বিকল্প: ভিনপথের তথ্যচিত্র উৎসবে প্রতিবাদের নতুন আকাশের খোঁজ। ফাইল ছবি।
ছেঁড়া, ছেঁড়া দুঃস্বপ্নের রাতে বিচ্ছিন্ন প্রেমিককে চিঠি লিখছে একটি মেয়ে। বিভীষিকার মতো তাকে তাড়া করে চলেছে চার পাশের ডিসটোপিয়া। সমকালের ভারত। পায়েল কাপাডিয়ার ছবি আ নাইট অব নোয়িং নাথিং জুড়ে পুণের এফটিআইআই, হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার বিশ্ববিদ্যালয়, জেএনইউ-এর প্রতিবাদ বা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের ফুটেজ। সেই সঙ্গে গোরক্ষকদের তাণ্ডব, প্রতিবাদী ছাত্রদের গ্রেফতারি, পুলিশি জুলুম। ২০২১-এ কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে গোল্ডেন আই খেতাব জয়ের পরে ছবিটি সে দিন প্রথম কলকাতায় দেখানো হল।
পায়েলের ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান গোবরডাঙার নাট্যকর্মী ভূমিসূতা দাসের। ছবি জুড়েই তাঁর কণ্ঠ। আজকের ভারতের গল্প বলতে মিশে গেছে বাংলা, অসমিয়া, হিন্দি বা দক্ষিণী টানের ইংরেজিও। ছবির চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক রণবীর দাস বা আবহ বিন্যাসের (সাউন্ড ডিজ়াইনিং) দায়িত্বে থাকা মৈনাক বসুও বাংলার। সাধারণত স্থানীয় প্রতিভার সাফল্য মেলে ধরতে তৎপর সংবাদমাধ্যমেও কিন্তু এই তথ্যচিত্রটির কথা বেশি আসেনি। তথ্যচিত্র নিয়ে বাংলার চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের এক ধরনের দুর্বোধ্য উদাসীনতাই হয়তো বা এর কারণ।
তবে সপ্তাহের একটি কেজো দিনে বেলা দশটাতেও এ ছবির জন্য দক্ষিণ কলকাতার উত্তম মঞ্চ প্রায় ভরে ওঠে। তখনও শাহরুখ খানের ছবি পঠান মুক্তি পেতে কয়েক দিন বাকি। অস্কার-দৌড়ে শৌনক সেনের তথ্যচিত্রঅল দ্যাট ব্রিদস-এরও নাম উঠে আসেনি। কলকাতায় পিপলস ফিল্ম কালেকটিভ-এর চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী ছবি হিসেবে দেখানো হল পায়েলের ছবি। অনেকের মতে, উৎকর্ষের নিরিখেও এ দেশের তথ্যচিত্রের এখন যথার্থই সুসময় চলছে। পায়েল বা শৌনকের মতো নবীনদের ছবিই শুধু নয়, সাম্প্রতিক অতীতে আনন্দ পটবর্ধনের রিজ়নও অ্যামস্টারড্যামে সেরার পুরস্কার পেয়েছে। ২০২১-এও দলিত মেয়েদের সংবাদমাধ্যম খবর লহরিয়া নিয়ে সুস্মিত ঘোষ, রিন্টু টমাসদের রাইটিং উইথ ফায়ার-ও অস্কার-দৌড়ে বিশেষ ছাপ ফেলেছিল।
এ দেশে বিবিসির গুজরাত গণহত্যা-বিষয়ক তথ্যচিত্র সহজে নিষিদ্ধ করা হয়, শাহরুখ-দীপিকার সিনেমার গানের ‘বেশরম রং’ নিয়ে হাস্যকর জলঘোলা চলে! কিন্তু পায়েল, শৌনকেরা দেখাচ্ছেন কান, অস্কারের মতো বড় মঞ্চেও ভারতীয় তথ্যচিত্রই সতেজ স্বরে দেশের ভিতরকার ঘৃণার রাজনীতি নিয়ে কথা বলে চলেছে। এই তথ্যচিত্রগুলি মেলে ধরার পরিসরটিও তাই ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ছবি ভাল হলেও বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে সবার জন্য মাল্টিপ্লেক্স বা অন্যত্র রিলিজ় এ দেশে সচরাচর সম্ভব হয় না। আবার রাজনৈতিক তথ্যচিত্র হলে তো ঘোর সমস্যা। পায়েলের ছবি এখনও পর্যন্ত একটি শোয়ে দেখেছে কলকাতা। যারা দেখাল সেই পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভের উৎসব এ বার ন’বছরে পড়েছে। বচ্ছরকার পার্বণে চার, পাঁচ দিন ধরে খানচল্লিশ ছবি দেখানো হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রতি মাসে কাছের দূরের মফস্সল, কলকারখানা, ইস্কুল, লাইব্রেরি, প্রতিবাদী অবস্থান সমাবেশ কোথাও না কোথাও প্রয়োজনীয় সিনেমা দেখানোর কাজটি তারা অটুট রেখেছে। এই কালেক্টিভের দুই মুখ কস্তুরী বসু আর দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও গোঁ, উৎসব আয়োজনের জন্য কোনও ধরনের বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতা বা কর্পোরেট অনুদান নেওয়া হবে না। পাশাপাশি, নিজেদের মতাদর্শমাফিক সিনেমা তৈরিতেও ওঁরা মাঠে নেমেছেন। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান নিয়ে আ বিড ফর বেঙ্গল ছবিটি ইতিমধ্যে দেশের নানা প্রান্তেদেখানো হয়েছে।
১৯৮০-র দশকে নিজেদের স্বাধীন ছবি তৈরির রেস্ত জোটাতে কেরলে গ্রামে গ্রামে তারকভস্কি, গদারের ছবি দেখাতেন ওডেসা কালেক্টিভের সংগঠকেরা। জন অ্যাব্রাহাম, সি শরৎচন্দ্রন, কেপি শশীদের নাম ঢুকে পড়েছে এ দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। নিজের ছবি কোথায় না কোথায় দর্শকদের কাছে নিয়ে গেছেন আনন্দ পটবর্ধনও। ক্রমশ সিনেপ্রযুক্তির বদলের সঙ্গে সঙ্গে তা শিখে স্বাধীন ভাবে ছবি তৈরি এবং দেখানোর ইচ্ছেটাই রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন কালেক্টিভের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। ২০০২-এর গুজরাত-কাণ্ড নিয়ে ছবি দেখানোয় সমস্যা হয়েছিল মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র উৎসবে। প্রতিবাদে বিকল্প উৎসব মঞ্চ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। গত ১০-১৫ বছরে রাজনৈতিক প্রতিরোধের হাতিয়ার হয়ে উঠতে কালেক্টিভের দৌড় শুরু হয় গোরক্ষপুর, ভুবনেশ্বর, রাঁচী, মাদুরাই, ভোপাল, রায়পুরের মতো নানা তল্লাটেই। ভোপালের একতারা কালেক্টিভ আবার পরিচালকের আধিপত্যের ধারণাটাই ভেঙে দিচ্ছে। শহরের জঞ্জালকুড়ানি শিশু, রূপান্তরকামী মেয়ে, গৃহসহায়িকা— তাঁদের সঙ্গে নিয়েই ছবিটা তৈরি হচ্ছে। ভোপালে গৃহসহায়িকা, হাওড়ার মেয়ে মলিনা মিদ্যাও একতারার ছবির যৌথ খামারে জড়িয়ে পড়েছেন। ভিনধর্মে বিয়ে নিয়ে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে তুরুপ বলে সেই ছবিও বাংলার জেলায় জেলায় দেখিয়েছে কলকাতার পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ।
দেওয়ালে আলো ফেলে ফিল্ম সোসাইটির শো-এ ইউরোপীয় ক্লাসিক দেখার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। তবে কারা সে ছবি দেখার যোগ্য তা নিয়ে ছুতমার্গ ছিল বিস্তর। অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে মাঝবয়সি মধ্যবিত্ত পুরুষই দলে ভারী। তথাকথিত নিম্নবর্গ বা মেয়েরা কি বিদেশি আনসেন্সরড ছবি হজম করতে পারবেন? ফিল্ম সোসাইটির মাথাদের কারও কারও না কি এমনও সংশয় ছিল। সরকার নিয়ন্ত্রিত ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ়-এর ছাতার নীচে দারুণ প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে ওঠাও সোজা ছিল না। সদিচ্ছা থাকলেও সাবেক ফিল্ম সোসাইটি তাই বৃহৎ অর্থে সমাজ হয়ে উঠতে পারেনি। পরে উঠে আসা ফিল্ম কালেক্টিভের যৌথতা পুরনো ভুলগুলি শুধরোনোর চেষ্টা করছে।
আবার এই ইন্টারনেটের রমরমার যুগে ফিল্মি যৌথ খামারের অস্তিত্ব উলটপুরাণও বলা যায়। ডিভিডি, পেনড্রাইভ আর টরেন্ট-এর উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই জাঁকিয়ে বসে ডাউনলোড সংস্কৃতি। বিদেশি ক্লাসিক বা নতুন ছবিও তখন ঘরের ভিতরে হাতের মুঠোয়। ফলে একুশ শতকে ফিল্ম সোসাইটির মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে বলেও অনেকে ধরে নেন। ওটিটি-সংস্কৃতি শুরু হওয়ার পরে সিনেমা হলের বিনোদনই জোর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কিন্তু দেশ জুড়ে বিভিন্ন কালেক্টিভও দেখাচ্ছে, বলিউডি মহাতারকার জনমোহিনী ছবি ছাড়াও নানা স্বাদের প্রতিবাদ, অজানা জীবন, রাজনীতির পাঠ নিতেও ঝাঁক বেঁধে সিনেমা দেখার যৌথতার উপযোগিতা রয়েছে। একদা বেশির ভাগ তথ্যচিত্রের আঁতুড়ঘর সরকারি ফিল্মস ডিভিশন সম্প্রতি ঝাঁপ গুটিয়েছে। তাতে কোণঠাসা পরিচালকদের স্বাধীন কাজের স্বপ্ন দেখাচ্ছে কালেক্টিভ মডেল।পায়েল মনে করেন, এ দেশের বিভিন্ন শহরে কিছু ছক-ভাঙা চলচ্চিত্র উৎসব বা শিক্ষাঙ্গনের আয়োজনে শো-ই এখনও তথ্যচিত্রকে মেলে ধরার প্রধান জায়গা। মেয়েদের অধিকার নিয়ে তথ্যচিত্র পরিচালক ফারহা খাতুনও তাঁর সঙ্গে একমত। এ রাজ্যে সরকারি চলচ্চিত্র উৎসবেও নানা ধরনের ছবি, তথ্যচিত্র দেখানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের আওতার বাইরে আরও নতুন কিছুর হদিস দিচ্ছে কালেক্টিভের ফিল্মোৎসব।
কলকাতা পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভের উৎসবে জেএনইউ-এর নিখোঁজ ছাত্র নাজিবকে নিয়ে সিনেমার শো-এ যেমন তাঁর মা নিজে এসেছিলেন। মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান-বিরোধী এক ঝাঁক তরুণ নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে একটি ছবি কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। ইলাহাবাদ থেকে প্রয়াগরাজের পটভূমিতে আজকের বদলাতে থাকা ভারত নিয়ে ছবি অ্যায়সে হি-ও এখানেই দেখল কলকাতা। আক্ষেপ হয়, নিজের দেশের এমন একটি সেরা কাজ কেন এত দিন দেখা যায়নি?
কস্তুরী, দ্বৈপায়নরা চান, কালেক্টিভের উৎসবে মানুষের অধিকারবোধ গড়ে উঠুক। ছবি প্রদর্শনের মান বা পেশাদারিত্বে তাঁরা আপস করেন না। পরিচালক, কলাকুশলীদের কলকাতায় ডেকে এনে ছবি নিয়ে ধারালো কাটাছেঁড়া চলে। অচেনা দর্শকরা এগিয়ে এসে স্বেচ্ছাসেবী হন। টিকিট না-রাখলেও সাধ্যমতো অর্থ সাহায্যের জন্য আর্জি জানান সংগঠকেরা। কালেক্টিভ মডেলের যৌথতায় ছবি তৈরি থেকে তা দেখানোর পরিসরটি এ ভাবেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে বেড়ে উঠছে। প্রতিবাদী স্বরের কণ্ঠরোধের আবহে এ যেন মুক্তির ফুরফুরে বাতাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy