ইতিহাস: বাবরি মসজিদ, ১৮৮০ সাল। উইকিমিডিয়া কমন্স।
বাবরি মসজিদ বিধ্বংসের পর তিন দশক পেরিয়ে এসেছি আমরা। মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে যাতে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন হতে পারে। আশির দশকের শেষে ‘মন্দির ওহীঁ বনায়েঙ্গে’ রণহুঙ্কার দিয়ে যে অভিযান শুরু হয়েছিল, সেই অভিযান কি তা হলে শেষ হতে চলেছে? আজকের ভারতের দিকে তাকিয়ে এ কথা বোধ হয় কেউই আর ভাবতে পারছেন না। বরং আগামী দিনে এই অভিযান আরও কী রূপ ধারণ করতে চলেছে, ভারতের ভাগ্যাকাশে আজ সেই দুশ্চিন্তার কালো মেঘ।
অযোধ্যা বিবাদকে যদি কেউ কখনও স্থানীয় ও সাময়িক বিবাদ মনে করে থাকেন, তা হলে সেটা ছিল তাঁদেরই ভুল। সে ভুল এত দিনে না ভাঙার আর কোনও অবকাশ নেই। সত্যি বলতে, অযোধ্যা বিবাদ মোটেই কোনও স্থানীয় বিবাদ ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে গান্ধী হত্যার জেরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করেছিলেন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেল। সঙ্ঘ তখন খোলাখুলি ভাবেই ত্রিবর্ণ পতাকার পরিবর্তে গেরুয়া পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে এবং মনুস্মৃতিকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করার কথা প্রচার করত। সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে মেনে সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে তারা নিষিদ্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে। আর সে বছরেরই বাইশে ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে গোপনে মূর্তি রেখে দিয়ে সূত্রপাত ঘটানো হয় অযোধ্যা বিবাদের। সেই টাইম বোমার ধারাবাহিক বিস্ফোরণ আজও ঘটে চলেছে।
মন্দির নির্মাণের ঘোষণা ছাড়াও অযোধ্যা অভিযানের গোড়া থেকেই সঙ্ঘ পরিবারের দু’টি বক্তব্য বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। তাদের প্রথম কথা, রামজন্মভূমি হল আস্থার প্রশ্ন এবং আস্থার ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও এক্তিয়ার থাকতে পারে না। আইনের শাসনে আদালতের ভূমিকা সংবিধান-নির্ধারিত। আদালতের উপরে আস্থাকে স্থান দেওয়ার মানে কার্যত সংবিধানকে অস্বীকার করা। এই পথেই প্রকাশ্য দিবালোকে উত্তরপ্রদেশের তদানীন্তন রাজ্য সরকারের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত ভিড়ের যুক্তি দেখিয়ে বাবরি মসজিদকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
আদালত, আইন ও সংবিধানের উপরে আস্থাকে স্থান দেওয়ার এই জেদ যদি অন্য কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষ দেখায়, তা হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সঙ্ঘ পরিবার তাকে দেশদ্রোহ বা সন্ত্রাসবাদ বলে দাগিয়ে দেবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নামে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যখন এই কাজ করা হয়, তখন তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী আগ্রাসন নাম দিতে হয়, যাকে বিশ শতকের ইতিহাস ফ্যাসিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দ্বিতীয় কথা ছিল ‘অযোধ্যা সির্ফ এক ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়’। অর্থাৎ, অযোধ্যার পথেই কাশী এবং মথুরাতে মুসলিমদের দখলে থাকা বা ব্যবহার করা এলাকার দখল নেওয়া হবে। অযোধ্যার মতোই কাশী বা মথুরাও অবশ্য শেষ গন্তব্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার যাত্রাপথে এগুলি নিছকই মাইলফলক। কর্নাটকে মাইসুরুর কাছে টিপু সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্র শ্রীরঙ্গপত্তনমকে ঘিরেও অভিযান চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। নিশানায় রয়েছে তাজমহল ও কুতুব মিনারের মতো বিশ্বপ্রসিদ্ধ স্থাপত্যও।
ভারতের ইতিহাস যে সমস্ত উদাহরণকে ঐতিহ্য ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে স্থান দিয়েছে, সঙ্ঘ পরিবারের চোখে সে সবই হিন্দু ভারতের পরাধীনতার লজ্জাজনক নিদর্শন। ইতিহাসের এই স্মৃতি অপসারণের অভিযানকে ‘আইনসম্মত’ করে তুলতে ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থান আইনকেই বাতিল করার দাবি তুলেছে বিজেপি। আইনে বাবরি মসজিদকে ব্যতিক্রম হিসেবে রেখে অন্য সমস্ত উপাসনা স্থানের জন্য ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট তাদের যে পরিচয় ছিল, তাকে অপরিবর্তনীয় ও চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়ার কথা রয়েছে। এই আইন সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এখন কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত জানতে চেয়েছে।
সঙ্ঘ পরিবার যখন ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কথা বলে, তখন সাংস্কৃতিক বলতে তারা এই সর্বব্যাপী হিন্দু আধিপত্যের কথাই বোঝাতে চায়। আজকের একুশ শতকের ভারতবর্ষে তারা সনাতন ভারতীয় সভ্যতার নামে রামায়ণ-মহাভারতের যুগের পৌরাণিক কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে চায়। সেই পৌরাণিক কল্পনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনও অস্তিত্বই নেই। বিগত এক হাজার বছরের ইতিহাসে বৈচিত্র ও বিবিধতার মহামিলনের মাধ্যমে যে ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেই সমাহার থেকে যাবতীয় মুসলিম প্রতীক বা চিহ্নকে অবলুপ্ত করে কৃত্রিম হিন্দু আধিপত্যবাদী পরিচিতিকে চাপিয়ে দেওয়াই আজ সঙ্ঘ পরিবারের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ।
সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ বিধ্বংসকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেও বিধ্বংসী বাহিনীর হাতে মন্দির নির্মাণের জন্য জমির দখল তুলে দিয়ে আশা প্রকাশ করেছিল যে, দীর্ঘ বিবাদের অবসানের পর মৈত্রী ও সমন্বয়ের পথে সমাজ আবার এগিয়ে যাবে। বিশ্ব ইতিহাস বলে সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতেই সমন্বয় সম্ভব, বিধ্বংসী বাহিনীকে প্রশ্রয় দিয়ে তার মনোবল বাড়িয়ে সমন্বয় নয়, আরও বড় আগ্রাসনকেই কেবল উৎসাহিত করা সম্ভব। সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায়ের পর গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা তা আরও এক বার প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এ কথাও আজ বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে, এই উন্মত্ত আক্রমণ হয়তো শুধুমাত্র ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করেই ক্ষান্ত হবে না। এই অভিযানের আসল লক্ষ্য মনুস্মৃতিতে বর্ণিত ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিব্যবস্থা ও পুরুষতন্ত্রের অনুশাসনে ভারতীয় সমাজকে আবদ্ধ করে ফেলা। সেই সব লক্ষণই এক-এক করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। অযোধ্যা অভিযানের গতিপথ থেকে শিক্ষা নিয়ে এই সমস্ত অশনিসঙ্কেতকেও বুঝতে হবে। গুজরাত নির্বাচনের প্রাক্কালে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে সংবর্ধনা দিয়ে কারামুক্ত করা হল, নির্বাচনে গুজরাত গণহত্যার সব থেকে নৃশংস ঘটনা নরোদা পাটিয়া মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এক ব্যক্তির পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হল বিজেপির প্রার্থীপদ। অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্ট পুরনো হয়ে যাওয়ার সুবাদে বাবরি মসজিদ বিধ্বংস ও গুজরাত গণহত্যার যাবতীয় মামলার সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রতিশ্রুত বিচারের বাণী এখন শুধুই নীরবে নিভৃতে কাঁদবে।
বিগত লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সংবাদমাধ্যম ও জনমানসে ছেয়ে ছিল পুলওয়ামা ঘটনা ও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কাহিনি। ওই একই পর্যায়ে নির্বাচনের ঠিক আগে ও পরে সংবিধানের উপরেও দু’টি বড় সার্জিক্যাল আঘাত নেমে আসে। নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধন করে সমাজের আর্থিক দিক থেকে দুর্বল অংশের জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণের নীতি ঘোষিত হয়। আর দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার ঠিক পরেই অমিত শাহকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের অস্তিত্ব শেষ করে দিয়ে তাকে ভাগ করে দেওয়া হয় দু’টি কেন্দ্রশাসিত এলাকায়।
সুপ্রিম কোর্ট এখনও কাশ্মীর প্রসঙ্গ নিয়ে বিবেচনা করেনি। কিন্তু দশ শতাংশ সংরক্ষণের প্রশ্নে কোর্ট দ্বিধাবিভক্ত— শেষে দলিত, আদিবাসী ও ওবিসি অংশকে বাইরে রেখে তথাকথিত আর্থিক ভিত্তিতে সংরক্ষণের নীতিকে সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করাটা যে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বিনাশ করার সূচনা, সেটা বোঝার সময় এসেছে। উত্তরবঙ্গ থেকে বিহারের সীমাঞ্চল অংশে কেন্দ্রশাসিত এলাকা গঠনের চর্চাও জোরালো হয়ে উঠছে।
ভারতে হিন্দু রাজ যদি কখনও বাস্তব হয়ে ওঠে তা হলে তা হবে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়: আধুনিক ভারতের সংবিধান রচনাকালে এ কথা বলেছিলেন সংবিধান রচনা সমিতির সভাপতি ও পরবর্তী কালে স্বাধীন ভারতের প্রথম বিধি ও ন্যায় মন্ত্রী ভীমরাও আম্বেডকর। ১৯৯২-এর আগে ৬ ডিসেম্বরের প্রধান পরিচয় ছিল আম্বেডকরের প্রয়াণ দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে দিনটির নতুন পরিচয় যুক্ত হয়েছে, আম্বেডকরেরই সূত্র ধরে বলা যায় বিপর্যয়ের আগমন-বার্তা দিবস। এ বছর আম্বেডকরের ছেষট্টিতম প্রয়াণবার্ষিকীতে আমাদের হৃদয়ে থাকুক বাবাসাহেবের এই সতর্কবাণী এবং ভারতকে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার শপথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy