দ্য স্টারি নাইট। —ফাইল চিত্র।
শতবর্ষী গৌরকিশোর ঘোষের দাসত্ব নয় স্বাধীনতা (আনন্দ) বইটির ‘দিনলিপি’ পর্বে চোখ আটকে গেল ১০.৯.৭৬ তারিখের রচনায়: “আত্মিক শক্তির অভাবে মানুষের ব্যক্তিসত্তার স্ফুরণ ঘটবে না, ব্যক্তিত্ব বিলীন হবে যূথপিণ্ডতায়।” স্বভাবত-স্বতন্ত্র মুক্তমনা নির্ভীক এই মানুষটি মনেই করতেন, যে আত্মশক্তিতে দুর্বল সে ক্রমশই হয়ে পড়ে ব্যক্তিত্বহীন। ‘যূথপিণ্ডতা’ শব্দটি খেয়াল করুন, যিনি তাতে বিলীন হন না বা হতে চান না— তাঁর উপরে আবার নেমে আসে সমষ্টি ও সমাজের অত্যন্ত অসহনশীল এক আচরণ, যা প্রায় হিংস্রতারই নামান্তর। “হিংস্রতা আমাদের আদিম স্বভাবের অন্তর্গত। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আমাদের সভ্যতার দান।” ওই বইয়েরই আর একটি রচনায় লিখছেন গৌরকিশোর, তাঁর পুত্রকে একটি চিঠিতে।
অথচ সভ্যতার এই সহনশীলতার আচার বারে বারে বিঘ্নিত হতে দেখি, বিশেষত সেই সব শিল্পীর ক্ষেত্রে, যাঁরা সামাজিক নিরাপত্তার তোয়াক্কা না রেখে নিজেদের সদা-অতৃপ্তি থেকে অভাবনীয় নতুন নতুন সৃষ্টিতে প্রাণিত করতেন মানবসমাজকে। ভিনসেন্ট ভ্যান গখ যেমন। বিশৃঙ্খল বাউন্ডুলে অবুঝ অভিমানী এই শিল্পীর ভিতর লুকোনো তাঁর দুর্মর আত্মশক্তিকে কখনও চিনতে চায়নি তাঁর সমকালীন সমাজ— গরিষ্ঠের সমাজ, গণসমাজ। আর সে সমাজের কর্তৃত্ব ছিল যাঁদের হাতে, তাঁরা চেয়েছিলেন ভিনসেন্টকে যতটা সম্ভব অসমাদৃত পরিত্যক্ত করে ফেলতে। সমাজ যে-হেতু মানুষেরই হাতে গড়া, সে সমাজকে বুঝতে গেলে ব্যক্তিমানুষের মনটাকে আগে চেনা দরকার। সমষ্টি যখন কোনও অনৈতিক মিথ্যা আত্মপরিচয়ে নিজেকে সংযুক্ত করে, তখন সে ব্যক্তিমানুষকেও ওই একই সমবায়ে অন্বিত করার চেষ্টা করে, ফলে ব্যক্তির আত্মসঙ্কট তৈরি হয়।
সম্প্রতি স্বপ্নসন্ধানী-র তারায় তারায় নাটকটি দেখতে-দেখতে ব্যক্তির এই আত্মসঙ্কটের প্রসঙ্গটিই যেন হঠাৎ সামনে চলে এল। এক পাদরি এসে এক বার ভিনসেন্টকে বললেন, এখানকার মানুষেরা অত্যন্ত দরিদ্র এবং অশিক্ষিত, সমাজের নিচুতলায় এদের বাস, এদেরকে আপনার ছবি আঁকার কাজে অনুপ্রেরণা হিসাবে না-ই বা ব্যবহার করলেন। শুনে ভীষণ রেগে গেলেন ভিনসেন্ট, ভাইকে জানালেন: “থিয়ো, এরা কারা? মানুষ আঁকতে দেবে না... যারা ঘোলাটে আলোয় এক সঙ্গে গাদাগাদি করে বসে নিজেদের চাষ করা আলুগুলো খায়, নোংরা আঙুল ডুবিয়ে স্যাঁতসেঁতে ঘরে... ওই অন্ধকার আমি আঁকব, ওই দারিদ্র আমি আঁকব... আঁকবই...।” নাটকটির নির্দেশক কৌশিক সেন বলছিলেন: যখন দেখি দৈনন্দিনে কী ভাবে বাঁচব বা কী ভাবে কথা বলব তাও স্থির করে দিতে চাইছে অন্য কেউ, প্রকারান্তরে যেন নির্দেশই জারি করছে কোনও জনগোষ্ঠী, তখনই একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে।
সে নিঃসঙ্গতা ঘিরেছিল ভিনসেন্টকেও। কল্পনার প্রাত্যহিকতায় চিত্রভাষার যে অভিজ্ঞান ভিনসেন্ট খুঁজে চলতেন নিরন্তর, সে পরিক্রমায় কোনও ছাঁচ বা খাঁচা বরদাস্ত করতেন না, এ-নাটকে তাঁর সংলাপে আছে: “আকাশ যে কী বিশাল, কী প্রশান্ত, রাজকীয়, কী ব্যাপ্ত... কিন্তু সেই ব্যাপ্তির মধ্যে নিজের বেঁচে থাকার দুঃখ আর ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে জুড়ে দেওয়াটাই আমি শিল্প বলে মনে করি।” ভিনসেন্ট নিজেই যে-হেতু এ-নাটকের একটি চরিত্র, ব্যক্তির চাপা পড়া স্বর তাঁর সংলাপে: “বাস্তব হচ্ছে কল্পনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক ষড়যন্ত্র... মানুষ একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ হলেই তাকে উন্মাদ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে চিরকাল।”
অপ্রকৃতিস্থ বা অসুস্থ বলে যখন কোনও কল্পনাপ্রবণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত জীবনযাপনে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। যেমনটা ঘটে এ-নাটকে ছবি-আঁকিয়ে ঋত্বিক আর মনোবিদ রুখসারের মধ্যে। ঋত্বিকের ছবি আঁকার নেশা, রুখসারকে সে জানায়, ভ্যান গখের দ্য স্টারি নাইট ছবিটা দেখলে তার মনে হয়, বাস্তবে আর না ফিরলেও চলবে। “চার পাশটা না ঠিক ওই ছবিটার মতো হয়ে যায়... বিশাল বড় রাতের আকাশটা, সাইপ্রাস গাছ, ছোট ছোট বাড়িগুলো... ওই ছবিটার মধ্যে আমি হেঁটে বেড়াই...।” শুনে রুখসার সিদ্ধান্তে আসে: “ঋত্বিক একটা প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি করে ফেলেছে... একটা সমান্তরাল জগৎ... দিস ইজ় নট রাইট...।” ঠিক-ভুলের দ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে থাকে তাদের দু'জনের জগৎ। সজীব মনের কল্পনার সঙ্গে নিয়মানুগ বিদ্যাতত্ত্বের যেন বিরোধ বেধে যায়, সমস্ত কাজের মধ্যে মন জিনিসটা যত না জেগে ওঠে, তার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে বিধিবিধান।
এমনটাই ঘটেছিল ডাকঘর নাটকে অমলের সঙ্গে মাধব দত্ত, মোড়ল আর কবিরাজের। এই তিন জনের হাত থেকে রাজকবিরাজ এসে নিস্তার দেন অমলকে, বলেন: “চারিদিকে সমস্তই যে বন্ধ! খুলে দাও, খুলে দাও, যত দ্বার-জানলা আছে সব খুলে দাও।” তার পর অমলের শিয়রের কাছে গিয়ে বসে বলেন “প্রদীপের আলো নিবিয়ে দাও... এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক...।” অমল নিশ্চিন্ত হয়ে বলে, “আমার আর কোনো অসুখ নেই... সব তারাগুলি দেখতে পাচ্ছি... অন্ধকারের ওপারকার সব তারা।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ডাকঘর পড়াতে এসে মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষ শিখিয়েছিলেন, “এক আছে প্রত্যক্ষকাল, আর এক আছে ধারণাকাল। সুন্দরের বোধ হল এই প্রত্যক্ষকাল থেকে ধারণাকালে অবিরাম যাওয়া-আসা।... ঘটনাকে ছুঁয়েও এই ভাবে ঘটনার বাইরে আছে সময়ের দেশ... আমরা সকলেই কখনও-না-কখনও চলে যেতে চাই তার কাছে... মৃত্যুর অর্থে নয়, সুন্দরের অর্থে।”
ভ্যান গখ চলে যেতে পেরেছিলেন সেই সময়ের দেশে। মানসিক শুশ্রূষালয়ে থাকাকালীন নিজের শয়নকক্ষের পুবখোলা জানলা দিয়ে যে ‘বাহির’ দেখা যেত, তার দিকে তাকিয়ে দ্য স্টারি নাইট এঁকেছিলেন তিনি। ১৮৮৯ সালের জুন মাসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy