—প্রতীকী ছবি।
ভারতের জনগণের এক বিপুল অংশের কাছে হিন্দুত্ববাদ, এবং সংবিধানের ভাবাদর্শকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শাসক বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা যতখানি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তার বিরোধিতা করার পাশাপাশি একটা প্রশ্ন করা প্রয়োজন— এ রকম হল কেন?
নেহরু-যুগের একটি অপরিহার্য চিন্তাসূত্র ছিল এই যে, আর্থিক প্রগতি ঘটলে সাধারণ মানুষ ধর্ম, জাতপাত বা প্রাদেশিকতার সঙ্কীর্ণ বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে। ঘটনা হল, ভাত-কাপড়ের জোগাড় করাই যখন সমস্যা, তখন অনেক মানুষ সেই দুঃখ-কষ্টে বিভেদ ভুলে গিয়ে এক সূত্রে গ্রথিত হন। দুঃখ-কষ্ট মানুষকে এক সঙ্গে সংগ্রাম করতে শেখায়, এটা নতুন কথা নয়— বামপন্থী শ্রেণিসংগ্রামের মূল কথাই এটা। সমস্যা হল, তেমন মুহূর্তে জাতপাতের ভেদাভেদ, ধর্মের অতিরিক্ত প্রদর্শনমূলক আচার-ব্যবহার ইত্যাদি পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসে, কিন্তু সমূলে কখনওই বিতাড়িত হয় না।
যখন মানুষ সাচ্ছল্যের মুখ দেখে, তখন সংগ্রামী অস্তিত্ব ধাক্কা খায়। আর্থিক প্রগতি তাকে দান-ধ্যানে প্রবৃত্ত করে না, স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। ফলে বাক্সবন্দি অনেক অমানবিক, অবৈজ্ঞানিক প্রত্যয় মানুষের চিন্তাভাবনার পরিসরে জায়গা করে নেয়, নিয়েছেও। কিন্তু, ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রে যে কথাটি সত্য, একটা গোটা দেশের ক্ষেত্রেও কি তা-ই সত্য হতে পারে? ১৯৯১-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের হাত ধরে ভারতে সর্ব স্তরেই খানিকটা সাচ্ছল্য এসেছে, অন্তত চরমতম দরিদ্রদের ক্ষেত্রটি ছাড়া। তা হলে দেশের জনসংখ্যার একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এমন ভাবে বিদ্বেষের রাজনীতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন কেন?
শুধু আর্থিক প্রগতিই সব নির্ধারণ করে না। রাষ্ট্র যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি, যার কথা তেমন ভাবে বৌদ্ধিক মহলে আলোচিত হয়নি, যার মধ্যে উদারমনা পণ্ডিতেরা হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য দেখেছেন, মেধাবী মানুষ যাকে উপেক্ষা করেছেন এবং এখনকার আর তখনকার ভারতের যা সম্পর্কে অনীহা একই রকম— অথচ, যার মধ্যে নিহিত ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পহীন এক সমাজের বীজ— তা হল, প্রাইমারি স্তরে হিন্দুস্থানি মার্গ সঙ্গীতের প্রসার ও প্রচার। দু’টি ধর্মের মানুষ কী ভাবে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে অবিশ্বাস্য স্তরের শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে পারেন, যেখানে বহু ধরনের চাপিয়ে দেওয়া দুর্বৃত্ত অনুশাসন লুপ্ত হয়ে যায়, তার এক অমোঘ উদাহরণ হিন্দুস্থানি মার্গ সঙ্গীত। উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক শাহেনশা এক বার বলেছিলেন যে, ছোট থেকেই বাচ্চাদের আবশ্যিক ভাবে মার্গ সঙ্গীত শেখালে হয়তো হিন্দু-মুসলমানে ভেদাভেদ অনেক কম হত। এত বড় সত্যি কথা নিয়ে তেমন কোনও উৎসাহ এ দেশটাতে দেখিনি। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব বা বিসমিল্লা খাঁ সাহেবের জীবনগাথা অবশ্যপাঠ্য হতে পারত। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনাকে এ দেশের রাজনীতির কারিগররা ব্যবহার করলেন না। যে দেশটায় এক কালে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের কার্য ছাড়া রাজনীতি চলত না, তখনও হেলদোল দেখা যায়নি। অর্থাৎ আর্থিক প্রগতির হাত ধরে কৌম শিক্ষার একটা জায়গা তৈরি হতে হয়, আর রাষ্ট্রের সে দায়িত্ব পালন করা উচিত। সেটা এ দেশে কখনও ঘটেনি।
সফল রাজনীতির কাছে অন্তত আমাদের দেশের প্রসঙ্গে আর্থিক প্রগতি বা মানুষকে আরও সচ্ছল করার প্রতিশ্রুতি এবং তার খানিকটা পালন করা আবশ্যিক স্ট্র্যাটেজি— তা না হলে দীর্ঘ কাল ক্ষমতায় থাকা শক্ত। অন্য দিকে, প্রগতি ছাড়াও এত দিন ভাবা হত সংবিধান মেনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানই ভোট জয়ের মূল লক্ষ্য হবে। কিন্তু ‘আমার ধর্ম মহান’ কিংবা অন্য ধর্মের শাসনের পরাধীনতার স্মৃতি, আত্মত্যাগের গাথা, এক ধরনের অপমান ও জাতক্রোধ পুষে রাখা— এই সব মিলিয়ে ওই বাক্সবন্দি সমস্যা বা ছাইচাপা আগুন কোনও দিন প্রমাণিত হয়নি। যে সব জায়গায় হিন্দুত্বের গরিমা কিংবা পদদলিত গরিমার ইতিহাস উজ্জ্বল, সে সব জায়গায় ভোটারগণ যা বিশ্বাস করেন তা যত অবৈজ্ঞানিকই হোক না কেন, তাকে লালন করা আসলে রাজনীতির মানুষদের কোটি টাকার স্ট্র্যাটেজি। কোনও ভুল ভাঙানোর প্রয়োজন নেই। ভুলকে সত্যি হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন বিখ্যাত রাজনৈতিক দল তার নেতা-নেত্রীগণ। আমার বিশ্বাস যে আসলে মানুষ যেটা সত্যি ভাবেন সেটাকেই সম্মান জানাচ্ছেন। ফলে আরও সঙ্ঘবদ্ধ সংখ্যাগুরু। তাঁরা বিপদে আছেন, এই বিশ্বাসটিকে বাঁচিয়ে রাখা রাজনীতির কারবারিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থিক প্রগতি হলেই সচ্ছলদের জীবনধারণের রসদ সংগ্রহের জন্য সম্মিলিত দাবি এবং সংগ্রামের প্রবণতা কমবে। অন্য কোনও মন্ত্রে গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার অবকাশ বাড়বে, এই সত্যিকারের অপূর্ব বিচিত্র এক দেশে আঞ্চলিক ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তন নতুন গোষ্ঠী গঠনের প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। এই দেশটাতে যদি সত্যি মানবিক উন্নয়ন এক অভূতপূর্ব স্তরে পৌঁছত, তা হলে হয়তো অন্য ধরনের উন্নত মানসিকতার সমঝোতার সৃষ্টি হত। সেটা হয়নি। তাই নিজেদের অস্তিত্বের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়ে যদি দেখি, তা হলে যে আঞ্চলিক সংঘাত সুপ্ত ছিল, সেটাই বেরিয়ে আসছে।
সম্প্রতি রাজস্থানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। জয়সলমিরের মরুভূমি ভ্রমণের সময় একটি রাতে ক্যাম্পফায়ার সম্বলিত আসরে বেশ উচ্চমধ্যবিত্ত, বাহ্যিক ভাবে সফল পেশাদার মানুষজন একটি গানের সঙ্গে নাচছিলেন। গানটি আগেও শুনেছি— রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে গোটা হিন্দি বলয়ে খুব জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: ‘এর পর ভারতের প্রতিটি ঘরে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রামনাম করবে’। কারও কিন্তু এক বারও মনে হল না যে, সেই সময় ওখানে যে কর্মচারীরা আমাদের পরিষেবা দিচ্ছিলেন, তাঁরা সবাই অন্য ধর্মের মানুষ বা কম বয়সের ছেলে।
আর কিছু দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি ভিডিয়োতে দেখতে পেলাম মহাত্মা গান্ধীকে যারপরনাই তিরস্কার করা হচ্ছে— ‘রঘুপতি রাঘব’ গানটিতে তিনি ‘ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম, সবকো সম্মতি দে ভগবান’ কথাটি যোগ করে পুরনো ধর্মটিকে অপমান করেছেন।
আর্থিক প্রগতি ভারতকে যে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যেতে পারেনি, এই দুটো ঘটনায় তা আমার কাছে আরও একটু পরিষ্কার হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy