বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদটি শূন্য অবস্থায় পড়ে থাকলে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী, সবারই ক্ষতি। ফাইল চিত্র।
বেশ কিছু দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী এবং অস্থায়ী উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে এক প্রবল প্রশাসনিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদটি শূন্য অবস্থায় পড়ে থাকলে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী, সবারই ক্ষতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সমস্যা সমাধানে তেমন কোনও উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ছে না। সম্প্রতি রাজ্যপালের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠক হল। কিন্তু জট কাটবে, তেমন নিশ্চয়তা এখনও নেই।
এই সমস্যার শুরু হয়েছিল কয়েক জন উপাচার্যকে রাজ্যপালের বা রাজভবনের অনুমতি ছাড়াই অতিরিক্ত সময়ের জন্য বহালের সিদ্ধান্ত থেকে। এখন এ কথা সবাই জানেন, হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে মেনে নেয়নি। ফলে আইনি সমস্যার জন্য— বিশেষ করে রাজ্যপালের সম্মতি না নেওয়ায়— উপাচার্যের পদগুলি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য এ কথাও এখন সর্বজনবিদিত যে, দিনের পর দিন রাজভবন থেকে একেবারেই রুটিনমাফিক নির্দেশনামা এবং সম্মতি না পাওয়ার ফলে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে কিছু পদক্ষেপ করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এ-হেন ঘটনা আগে কোনও দিন ঘটেছিল কি না আমার জানা নেই। অনেকেই সঙ্গত ভাবে সেই সময়ের রাজভবনের অকারণ আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের পিছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি।
এ কথা সর্বৈব সত্য যে, পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে রাজভবনের সঙ্গে রাজ্য সরকারের একাধিক বার মনোমালিন্য, খানিকটা সংঘাত, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে চাপানউতোর ইত্যাদি চোখে পড়েছে। কিন্তু আমার সীমিত অভিজ্ঞতা বলে, কখনও তেমন কোনও সঙ্কটাবস্থার সূচনা হয়নি— বিশেষত, কোনও বিশ্ববিদ্য়ালয়ের উপাচার্যের পদের মেয়াদ শেষ হলে কিছু দিনের জন্য তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধির মতো ব্যাপারে। এখানে একটু অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১১ সালে নতুন সরকার কর্মভার গ্রহণ করার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি প্রত্যক্ষ ভাবে (কলকাতা) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমার বিশেষ করে মাননীয় এম কে নারায়ণন এবং মাননীয় কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার বাতাবরণ, একাধিক বার রাজনৈতিক উত্তেজনা সম্বলিত ঘটনাবলি মাথাচাড়া দেওয়া সত্ত্বেও রুটিন কাজকর্ম কিন্তু ঠিকঠাকই চলেছিল। কী করে ধীরে ধীরে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হল এবং কী ভাবে এই অবস্থা থেকে রাজ্যের উচ্চশিক্ষাকে খানিকটা স্বস্তি দেওয়া যায়, সে সম্পর্কে জরুরি অবস্থার মতো ভাবনা-চিন্তা ও পদক্ষেপের বিশেষ প্রয়োজন।
শুনেছি, উপাচার্য নির্বাচন সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে আদালতে মামলা রুজু হয়েছে। বিচারাধীন কোনও বিষয়ে মন্তব্য করার কোনও প্রশ্নই নেই। শুধু কয়েকটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। রাজভবন এবং নবান্নর মধ্যে, বিশেষ করে রাজভবন এবং উচ্চশিক্ষা দফতরের মধ্যে সম্পর্কে যদি কিছুটা উন্নতিও আনা যায়, তা হলে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবলে ভাল হয়। কোনও সমস্যাই এমন গভীর নয়, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অভিভাবকহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে হবে। এ কথাটাও হয়তো সত্যি যে, আদালতের কাছে ঠিকমতো আবেদন জানালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের আচলাবস্থার এক ধরনের সুরাহা হলেও হতে পারে। কিন্তু আদালতের দ্বারস্থ হয়ে নয়, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য রাজভবন এবং নবান্ন এবং উচ্চশিক্ষা দফতরকে একত্রে বসেই একটা সমাধান সূত্র বার করতে হবে।
আজ সারা দেশেই উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে এক ধরনের প্রশাসনিক নিস্পৃহতা এবং উপেক্ষা চোখে পড়ে। দিনের পর দিন নতুন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। প্রচুর পদ ফাঁকা, অতিথি অধ্যাপকদের দিয়ে দিনের পর দিন ক্লাস চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের চরম দুরবস্থার দিকে কারও লক্ষ নেই। উপাচার্য না থাকলে এ রকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারেন না। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ২০১১ থেকে বিগত এক যুগে বহু বার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী ভাবে উপাচার্য পদপূরণের সময় মাননীয় রাজ্যপালের অনুমতি নিয়েই কাজ চালানো হয়েছিল। সেখানে বার বার ফাইল ফেরত পাঠানোর কোনও ঘটনা ঘটেনি। ফলে ‘গেল গেল’ রব খুব বেশি দিনের ঘটনা হতে পারে না। যদি রাজনীতিকে হাতিয়ার করে আমরা প্রচুর ছাত্রছাত্রীর সর্বনাশ সাধনে উদ্যত হই, যদি ন্যূনতম এবং জরুরি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাই, যদি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অচল করে দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি, তা হলে তার মতো গর্হিত অপরাধ আর নেই।
যে কোনও ক্ষেত্রেই কারও দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা তুলনায় সহজ কাজ। ‘শিক্ষার যা অবস্থা’ বলে বাঁকা হাসি হেসে চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে শিক্ষার কলঙ্ককে বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে দেখাটাই এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু শিক্ষার চালু ব্যবস্থাকে অচল করে রেখে দেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের যে ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে, সে সম্পর্কে ছিটেফোঁটা আলোচনাও চোখে পড়ে না। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া যেন তেন প্রকারেণ অস্থায়ী শিক্ষক জুটিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিলে শিক্ষার গুণমানকে অপমান করা হয়। যাঁরা পড়াতে আসেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু, নিয়মিত শিক্ষকের পরিবর্তে অস্থায়ী শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার কাজ চালানো যায় না। পরীক্ষার ফলাফল, পরিকাঠামো সংক্রান্ত আদেশনামা, গবেষণাগারের স্বাস্থ্য সচেতনতা সব মিলিয়ে শিক্ষা। সে সব কাজের দায় কি অস্থায়ী শিক্ষকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া যায়?
যতটুকু খোঁজখবর পেয়েছি তার ভিত্তিতে বলা যায়, যে-হেতু কোর্টে বেশ কিছু মামলা-মকদ্দমা চলছে বা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি, তাই সবাই অপেক্ষা করছেন। সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে-থাকা কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর সমস্যা, কিংবা এই চরম প্রশাসনিক খামতির চটজলদি মোকাবিলা করা যাবে কী ভাবে? উত্তরটি জানা নেই। আরও দুশ্চিন্তার কারণ হল, যে-হেতু কোনও ভাবেই ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক গুণমানকে তেমন সম্মানের চোখে দেখা হয় না এবং একমাত্র আয়তনবৃদ্ধি ছাড়াও যে কোনও বিষয়ে মধ্য বা নিম্নস্তরের সাফল্যকেই পাখির চোখ করে নীতি নির্ধারিত হয়, উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা দু’দশ মাস নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকলে কারও কিন্তু যায় আসে না। উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ভাল প্রশাসনিক পদক্ষেপ হঠাৎই উপাচার্যের প্রশাসনগত অযৌক্তিক এবং অপসারণ অনুপস্থিতির জন্য আটকে গিয়েছে। যে-হেতু সেই উপাচার্য পাহাড়ের একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়েরও দেখাশোনা করছিলেন, সেটিও একটি উপেক্ষিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিরাজ করছে।
লাইন দিয়ে প্রাক্তন শিক্ষাকর্তাদের জেলভ্রমণ এবং বেশ কিছু দিন ধরে এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবাদবিতর্কের বিভিন্ন ঘটনাকে চরম গুরুত্ব দিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে রাজ্যে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহার মতো অধ্যাপকেরা উচ্চশিক্ষার আসর মাত করে রাখতেন, সেখানে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাথ হয়ে পড়ে থাকার ব্যাপারে কারও কোনও হেলদোল নেই। আর থাকলেও অন্তত এ রাজ্যের মানুষের আপেক্ষিক ভাবে নিম্নমুখী চেতনার স্তরে সে সব দাগ কাটে না।
আর্থিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সমানেই পিছিয়ে পড়েছে, কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ রাজ্য চিরকালই ভারতে বিশিষ্ট ছিল। এখনও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিএইচ ডি-র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাঙালি ছাত্রছাত্রী একটি বেশ বড় অংশ। সে রাজ্যের উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি নিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে আরও অনেক বেশি সচেতনতা, উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রত্যাশিত ছিল। না কি, আমরা মেনেই নিয়েছি যে, তলিয়ে যাওয়াই আমাদের ভবিতব্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy