দীর্ঘ ভোটপর্ব শেষ, ভোট নিয়ে আলোচনাও স্তিমিত হয়ে আসছে। তাও, ভোটের ফলাফল নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে সেগুলোর উপর কিছুটা আলোকপাত করা যায়। তার কতকগুলো নিয়ে আজ এখানে আলোচনা করব।
প্রথম প্রশ্ন হল, দল বা জোটভিত্তিক হিসেবে ২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায় এই ত্রিমুখী প্রতিযোগিতায় কার ভোট কোন দিকে গেল? দলভিত্তিক ভোটের বিন্যাস দেখলে সবচেয়ে নজর কাড়ার মতো তথ্য হল এই— বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস, এই দুই দলের আসন শূন্যতে দাঁড়ানোয় প্রধানত লাভ হয়েছে তৃণমূলের, বিজেপির নয়। ২০১৬ সালে বামফ্রন্টের ৩২টা আসন ছিল, তার মাত্র ন’টা পেয়েছে বিজেপি, আর ২৩টা তৃণমূল। কংগ্রেসের ২০১৬ সালের ৪৪টা আসনের ১৫টা পেয়েছে বিজেপি, আর ২৯টা তৃণমূল। বিজেপি যে ৭৭টা আসন পেল, তার ৪৮টা গত বারে তৃণমূলের ছিল। অর্থাৎ, শাসক দলের বিরুদ্ধে তাদের প্রচার ব্যর্থ হয়েছে, বা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়া ছিল না, মোটেই বলা যায় না। তৃণমূল গত বারের ২০৯টা আসনের মধ্যে ১৬০টা ধরে রাখতে পেরেছে, তাই তাদের এ বারের সাফল্য মূলত এসেছে বামজোটের গত বারের ৫২টা আসনে জেতার ফলে।
তবে কি ‘বামের ভোট রামে’ যায়নি? নির্বাচন কমিশনের দেওয়া লোকসভা আসনের সংশ্লিষ্ট বিধানসভা আসনগুলির পাৰ্টিভিত্তিক ভোটের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমরা যদি ২০১৪ এবং ২০১৯-র নির্বাচনের ফলের তুলনা করি, বামফ্রন্টের হারানো আসনের থেকে বিজেপি ও তৃণমূল প্রায় সমান লাভ করেছে, যদিও তৃণমূল সামান্য এগিয়ে। অর্থাৎ, ‘বামের ভোট রামে’ যাওয়ার প্রবণতা ২০১৯-এর নির্বাচনে অবশ্যই খানিকটা কাজ করেছে, কিন্তু এ বার তার প্রভাব অনেক কম। মোদ্দা কথা, শাসকবিরোধী হাওয়া এ বার অবশ্যই ছিল, যার থেকে লাভ করেছে বিজেপি। কিন্তু এটা হয়েছে মূলত তৃণমূলের গত বারের আসন দখল করে, বিকল্প বিরোধীপক্ষ বামজোটের আগের বারের আসন দখল করে নয়। আর বামজোটের ভোট বিজেপির দিকে খানিক গেলেও মূলত গিয়েছে শাসক দলের দিকে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, মহিলা ও সংখ্যালঘু ভোটের কতটা প্রভাব পড়ল ফলাফলের উপরে? দিল্লির লোকনীতি সংস্থা থেকে যে নির্বাচন-পরবর্তী ভোটার সমীক্ষা হয় তার থেকে জানা যাচ্ছে, সেই সমীক্ষার নমুনায় অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের ৫০% তৃণমূলকে ভোট দেন, বিজেপিকে দেন ৩৭%। আরও উল্লেখযোগ্য হল এই তথ্যটি— মধ্য ও উচ্চবিত্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপির ভোট প্রায় সমান সমান, কিন্তু নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে এই ফারাক অনেকটা বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত হল যথাক্রমে ৪৬% ও ৪০%। ২০১৯ সালেও মহিলাদের ভোটের পাল্লা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে ছিল (পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায় সমান সমান), কিন্তু এ বার তার মাত্রা নিশ্চিত ভাবে বেশি।
নির্বাচনের ফলাফলে সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাব দেখার জন্যে আমরা ২০১১ সালের সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাতের সঙ্গে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের কোনও সম্পর্ক আছে কি না দেখেছি। প্রত্যাশিত ভাবেই, যেখানে এই অনুপাত কম সেখানে বিজেপির ভোট বেশি, আর যেখানে এই অনুপাত বেশি সেখানে তৃণমূলের ভোট বেশি। কিন্তু এই সম্পর্ক তো আগে থেকেই থাকতে পারে, এই নির্বাচনে কিছু পাল্টেছে কি? আমরা যদি ২০১৬ সাল আর ২০২১ সালে দলভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্যটা হিসেব করি, তার সঙ্গে জেলার জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাতের খুব সুস্পষ্ট সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা এই নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে ধরা যায়। এই অনুপাত যত বেশি, তত তৃণমূলের ভোটের অংশ বেড়েছে আর তা হয়েছে মূলত বামজোটের ভোটের অংশ গত বারের থেকে কমার জন্যে। এর উল্টোটাও সত্যি— হিন্দুদের অনুপাত যত বেশি, বিজেপির ভোটের অংশ বেড়েছে গত বারের তুলনায়, আর তা মূলত হয়েছে বামজোটের ভোটের অংশ কমার ফলে। অর্থাৎ, মেরুকরণের রাজনীতি এক দিক থেকে সফল— প্রতিযোগিতা দ্বিমুখী হয়েছে বামজোটের ভোটের ভাঁড়ার প্রায় নিঃস্ব করে। কিন্তু এই মেরুকরণের মশলা যথেষ্ট ছিল না— হিন্দুদের একটা বড় অংশ এ বারেও ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোট দেননি— সবচেয়ে হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোতেও বিজেপির ভোট ৫০% অতিক্রম করেনি। বরং, তাদের এই নির্বাচনী নীতি সংখ্যালঘু ভোট কার্যত তৃণমূলের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০১৬ এবং ২০১৯-এর সঙ্গে তুলনা করলে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটের এই বাড়তি লাভ, অন্তত মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের লোকসান করে।
তৃতীয়ত, নির্বাচনের শেষ দিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হারের বৃদ্ধির কি কোনও প্রভাব পড়েছে ফলাফলের উপর? মার্চের মাঝামাঝি রাজ্যে নথিভুক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল দিনে ১০০, আর মে-র গোড়ায় তা দাঁড়ায় দিনে ১৫,০০০। আসল সংক্রমণের হার নিশ্চয়ই এই পরিসংখ্যানের থেকে বেশি, কিন্তু তা হলেও এ এক অস্বাভাবিক রকমের বৃদ্ধির হার। আমরা যদি নির্বাচনের ফলের পর্যায়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করি, তা হলে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম পর্যায়ের পর থেকে তৃণমূলের ভোটের অংশ উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে শুধু না, বিজেপির ভোটের অংশ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। মনে হতে পারে যে, পরের দিকে যে আসনগুলিতে ভোট হয়েছে, সেগুলো হয়তো আগের থেকেই তৃণমূলের দিকে ঝোঁকা। কিন্তু আমরা যদি ২০১৬ সালে প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে তুলনা করি, তা হলেও ২০২১ সালে এই পরের দিকের ভোটে তৃণমূল বেশি মাত্রায় লাভবান হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে মোকাবিলা করেছে তা নিয়ে অসন্তোষ ছাড়া আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে এই তথ্যটির? কেউ ভাবতে পারেন যে, শীতলখুচির ঘটনাটি ঘটে নির্বাচনের চতুর্থ পর্যায়ে এবং তার ফলে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়ে থাকতে পারে। এখন, পঞ্চম পর্যায়ের পরের ভোটে তৃণমূলের অধিকতর এগিয়ে থাকার প্রবণতাটি সব জেলাতেই উপস্থিত ছিল, তাই কোভিড-১৯ সংক্রমণের বৃদ্ধির প্রভাব ভোটারদের প্রভাবিত করেছে বলেই আমরা মনে করি। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এই প্রবণতা মুসলিম-প্রধান জেলায় আরও খানিকটা বেশি কাজ করেছে, তাই অন্য উপাদানটি একেবারে অনুপস্থিত ছিল তা বলা যায় না।
লোকনীতি-র সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে কোন প্রশ্ন ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল— শুনে অবাক লাগতে পারে, বিশেষত নির্বাচনী প্রচার আর তা নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে— কিন্তু উত্তর হল ‘উন্নয়ন’ (৩৩%)। ভাবতেই পারেন, উন্নয়ন কোথায়— চারিদিকে তো শুধু দুর্নীতি আর খয়রাতির রাজনীতি! গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে কিছু গতানুগতিক ধারণা আছে, যেমন সারা দেশের তুলনায় এবং আগের দশকের তুলনায় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের শ্লথগতি, যার মূলে আছে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ না থাকার কারণে বিনিয়োগের অপ্রতুলতা। অনেক প্রথাগত ভাবনাচিন্তার মতো এর মধ্যে কিছু সত্যতা থাকলেও, তার থেকে যে ছবিটা উঠে আসে তা আংশিক এবং বিভ্রান্তিকর। আমাদের এক জন এই পাতাতেই সাম্প্রতিক কিছু লেখায় সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কিছু তথ্য প্রতিষ্ঠা করেছি, যার থেকে বেরিয়ে আসছে যে, এই জমানায় এই রাজ্য পুরোটা খয়রাতির খুচরো রাজনীতির উপর চলছে, এই ধারণাটি সত্য নয়। সারা দেশের তুলনায় রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে অর্থনীতির পরিস্থিতি কেন মন্দ নয় এবং কী ভাবে তা সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে, সত্যি ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’ বলে কোনও নির্দিষ্ট কাঠামো উঠে আসছে কি না, এই রকম অনেক প্রশ্ন ওঠে যা আরও খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা দরকার। কিন্তু এইটুকু পরিষ্কার যে, এই ভোটের ফলাফল বুঝতে গেলে, গ্রামীণ বাংলায় যেখানে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যবাসী বাস করেন, সেখানে কী হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। বামফ্রন্টের সাড়ে তিন দশক ব্যাপী নির্বাচনী সাফল্যের ভিতও কিন্তু ওই গ্রামীণ বাংলাতেই গড়ে উঠেছিল।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স; অর্থনীতি বিভাগ, মোনাশ ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy