২৭ মার্চ, ১ এপ্রিল ও ৬ এপ্রিল। তিন দফায় অসমে ১২৬ আসনবিশিষ্ট বিধানসভার ভোটগ্রহণ। একে সামনে রেখে সি-ভোটার চারটি সমীক্ষা করেছে। ১৮ জানুয়ারি তাদের অনুমান ছিল, বিরোধীরা যদি প্রকৃতই জোট বাঁধে তারা ৪১-৪৯টি আসন পেতে পারে। বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ-র ঝুলিতে যাবে ৭৩-৮১টি আসন। কংগ্রেস-এআইইউডিএফ-বামদলগুলি মিলে মহাজোট গড়তেই পরবর্তী সমীক্ষায় (২৭ ফেব্রুয়ারি) দেখা যায়, এরা ৪৭-৫৫টি আসন পাবে। এনডিএ পাবে ৬৮-৭৬। ৮ মার্চের সমীক্ষায় বিরোধী জোটের আসন আরও বেড়ে ৫৭-তে পৌঁছয়। বিজেপি-অগপ-ইউপিপিএলের ঘরে থাকে ৬৭টি আসন। শেষ সমীক্ষাটি হয় ১৫ মার্চ। তাতে দেখা যায়, কংগ্রেস জোট ৬০-এও পৌঁছতে পারে। এনডিএ-র একেবারে ম্যাজিক ফিগারে (৬৪-৭২) আটকে যাওয়া বিচিত্র নয়।
কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট বাঁধায় দুই মাসে অসমের নির্বাচনী রাজনীতিতে অন্য মেরু তৈরি হয়ে গেল। জানুয়ারিতে মনে হচ্ছিল, বিরোধীদের দুর্বলতার দরুন অসমে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ নেই। আর এখন ভাসমান ভোটাররা ভাবছেন, এনডিএ জিততে পারবে তো! আমার ভোটটা নষ্ট হবে না তো!
পাঁচ বছর নির্বিঘ্নে সরকার চালানোর পরও, কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল? রাস্তাঘাট যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। আগের মতো বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা-যাওয়া নেই। প্রচুর ভূমিহীন মানুষকে জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে। সর্বানন্দ সোনোয়ালের সরকার বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে সফল হয়েছে। তার পরেও বিজেপিকে এই অবস্থায় থাকতে হচ্ছে একমাত্র তাদের অতিচালাকির কারণে। এনআরসি নিয়ে অদ্ভুত অবস্থান নিয়েছে তারা। ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে বিশাল তথ্যভান্ডার তৈরি করার পর এখন বলা হচ্ছে, আমরা এই এনআরসি মানি না।
তুমুল প্রতিবাদের মধ্যে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানে আইন (সিএএ) করা হল। তার পরে তাদের বোধোদয় হয়, অসমিয়াদের একটু বেশি খেপানো হয়ে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেল সিএএ-র বিধি প্রণয়ন। বিষয়টিকে হিন্দু বাঙালিরা ভাল মনে মেনে নিতে পারেননি। এর উপর তড়িঘড়ি অসম চুক্তির ছয় নম্বর ধারাকে টেনে তোলা হল। গঠিত হল উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রী বলে দিলেন, ওই কমিটির পরামর্শ সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হবে। কমিটি সুপারিশ করল, অসমিয়ার সংজ্ঞা নির্ধারণে ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হোক। ওই অসমিয়াদের জন্যই জমি-সম্পত্তির অধিকার, ১০০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ হোক। রাজ্যে ইনার-লাইন পারমিট চালু করারও সুপারিশ করেছে কমিটি। এই সব রূপায়ণ করতে গেলে যে আর এক বিপদ। ফলে দিসপুর থেকে কমিটির রিপোর্ট কেন্দ্রে পৌঁছোলই না। অসমিয়ারা একে প্রতারণা হিসেবে ধরে নিলেন।
২০১৮-র ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২৬ হাজার ৭৮৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি একক ভাবে ১১ হাজার ৩২৫টি আসন পেয়েছিল। পরের বছর লোকসভার নির্বাচনেও বিজেপি ১৪টিতে ৯টি আসন জেতে। অসমিয়া হিন্দুরা হয়তো যতটা না অসমিয়া, তার চেয়ে বেশি হিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপি সরকারের নীতির দোদুল্যমানতা তাদের আবার অসমিয়া বানিয়ে দিয়েছে। সিএএ দিয়ে হিন্দু বাঙালির মন টেনে নিলাম, ছয় নম্বরের কথা বলে হিন্দু অসমিয়ার মন টেনে নিলাম, আর মুসলমান তো আমাদের নয়— অতিসরলীকৃত ত্রিধারা ফর্মুলা এই ভাবে কাজ করে না। এগুলি করে রাজনৈতিক ভাবে নিজের জায়গাটাকে বিজেপি বড্ড নড়বড়ে করে দিয়েছে। তারাই অখিল গগৈ, লুরিনজ্যোতি গগৈ-এর হাতে আঞ্চলিকতাবাদের অস্ত্র তুলে দিয়েছে। লুরিনের অসম জাতীয় পরিষদ এবং কারাবন্দি অখিলের রাইজর দল জোট বেঁধেছে। তবে এও ঠিক, আসন জেতার মতো অবস্থাতেও হয়তো নেই এই জোট। কারণ, তাঁদের নীতি-আদর্শ-কর্মপন্থা কিছুই স্পষ্ট নয়। তবে লুরিন-অখিল যে ভোট পাবেন, তা বিজেপির ভোটবাক্স থেকে কাটা পড়বে।
দ্বিতীয়ত, প্রার্থী-চয়নেও ভুল করছে বিজেপি। একক ভাবে ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে যাওয়াটা যেন ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেশ কিছু নিশ্চিত জেতা আসনে তারা ‘কলাগাছ’ দাঁড় করিয়েছে। শরিকদের অবস্থাও ভাল নয়। বড়োল্যান্ড অঞ্চলে ইউপিপিএলের চেয়ে পুরনো মিত্র বিপিএফেরই শক্তি বেশি— কিছু দিন আগেই প্রমাণিত হয়েছে। আর অগপকে বিজেপি এমন গ্রাস করেছে যে তাদের কাছে আঞ্চলিকতাবাদ বলে কিছু অবশিষ্ট নেই।
তা হলে কি কংগ্রেস খুব ভাল জায়গায় চলে এসেছে? তাও নয়। বরং কংগ্রেস হয়তো আশু লাভের কথা ভেবে নিজেদের পায়েই কুড়ুল মারল। মুসলমানদের কাছে কোনও বিকল্প নেই বলে এঁরা অসমিয়া কি বাঙালি, মহাজোটের প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। হিন্দুদের কাছে বিষয়টি অন্য, তাঁরা কিন্তু সহজে তালাচাবিতে বোতাম টিপতে চাইবেন না। তাঁরা লুরিন-অখিলের প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন, কিংবা নতুন দলকে দিয়ে ভোট না দিয়ে পদ্মচিহ্নেই বোতাম টিপতে পারেন। কংগ্রেসি মুসলিমরা নানা চাপ সহ্য করেই এআইইউডিএফ থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু এ বার তালা-চাবিতে ভোট দিলে তাঁরা একে আপন করে নেওয়াই নিরাপদ মনে করবেন। অসমের চা-বাগান জনগোষ্ঠী এত দিন হাত চিহ্নে ভোট দিত। গত নির্বাচনে তারা পদ্মফুল চিনে নিয়েছে। এখন প্রিয়ঙ্কা বঢরা বাগানে গিয়ে পাতা তুললেও তাদের মন থেকে চিহ্ন বদলে দেওয়া সহজ নয়।
ফলে, নির্বাচনী গণতন্ত্রের শেষ কথা যে ম্যাজিক ফিগার, সেখানে আপাতত কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে দুই দিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy