—প্রতীকী ছবি।
কতখানি হইচই পড়েছে, সেই মাপকাঠিতে যদি কোনও জিনিসের গুরুত্ব বিচার করতে হয়, তা হলে বলতেই হবে, এই মুহূর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘ডিপফেক’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন বেশ কিছু নেতার ডিপফেক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি নকল ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ল; স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করলেন; কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বৈঠকে বসলেন সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলির কর্তাদের সঙ্গে। কিছু দিন আগে ছড়িয়েছিল অভিনেত্রী রশ্মিকা মান্দানা কিংবা কাজলের ‘ডিপফেক’ ভিডিয়ো। ডিপফেক নিয়ে নেতাদের এমন উদ্বেগের কারণ, বস্তুটি ক্রমেই হয়ে উঠছে রাজনৈতিক ব্রহ্মাস্ত্র।
শুরু হয়েছিল আগেই। ২০২০-র দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের আগে ছড়িয়ে পড়েছিল অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে নিয়ে তৈরি একটি ভিডিয়ো। এমআইটি-র প্রযুক্তিবিদরা পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, সেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি ‘ডিপফেক’। প্রযুক্তি আরও এগোয়। দ্রুত লয়ে। এখন বাবুরাম সাপুড়েদের ঝোলা থেকে উঁকি মারছে যে সব ‘ডিপফেক’ ছবি, অডিয়ো বা ভিডিয়ো, সেগুলো আরও বেশি ‘জ্যান্ত’। তাতে বিষের পরিমাণও বেশি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন দখল নিচ্ছে আমাদের জীবন ও যাপনের প্রতিটা স্পন্দনের, নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার অনুপ্রবেশ অবশ্যম্ভাবীই ছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর হল স্লোভাকিয়ার নির্বাচন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-প্রভাবিত ভোটের ইতিহাসে যা এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন। নির্বাচনের ঠিক দু’দিন আগে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ল একটা অডিয়ো ক্লিপ, যাতে কথা বলছেন উদারপন্থী প্রোগ্রেসিভ স্লোভাকিয়া পার্টির শীর্ষনেতা এবং এক নামজাদা সাংবাদিক। আলোচনার বিষয়বস্তু: কী ভাবে কারচুপি করা যায় নির্বাচনে। দু’জনই দাবি করলেন, অডিয়ো ক্লিপটা নকল। পরীক্ষাতেও তা প্রমাণিত হল। হাড্ডাহাড্ডি ভোটের লড়াইয়ে কিন্তু হেরে গেল প্রোগ্রেসিভ স্লোভাকিয়া পার্টি।
রাজনীতিতে মিথ্যার বিস্তার নতুন কিছু নয়। আজ যখন ডিপফেকের দুনিয়ায় সত্যি আর মিথ্যার সীমারেখা ক্রমশ ধূসর এবং বিস্তৃত হচ্ছে, কৃত্রিম ভিডিয়ো, ছবি কিংবা অডিয়ো দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়ে পড়েছে আগের পদ্ধতিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সহজ। ২০২৪-এ দুনিয়া জুড়ে রয়েছে একগুচ্ছ অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। আমেরিকায়, ব্রিটেনে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে, মেক্সিকোতে, দক্ষিণ আফ্রিকায়। রয়েছে আমাদের লোকসভার ভোটও। এই পটভূমিতে স্লোভাকিয়ার নির্বাচন যেন ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার— বিশেষ করে ডিপফেক প্রযুক্তির— এক ‘পরীক্ষা ক্ষেত্র’। তার প্রয়োগের কার্য-প্রকরণ ও সুবিধা-অসুবিধা বুঝবার জন্য, ভুলত্রুটি শুধরে নেওয়ার জন্য।
নভেম্বরে ছিল আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনও হল একেবারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চৌহদ্দিতে। দুই প্রার্থী এবং তাঁদের প্রচার-দল আর সমর্থকরা যথেচ্ছ প্রয়োগ করলেন এআই প্রযুক্তি। বানিয়ে-তোলা ছবি আর ভিডিয়োতে ছয়লাপ ভোটের প্রেক্ষাপট। আর্জেন্টিনার এই ভোটকে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে দুনিয়ার ‘প্রথম এআই নির্বাচন’। বলেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা বাড়ছে, তা সস্তাও হচ্ছে ক্রমে। ফলে দুনিয়ার বহু গণতান্ত্রিক নির্বাচনেই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে চলেছে এআই। যা বদলে দিতে পারে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি।
ভারতেও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব পড়বেই। কিন্তু, এই প্রথম ভারতে কোনও নির্বাচন হবে প্রযুক্তি-প্রভাবিত, তেমন কথা বলার প্রশ্নই নেই। গত তিন দশকের প্রায় প্রতিটা নির্বাচনেই ভারতের ভোটকৌশল সংজ্ঞায়িত হয়ে চলেছে নতুন ভাবে। ১৯৯০-এর দশকে বিপুল ভাবে ফোন-কলের প্রয়োগ থেকে ২০১৪ সালে হলোগ্রাম ব্যবহার— সবই নতুন প্রযুক্তি-নির্ভর ছিল। ২০১৪-র নির্বাচন ভেসে গেল সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে, যার হাতিয়ার ছিল মূলত ফেসবুক আর টুইটার। ২০১৯-এর নির্বাচনে প্রধান অস্ত্র ছিল হোয়াটসঅ্যাপ। এ সবের মধ্য দিয়ে মিথ্যা খবর, ছবি বা ভিডিয়োও ছড়িয়েছে। আজ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভাসিয়ে দিচ্ছে দুনিয়াকে, ভারতের লোকসভা নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়বে। ২০২৪-এর আমেরিকার নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই বাইডেন, হিলারি ক্লিনটন, কমলা হ্যারিস কিংবা ট্রাম্পের নকল ভিডিয়োতে ছয়লাপ সে দেশের সমাজ। কিন্তু এ সবই কি ভোটের নির্ণায়ক? ভোটের বাজারে এ সবের প্রভাব ঠিক কতটা?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ নিনা শিক ২০২০-তে লিখেছিলেন তাঁর বই ডিপফেকস: দ্য কামিং ইনফোক্যালিপ্স। বাইবেল বর্ণিত অ্যাপোক্যালিপ্স-এর নতুন রূপ, যেখানে অন্তিম প্রলয়ের পিছনে রয়েছে ইনফর্মেশন বা তথ্য। শিক বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তথ্য ও যোগাযোগ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে ‘ডিপফেক’। শিগগিরই অসম্ভব হয়ে পড়বে আসল-নকল আলাদা করা। ডিপফেক শুধু গণতন্ত্রের জন্যই বিপজ্জনক নয়, তা ভোটার-নিয়ন্ত্রণের কৌশলকে এক অভূতপূর্ব নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। পরবর্তী তিন বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠে ডিপফেক আজ ত্রস্ত করেছে সভ্যতাকে। উল্টেপাল্টে দিতে চলেছে দেশে দেশে নির্বাচন-ব্যবস্থাকে।
ডিপফেক প্রযুক্তি আজ অনায়াসলব্ধ, সস্তা এবং তার প্রয়োগও সহজ। অপেশাদাররাও সহজে বানিয়ে ফেলছেন ডিপফেক। পেশাদারি সাহায্যও নাকি পাওয়া যায় নামমাত্র মূল্যে। ভোটের বাজারে প্রায় সবার হাতের নাগালেই তাই আজ এক শক্তিশালী অস্ত্র। এমনকি প্রার্থীর বা তাঁর প্রচার দলের অজ্ঞাতেও উৎসাহী সমর্থকরা ছড়িয়ে দিতে পারেন ডিপফেক। মনে পড়তে পারে, মাস কয়েক আগে বিশ্ব জুড়ে ভাইরাল হয় ‘মিডজার্নি’ নামের জেনারেটিভ এআই-এর সাহায্যে তৈরি কিছু ছবি, যার একটায় টেনে-হিঁচড়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। আচ্ছা, ঠিক কী হতে পারে কোনও দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনও নির্বাচনের প্রেক্ষিতে প্রধান কোনও নেতার এমন ‘ডিপফেক’ ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে?
ডিপফেকের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনার নিরিখে ভারত নাকি এমনিতেই বেশ নড়বড়ে। সরকারও তাই স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন। সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব দিচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ছবি বা ভিডিয়োতে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি যোগ করার ব্যবস্থা হোক, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন যে, ভিডিয়োটা জাল। আন্তর্জালের দুনিয়ায় কড়া নজরদারি চালিয়ে আলাদিনের দৈত্যকে খানিক অনুশাসনে রাখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু তাকে কি ফের সম্পূর্ণ বোতল-বন্দি করা যাবে? প্রযুক্তি উন্নততর হবে, আরও কঠিন হতে থাকবে কোনও অডিয়ো বা ভিডিয়োকে ‘ডিপফেক’ হিসাবে চেনা। সেই সঙ্গে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সংবেদনশীল কোনও ছবি, অডিয়ো বা ভিডিয়ো ক্লিপ তো কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছবে চোখের পলকে। স্লোভাকিয়ার সাম্প্রতিক ভোটের মতো, নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে কোনও ‘ডিপফেক’ পোস্ট করা হলে তা ঠিক ভাবে চিহ্নিত করে সরিয়ে দেওয়ার আগেই তো হতে পারে লঙ্কাকাণ্ড।
ডিপফেক কতটা প্রভাবিত করতে পারে কোনও নির্বাচনকে, সে বিষয়ে আলোচনাও অনেকটাই অনুমান-নির্ভর। যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ ডিপফেক অডিয়ো বা ভিডিয়ো দেখেই প্রভাবিত হয়ে ভোট না-ও দিতে পারেন। এমন হতেই পারে যে, এই ভিডিয়োয় যাঁরা প্রভাবিত হবেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো সংশ্লিষ্ট দলের প্রতি ঝুঁকেই ছিলেন। আবার প্রযুক্তি সবার করায়ত্ত হলে ভোটের বাজারে প্রায় সব দল বা প্রার্থীর পক্ষেই ডিপফেক ছড়ানো হতে থাকবে। আর্জেন্টিনায় তো তেমনটাই হয়েছে। ডিপফেকই সে ক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক, এমনটাও বলা কঠিন। এমনটাও হতে পারে যে, সর্ব ক্ষণ মিথ্যা ভিডিয়ো আর ছবি দেখতে দেখতে মানুষের মনেই খানিক সংশয় জন্মাবে— ফোনে কোনও ভিডিয়ো এলেই তাকে বিশ্বাস করবেন না।
নির্বাচনে ডিপফেকের প্রভাব ঠিক কতটা, এমন সোজাসাপটা বিষয়েও সমীক্ষা-নির্ভর তথ্যসমৃদ্ধ কোনও বিশ্লেষণ কিন্তু চোখে পড়েনি। সমাজ-পরিসরে এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে এআই কিংবা ডিপফেকের প্রভাব অনুধাবনে এ ধরনের গবেষণা কিন্তু খুবই জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy