলে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা বাড়বে আর তাদের নিজেদের জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে। অগত্যা জনগণকে ভুল বোঝাও। বোঝাও যে, আসলে এতে তোমাদের ক্ষতি হবে। ক্ষমতাসীন দল এখন যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা তারা ভবিষ্যতে রাখবে না, তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দিয়ো না। আর জনগণকে ভুল বুঝিয়ে খেপিয়ে তোলা খুব কঠিন কিছু নয়। সব সময় এক জন সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনও প্রকল্পের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাল-মন্দ বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না, এবং রাজনৈতিক দলগুলি সেই সীমাবদ্ধতার অপব্যবহার করে পূর্ণমাত্রায়।

জোট সরকারে এই জাতীয় সমস্যার সম্ভাবনা প্রবলতর। কোনও জোটসঙ্গী যদি অন্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তা হলে তারাই এই প্রকল্পে বাগড়া দিতে পারে, সমর্থন তুলে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে। সব সময় যে তারা নিরাপত্তাহীনতা থেকে এটা করে তা নয়, আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও সমস্যা হতে পারে— যেমন ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকারে কংগ্রেস ও বামেদের মতপার্থক্য হয়েছিল ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তি নিয়ে।

বিরোধী পক্ষের বিরোধিতার একটি উদাহরণ হালের কৃষি বিল। বর্তমান সরকার ভারতের কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকীকরণের জন্য ২০২০ সালে যে বিলটি সংসদে পাশ করায়, সেটির অনেক সদর্থক দিক ছিল। কোনও বিলই একশো শতাংশ ভাল বা খারাপ হয় না— সবেরই কিছু ভাল এবং খারাপ দিক থাকে। যেটুকু ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল, তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত। কিন্তু বিরোধীপক্ষ এই বিলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করা শ্রেয় মনে করে। কৃষকদের ভুল বোঝানো হল, বিপুল আন্দোলন হল, এবং প্রবলস্থায়ী দ্বিতীয় মোদী সরকারও এই বিল ফেরত নিতে বাধ্য হল কিছু রাজ্যের নির্বাচনের কথা ভেবে। তাই অতি স্থায়ী সরকারও সমস্যায় পড়তে পারে— জোট সরকারের কাজ তো আরও কঠিন। তাও কোনও একক দল যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তার পক্ষে কঠিন কিছু পদক্ষেপ, যা দেশের পক্ষে হিতকর, হয়তো করা সম্ভব।

ভারতীয় অর্থনীতি এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বর্তমানে ভারতের জিডিপি বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ৩.৭৫ লক্ষ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা ভারতকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। গড় জাতীয় আয়ের নিরিখে আমরা ২৭০০ ডলারের কাছাকাছি, যা আমাদের এখনও নিম্নমধ্যবিত্ত অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যেই ফেলে। যদি সম্ভব হয়, তা হলে আগামী পাঁচ বছর বার্ষিক ৭-৮ শতাংশ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অর্জন করে ২০২৯ সাল নাগাদ সাত লক্ষ কোটি ডলার আয়তনের অর্থনীতি হয়ে ওঠার, এবং মাথাপিছু আয় ৪৫০০ ডলারের বেশির স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। সে ক্ষেত্রে ভারত উচ্চমধ্যবিত্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তার জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। পরিকাঠামো উন্নয়নের একটি বড় অংশ হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি। ভারতীয় রেলের পরিকাঠামোগত উন্নতিসাধন ও পণ্যপরিবাহী করিডর তৈরি আবশ্যিক। এর জন্য যদি জমি অধিগ্রহণের সমস্যা থাকে, সেই বিষয়ে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনে রুগ্‌ণ সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ, ব্যাঙ্ক ও বিমা শিল্পের এবং অবশ্যই কৃষি ক্ষেত্রের আরও আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। এগুলি করতে গেলে কিছু সমস্যা, বাধা ও প্রতিবন্ধকতা আসবেই— কোনও রকম পরিবর্তন মেনে নিতেই আমাদের অসুবিধা হয়। যদিও অবশেষে সবার লাভই হবে, কিন্তু এখন অনেকে তা উপলব্ধি করবেন না। বিরোধী দল বিরোধিতা করবেই, চেষ্টা করবে সরকারকে অপদস্থ করতে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, বা আসনসংখ্যা তারও বেশি হয়, তা হলে তারা সরকার বাঁচানোর ভয় না করে এই কাজগুলি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিজের গোষ্ঠীর কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না।

বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রথম ৩৭০ ধারা রদ, যে প্রতিশ্রুতি পূরণের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত, তার সাংবিধানিক বৈধতাও শীর্ষ আদালতে প্রমাণিত। রামমন্দির নির্মাণও সম্পূর্ণ হয়েছে। তৃতীয় প্রতিশ্রুতিটি হল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, যা হয়তো অনতিবিলম্বে চালু হয়ে যাবে। সংখ্যালঘু মহিলাদের একটা বড় অংশ এই বিধির পক্ষে, অন্তত বেশ কিছু সমীক্ষা এ রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

রয়েছে একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও— ভারতকে একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করা। এই প্রতিশ্রুতি পূরণের কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু এখনও অনেক পথ চলা বাকি। তাই যে দলই আসুক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসুক। আমাদের বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়েছে জোটের অভিশাপে। এই দিক থেকে যেন আমরা আর পিছিয়ে না পড়ি, অন্তত আগামী পাঁচ বছর।

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy