গম বণিক ও পাইকারি বিক্রেতাদের ক্ষেত্রে মজুতের ঊর্ধ্বসীমা ৩০০০ মেট্রিক টন। —ফাইল চিত্র।
গত মাসে কেন্দ্রীয় সরকার গম মজুতের উপর ঊর্ধ্বসীমা আরোপ করল, ১৫ বছরে এই প্রথম বার। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হল, সার্বিক খাদ্যসুরক্ষা বজায় রাখতে, বেলাগাম মজুতদারি ঠেকাতে এবং খাদ্যশস্যের বাজারে ফাটকা মুনাফা অর্জনের প্রবণতা রুখতেই এই সিদ্ধান্ত। দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সব গম বণিক, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরো বিক্রেতা, খুচরো বিক্রয়ের চেন এবং গম প্রক্রিয়াকারক সব প্রতিষ্ঠানের উপরই এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে ২০২৪-এর ৩১ মার্চ অবধি। গম বণিক ও পাইকারি বিক্রেতাদের ক্ষেত্রে মজুতের ঊর্ধ্বসীমা ৩০০০ মেট্রিক টন, খুচরো ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ১০ মেট্রিক টন। দেশ জুড়ে বহু খুচরো বিক্রয়ের বিপণি রয়েছে, এমন চেনগুলি বিপণিপিছু সর্বাধিক ১০ মেট্রিক টন, এবং মোট ৩০০০ মেট্রিক টন গম মজুত করতে পারবে। কী পরিমাণ গম মজুত আছে, তা প্রতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ডিপার্টমেন্ট অব ফুড অ্যান্ড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন-এর হুইট স্টক মনিটরিং সেন্টারকে জানাতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, খুচরো বাজারে গমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ভান্ডার থেকে মোট ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন গম ই-নিলামের মাধ্যমে দেশের বাজারে ছাড়া হবে। গমকলের মালিক, বেসরকারি গম বণিক, গমজাত পণ্যে উৎপাদনকারীরা এই গম কিনতে পারবেন। গত ২৩ জুন কেন্দ্রীয় সরকার ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়াকে এই ই-নিলাম ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছে, নিলাম শুরু হবে ৫ জুলাই। এই নিলামে সর্বোচ্চ একশো মেট্রিক টন গম কেনা যেতে পারে। খুচরো ব্যবসায়ীরাও যাতে কিনতে পারেন, তাই সর্বনিম্ন পরিমাণ স্থির করা হয়েছে ১০ মেট্রিক টন। দাম স্থির হয়েছে কুইন্টাল-প্রতি ২১৫০ টাকা— যে সপ্তাহে সিদ্ধান্তটি হল, তখন পাইকারি বাজারে গমের যা দাম ছিল, তার চেয়ে অন্তত পনেরো শতাংশ কম।
গমের দাম নিয়ন্ত্রণে এই তৎপরতা দেখে আশ্চর্য লাগতে পারে। কারণ, গম উৎপাদনে ঘাটতি ঘটায় জোগানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এমন কোনও ইঙ্গিত কেন্দ্রীয় সরকার দেয়নি। বরং ফেব্রুয়ারি মাসে উৎপাদনের দ্বিতীয় অগ্রিম পূর্বাভাসে জানিয়েছিল যে, প্রধান রবি শস্যের উৎপাদন হবে রেকর্ড পরিমাণ, ১১২১.৮ লক্ষ মেট্রিক টন। মে মাসে তৃতীয় অগ্রিম পূর্বাভাসে এই অঙ্কটি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১২৭.৪ লক্ষ মেট্রিক টনে। এই পূর্বাভাসগুলি থেকে স্পষ্ট যে, ২০২২-২৩ সালে গমের উৎপাদন গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ার কথা। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে গমের উৎপাদনের পরিমাণ কমেছিল, কাজেই পরের অর্থবর্ষে তা বৃদ্ধির সংবাদটি ইতিবাচক। রবি শস্যের কেনাবেচার বাজার খোলার পরও গমের উৎপাদন সম্বন্ধে ইতিবাচক মনোভাব ছিল। সরকারি পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছিল যে, মোট সরকারি খরিদের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩৪২ লক্ষ মেট্রিক টন, আগের অর্থবর্ষে খরিদের পরিমাণের কার্যত দ্বিগুণ। মে মাসের ৯ তারিখ অবধি সব ঠিকঠাক চলছিল— সরকারি খরিদের পরিমাণ তত দিনে ২৫২ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে, আগের বছরের মোট খরিদের চেয়ে ৭৫ লক্ষ মেট্রিক টন বেশি।
মে মাসের মাঝামাঝি প্রথম বিপদঘণ্টা বাজল। এফসিআই-এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, এর পর থেকেই সরকারি খরিদ কমতে আরম্ভ করল— মাসের শেষে দেখা গেল, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সংস্থাগুলির মোট খরিদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬২ লক্ষ মেট্রিক টন। স্বভাবত জুনের শেষ অবধি সরকারি খরিদ চলে। এ বার দেখা যাচ্ছে, মে মাস শেষ হওয়ার আগেই সে পালা ফুরিয়েছে। মনে হচ্ছে, ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ৩৪২ লক্ষ মেট্রিক টনের ২৫ শতাংশ কমেই সরকারি খরিদ শেষ হল। গত বছর গমের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সরকারি খরিদের পরিমাণ কমেছিল। তার আগের পাঁচ বছরে রবি খরিদ মরসুমে গমের সরকারি খরিদের গড় পরিমাণ ছিল ৩৬৬ লক্ষ মেট্রিক টন। এ বছরের খরিদের পরিমাণ তার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কম। ২০২১-২২ সালে রবি খরিদ মরসুমে মোট সরকারি খরিদের পরিমাণ ছিল ৪৩৩.৪ লক্ষ মেট্রিক টন, মোট উৎপাদনের পরিমাণ যদিও এ বছরের প্রত্যাশিত উৎপাদনের চেয়ে ঢের কম ছিল। এ বছর কেন উৎপাদন ও সরকারি খরিদের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য থাকল না, সে বিষয়ে এখনও কোনও সরকারি ব্যাখ্যা মেলেনি, তবে ঠিক কী ঘটেছে, সে বিষয়ে কিছু অনুমান করা যেতে পারে।
যদিও এ বারের গম উৎপাদন বিষয়ে সরকার আশাবাদী ছিল, কিন্তু সে আশায় আক্ষরিক অর্থেই জল ঢেলে দিয়েছে প্রকৃতি। যে সব অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে গম উৎপাদন হয়, এ বছর মার্চ-এপ্রিলে সেই সব অঞ্চলে অসময়ের বৃষ্টি হল, ফলে গমের উৎপাদন মার খেল। এই ঘটনাটির কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় সরকার এ বার সরকারি খরিদের ক্ষেত্রে গমের গুণগত মানের বিষয়ে শর্ত শিথিল করেছিল, বিশেষত বর্ষার ফলে গমের উপরিভাগের চকচকে ভাব কম থাকার ক্ষেত্রে। গত বছরের মতোই, এ বারও এফসিআই-এর গুদামে যে গম উঠেছে, তা গুণগত মানে খাটো— অন্য দিকে, বেসরকারি বণিকরা এবং মিল মালিকরা বাজার থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে উন্নত গুণমানের গম কিনেছেন। গমজাত পণ্য উৎপাদক শিল্পক্ষেত্র এ বার সরাসরি বাজার থেকে গম কেনার সিদ্ধান্ত করেছে আরও একটি কারণে— ‘ওপেন মার্কেট অপারেশনস’-এর মাধ্যমে বাজারে যথেষ্ট গম জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষমতা বিষয়ে শিল্পমহলের সংশয় রয়েছে। এই সংশয়ের পিছনে একটা বড় কারণ কেন্দ্রীয় ভান্ডারে মজুত থাকা গমের পরিমাণ তলানিতে নেমে যাওয়া। এ বছর এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ভান্ডারে মজুত ছিল মাত্র ৮৩.৫ লক্ষ মেট্রিক টন গম, ২০০৮ সালের পর সর্বনিম্ন পরিমাণ। প্রসঙ্গত, সে বছরই শেষ বারের মতো গম মজুতের ঊর্ধ্বসীমা আরোপ করা হয়েছিল। জুন মাসে কেন্দ্রীয় ভান্ডারে মজুত থাকা গমের পরিমাণ ২১৪ লক্ষ মেট্রিক টন— ২০২২ সালের জুন মাসে মজুত থাকা ৩১১ লক্ষ মেট্রিক টনের চেয়ে সামান্য বেশি। গত বছর জুনে গম মজুতের পরিমাণ ছিল ২০০৮ সালের পর সর্বনিম্ন।
বেসরকারি বণিকরা এবং গম শিল্পের ব্যবসায়ীরা এ বছরের রবি খরিদ মরসুমে গম কিনতে এত বেশি তৎপর ছিলেন কেন, সেই কারণটি পাওয়া যেতে পারে তাঁদের একটি অনুমানে— সরকার যা-ই বলুক না কেন, এ বছর আসলে ভারতে গমের উৎপাদন কমেছে। তা দাঁড়িয়েছে ২০২১-২২ অর্থবর্ষের উৎপাদনের পরিমাণের চেয়েও কম। রোলার ফ্লাওয়ার মিলার্স ফেডারেশন-এর মত হল, তৃতীয় অগ্রিম পূর্বাভাসে সরকার গমের যে পরিমাণ উৎপাদনের কথা বলেছিল, প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ তার চেয়ে অন্তত দশ শতাংশ কম। বাজারে এখন যে দরে যে পরিমাণ গমের খরিদ চলছে, তাতে মনে হয় যে, সরকারি হিসাবের তুলনায় গম ব্যবসায়ীদের হিসাবটিই বাস্তবের বেশি কাছাকাছি।
গমের বাজারের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, সামনের কিছু মাসে গমের জোগানে ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, মূল্যস্ফীতির হার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সহনীয় সীমায় ফেরার আগেই খাদ্যপণ্যের বাজারদর তার উপর আবার ঊর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি করবে। গমের বাজারের অবস্থা দেখাই যাচ্ছে, বর্ষার চলন ধানের বাজার নিয়েও সংশয় তৈরি করছে। খাদ্যশস্যের বাজারে যাতে মজুতদারি ও ফাটকার প্রবণতা তৈরি না হয়, তার জন্য সরকার মজুতের ঊর্ধ্বসীমা আরোপ করেছে বটে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নাও হতে পারে। প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন প্রয়োগ করে ফাটকাবাজির প্রবণতা ঠেকাতে হবে, তার জন্য সরকারের তৈরি থাকা ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy