কৃতিত্ব: ইসরোর বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-৩’এর সফল ‘সফট ল্যান্ডিং’ দেখছেন, বেঙ্গালুরু, অগস্ট ২৩। পিটিআই ছবি: পিটিআই।
ছবিগুলো মনে পড়ছিল। চন্দ্রযান-২’এর অবতরণে ব্যর্থতার পর ইসরোর অধিকর্তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, চন্দ্রযান-৩’এর উৎক্ষেপণের পর টুইট করছেন, বিক্রমের
অবতরণের সময় পর্দার অর্ধেকটা জুড়ে পতাকা নাড়ছেন। দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল; কারণটা খুব তাড়াতাড়িই বোঝা গেল। বিক্রম চাঁদের বুকে তার যান্ত্রিক পা রাখল আর সগর্বে প্রচার শুরু হয়ে গেল এই সাফল্য ওঁর জন্যই এল; চন্দ্রযান-২’এর ব্যর্থতার পর বিজ্ঞানীরা নাকি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, ওঁর উৎসাহেই আবার চন্দ্রাভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়, ইত্যাদি। অবিলম্বেই বিক্রমের অবতরণ-বিন্দুর নাম হয়ে গেল ‘শিবশক্তি’ (যাঁরা ইস্কুলে সরস্বতী পুজো আর অফিসে বিশ্বকর্মা পুজোর বিরোধিতা করেন, তাঁদের নাকে ঝামা ঘষতে আর কিছু বাকি থাকল না)। পথে-ঘাটে আমাদের সহনাগরিকরা উৎসাহভরে বলতে লাগলেন চন্দ্রযান তো মোদীর আমলেই হল, তাই আমাদের (পরের ভোটেও) মোদীকেই চাই! বুঝলাম এই ভাবেই ‘গোয়েবলস ল’ মেনে হাজার বার শুনতে শুনতে মিথ্যে কথাগুলো চোখের সামনেই সত্যি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
মিথ্যে কথাকে গোড়ায় বিনাশ করতে হয়। তাই পরিষ্কার জানিয়ে রাখা ভাল যে বিজ্ঞানের গবেষণার সঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। একটি গবেষণা প্রকল্প কোনও সরকারের আমলে বাস্তবায়িত হলেই সেটা সেই সরকারের কৃতিত্ব (বা সম্পত্তি) হয়ে যায় না, চন্দ্রযান তো নয়ই। কারণ চন্দ্রাভিযান— ঠিক কুড়ি বছর আগে (২০০৩) বাজপেয়ী সরকারের প্রস্তাবিত প্রকল্প, যা চন্দ্রযান ১, ২ হয়ে ৩-এ এসে তার উদ্দেশ্য সম্পন্ন করেছে। ২০০৮ সালে (মনমোহন সিংহের আমলে) প্রথম চন্দ্রযান-১’এর সফল উৎক্ষেপণ হয়; এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তথ্য সংগ্রহের কাজের পরে এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চাঁদের মাটি ছোঁয়া (হার্ড ল্যান্ডিং) ছাড়াও চাঁদে জলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিল এর কৃতিত্ব। এর পরে চন্দ্রযান আবার ২০১৯ সালে (আংশিক সফল) খবরে এলেও এর মধ্যে ভারতের মহাকাশ গবেষণা থেমে থাকেনি; এর মধ্যে অজস্র উপগ্রহ এবং একটি মঙ্গলযান (২০১৩) মহাকাশে গেছে, বেশির ভাগই সফল হয়েছে।
তবে এই সবও সম্ভব হয়েছে কারণ স্বাধীনতার প্রথম কুড়ি-পঁচিশ বছর পর থেকেই সরকারি ভাবে মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার যথার্থতা নিয়ে নানা প্রশ্নও উঠেছিল তখন। দেশের যাবতীয় সাফল্যের পরই প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট কর্মী-গবেষকদের শুভেচ্ছা-অভিনন্দন জানান; কিন্তু এই ভাবে কোনও উপগ্রহ বা মহাকাশযানের সাফল্যকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব বলে দাবি করার মূর্খামি আগে কখনও দেখা যায়নি।
বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে কোন খাতে কতটা অনুদান দেওয়া হবে, সরকার শুধু সেটাই ঠিক করে। সরকারের উৎসাহ মানে অধিক অনুদান। তাই বিজেপির মুখপাত্র থেকে ইসরোর চেয়ারম্যান যে যা-ই বলুন না কেন কোনও প্রকল্পের সাফল্য বা ব্যর্থতা মৌখিক উৎসাহ, প্রার্থনা কোনও কিছুর উপরেই নির্ভর করে না। আর কোনও অভিযান সফল না হলে বিজ্ঞানীরা দুঃখ পেতে পারেন, হতাশ হতে পারেন, কিন্তু হাল ছেড়ে দিতেই পারেন না। তাই আজ সরকারে অন্য কেউ থাকলেও চন্দ্রযান সফল হতই। তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানীদের ‘ব্যর্থতা’য় রেগে গিয়ে মহাকাশ গবেষণার অনুদান বন্ধ করে দেননি বলে ওঁকে ধন্যবাদ দিতে চাইলে দেওয়া যায় বটে!
নেহাত কথার কথা বলছি না। চন্দ্রযানের সাফল্যের পাশাপাশি দেশের মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় সামগ্রিক অনুদানের অভাবের কথা তুললে (আবাপ, ২-৯) যে সব প্রশ্ন উঠছে তা এই রকম: ১) চন্দ্রযানের সাফল্যে কিছু লোকের প্রবল হিংসা হয়েছে; তারাই উল্টোপাল্টা সমালোচনা করছে ২) মৌলিক গবেষণায় সরকার অনেক টাকা দিয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের কাজ, মানুষের কাজে লাগার মতো কাজ কিছু হয়নি ৩) চন্দ্রযান আসলে প্রযুক্তিবিদদের সাফল্য, বিজ্ঞানীদের নয়, তাই বিজ্ঞান গবেষণায় টাকা ঢেলে কী লাভ! ৪) সরকার যদি গবেষণার জন্য টাকা দেয় তা হলে কী কাজ হবে তাও ঠিক করে দিতে পারে ইত্যাদি।
কোনও রাজনৈতিক দলকে আপাদমস্তক সমর্থন করতে গেলে নিজের বিচারবুদ্ধি যে পুরোটাই বিসর্জন দিতে হয় সে কথা জানাই ছিল। আন্দাজ করি মানুষের মুখে মুখে এই সব কথাও সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু গোয়েবলস-এর নিয়ম তো মৌলিক বিজ্ঞান নয়, তাই তাকে ‘ভবিতব্য’ বলে চুপচাপ মেনে না নিয়ে চাঁদের আলোয় ঢাকা পড়ে যাওয়া সত্যিগুলো বরং সূর্যের আলোয় প্রকাশ করার চেষ্টা করা যাক!
প্রথম কথা, চন্দ্রযান ভারতের সাফল্য, ভারতের সম্পদ— প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপির নয়। তাই যাঁরা ঈর্ষান্বিত হওয়ার কথা বলছেন তাঁদের শুধু এই কথাটুকু মনে করানো দরকার যে, নিজের সাফল্যে কারও হিংসা হয় না।
তবে গবেষণায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে যে সব প্রশ্ন, তার উত্তর আরও গভীরে। মনে রাখতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণা দেশের উন্নতির একটি মৌলিক উপাদান, সংবিধান স্বীকৃত অধিকারও বলা যায়। কোনও সরকার ইচ্ছে করলেই মানবসম্পদ উন্নয়নের সেই উপাদান থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করতে পারে না। খুব ভাল করে বুঝতে (ও বোঝাতে) হবে যে, কোনও অনুদানই সরকারের দয়ার দান নয়— আর সরকারের অবস্থানও ঠিক পরীক্ষকের মতো নয় যে গবেষণার ‘প্রোগ্রেস রিপোর্ট’ দেখে পছন্দ না হলেই টাকা বন্ধ করে দেবে। বরং সরকারের কাজ কিছুটা অভিভাবকের মতো যিনি গবেষণায় যথেষ্ট উন্নতি না দেখতে পেলে বুঝতে চেষ্টা করবেন এর কারণটা কী! এটা প্রমাণিত যে ভারতীয়রা বাইরের দেশে উন্নত পরিকাঠামোর সুযোগ পেলে খুব ভাল মানের গবেষণা করতে পারেন। তাই অনুদান বন্ধ নয়, বরং প্রয়োজনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে যাতে দেশেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা হয়। কিন্তু আজকের ভারতে গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বেশি হওয়ার মানে দেশের গবেষণার ক্ষেত্র ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে পড়া, যা অসীম দুর্ভাগ্যের।
এ ছাড়াও দুটো কথা আছে। প্রথমত, চন্দ্রযান চোখের উপর (মানে পর্দায়) দেখা গেছে বলে সেটাই বিজ্ঞান, আর সেটাই মানুষের ‘কাজে লাগার জিনিস’, আর সারা দেশ জুড়ে চব্বিশ ঘণ্টা ছোটবড় যে বিজ্ঞানী-গবেষকরা বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, যে তথ্য ও জ্ঞানভান্ডার রোজ একটু একটু করে ভরে উঠছে তা কোনও কাজের নয়, এই ধারণা নিঃসন্দেহে ভুল। যে কোনও বড় আবিষ্কার এক জন বা দু’জনের নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও তার পিছনে বহু মানুষের দীর্ঘ দিনের কাজের চালচিত্র থাকে। সরাসরি কাজে লাগার মতো আবিষ্কারও এক দিনে হয় না, প্রথমে তার তত্ত্ব আবিষ্কার হয়, তার পর অনেক রকম গবেষণার মধ্যে দিয়ে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ পাওয়া যায়। সে ভাবে দেখতে গেলে চন্দ্রযানও তো এখনই ‘কাজে লাগার মতো’ ব্যাপার নয়, কিন্তু তাই বলে কি যাব না আমরা চাঁদে!
দ্বিতীয়ত, চন্দ্রযান বস্তুটি যে-হেতু একটি যন্ত্র, তাই অনেকেই একে শুধু ‘প্রযুক্তির সাফল্য’ বলে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু কোনও প্রযুক্তিই বিজ্ঞানের তত্ত্বের বাইরে নয়, বরং যত জটিল প্রযুক্তি— তাকে তত্ত্ব নিয়ে তত বেশি ভাবতে হয়। যাঁরা শুধু কাজে লাগার জিনিস বানান বলে আমরা মনে করি, সেই প্রযুক্তি-বিজ্ঞানীরাও কিন্তু জার্নালে ‘তাত্ত্বিক’ গবেষণাপত্র ছাপেন। দু’টি নাম উল্লেখ করা যায়। কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজ, আদতে তিনি ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ‘লুকাসিয়ান’ অধ্যাপক। এবং আধুনিক বিজ্ঞানের জনক ‘তত্ত্ব-সম্রাট’ স্যর আইজ়াক নিউটন; আলোর বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন প্রতিফলক টেলিস্কোপ। এর পরও কি আমাদের তাত্ত্বিক বিজ্ঞান না প্রায়োগিক বিজ্ঞান, এই নিয়ে ভেদাভেদ করা উচিত?
তবে চন্দ্রলোক-সূর্যলোকে অভিযান যতই সফল হোক, আর তার গৌরবে ‘অভিভাবক’রা যতই ভাগ বসান না কেন, আগামী অর্থবর্ষে ইসরোর অনুদান কিন্তু ৮% কমেছে (১৩৭০০ কোটি থেকে ১২৫০০ কোটি)। চন্দ্রযানের সাফল্যের সঙ্গে সেটা যে একটা ছবি বানাবার চেয়েও কম টাকায় (৬১৫ কোটি) সেরে ফেলা গেছে, এই কথাটাও গর্বের বিষয় হিসাবে উঠে আসছে। এ দিকে যে কোম্পানিতে যন্ত্রাংশগুলো তৈরি হয়েছে তাদের পাওনা যে মেটানো হয়নি, সে তথ্যও সামনে।
প্রদীপের নীচে অন্ধকার বিস্তীর্ণতর হয়ে উঠছে। ভয় হচ্ছে মহাকাশ গবেষণা যে ছবি বানাবার চেয়েও সস্তায় করা যায়, এই তত্ত্বটা না প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়! স্বল্প মূল্যে কিছু করে ফেলাটা কৃতিত্ব হতে পারে— কিন্তু স্বল্প মূল্যে ‘করিয়ে নেওয়াটা’ যে ‘শোষণ’, সেটাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy