নিজের চোখ বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কী ভাবে সম্ভব? সেই তেঁতুলগাছ। তার তলায় সেই বাঁশের তৈরি খাটিয়া। পা মুড়ে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ জাটা হেমব্রম। মাটিতে শুয়ে দুটো কুকুর। অদূরে শিমুল গাছ থেকে আঁকশি দিয়ে ফল পাড়ছে একটি মেয়ে, ফেটে তুলো উড়ে যাওয়ার আগে তুলে রাখতে হবে ঘরে। আরও একটু দূরে বাইহাড়— বহাল— জমিতে ইতস্তত জমে থাকা জলে মাছ খুঁজছে বাচ্চারা। জোয়ানরা এ দিক-ও দিক কাজে গিয়েছে— কেউ শহর বাজারে, কেউ বা নিজের খেতে, নতুন বছরের চাষের জন্য জমি তৈরি করে রাখার আশায়। কেউ কেউ চলে গিয়েছে দূর বিদেশে, বছরে এক বার ফেরে। কোনও কোনও মেয়ে পুরুষ গিয়েছে গরু-ছাগল নিয়ে— মানুষের যেমন, পশুদেরও খাবারের অভাব, চার দিকে শুকনো দীর্ঘশ্বাস। জাটা আর কাজ করতে পারেন না, সারা দিন শুয়ে থাকেন, কখনও কখনও কষ্টে উঠে বসেন। আর তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে বসে বাচ্চারা, ছোকরারা। তিনি গল্প বলেন। অফুরান তাঁর কথার ভান্ডার। আশ্চর্য, এই এত কাল পরেও, তিনি তেমনই আছেন। দেখতে দেখতে কয়েক জন জড়ো হল, গ্রামের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের গ্রন্থি জাটা হেমব্রম উঠে বসলেন।
না, সব কিছু তেমন নেই। কুড়ি বছরে অনেক কিছু বদলায়নি, ঠিক। ক্ষুধা বদলায়নি, অনাহার বদলায়নি, মাঠ-ঘাট ঘুরে খাবার জোগাড় করা বদলায়নি, জ্বর-জ্বালা, অকালে মারা পড়া, বদলায়নি। আবার অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। এই যেমন, আগুন বয়ে আনা বাতাসে ভর করে ছুটে আসছে মাইকের আওয়াজ, প্রবল হল্লায়, কিছু শোনা যাচ্ছে না। জাটা উঠে বসলেন, “কারা এত চিৎকার করছে?” ছেলেদের কোনও এক জন বলল “ভোটের মিছিল চলছে দাদু, তুমি তো সারা ক্ষণ শুয়ে থাকো, কিছুই শুনতে পাও না, দেখতে পাও না, ওই যে, নামোপাড়ায় মিছিল ঢুকেছে, শুনতে পাচ্ছ না, মাইকে বলছে, ‘ভোট দিন ভোট দিন’?” “কী বলছে, ভোট দিন? কিন্তু আমি তো শুনছি, বলছে, ‘খতম করো খতম করো’।” “তুমি বুড়ো হয়েছ, তাই কী শুনতে কী শোনো!” মাথায় কলসি, কাঁখে কলসি জল আনতে যাওয়া মেয়েটা হেসে বলল। জল আনতে যেতে হবে, সেই ও পাড়ায়, সারা গাঁয়ে একটাই চাপা কল চালু আছে, বাকি সব ‘ফুটুর ডুম’! ওই খিলখিল হাসি, ওই একটা খুব যেন মজার কথা বলতে পারা, এতেই সে মেয়ে বেঁচে থাকে। জাটা হাসেন, সবাই হাসে।
হাসি থামিয়ে জাটা কিছু ক্ষণ চুপ। তার পর বলেন, “বুড়ো হয়েছি ঠিক, কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, ওরা বলছে ‘খতম করো খতম করো’।” “না দাদু, ওরা বলছে, ‘ভোট দিন ভোট দিন’। ক’দিন পরেই ভোট, এখন একটা পার্টি ঢুকেছে, আবার কাল আর একটা পার্টি ঢুকবে, পরশু আর একটা, নিজের নিজের পার্টির জন্য ভোট চাইতে আসছে, শুধু মাইক না, ঢোলও আছে, বড় বড় বাজনা আছে।”
“আচ্ছা, ভোট চাইতে মাইক নিয়ে এসেছে কেন? মিছিল কেন? ওরা কারা? ওরা কি আমাদের গাঁয়ের লোক? আমাদের গাঁয়ের লোক হলে মাইক লাগবে কেন, চিৎকার করতে হবে কেন?”
“না, ওরা বাইরে থেকে এসেছে। আমাদের গাঁয়েরও কেউ কেউ ভিড়ে গেছে।”
মাথা নাড়েন জাটা, “আমি ঠিকই শুনেছি, খতম করো, খতম করো। দেখ বাপু, কে কাকে ভোট দেবে তা নিয়ে এত শোরগোল কেন? এই শোরগোলের মানেই কিছু একটা গন্ডগোল। কেন রে বাপু, আমাদের গাঁয়ের লোক কাকে ভোট দেবে, তা তারা নিজেরাই ঠিক করুক। আমরা তো সব কিছু নিজেরা ঠিক করে এসেছি। জন্ম হোক বা মরণ, বিয়ে হোক বা পুজো, শিকারে যাওয়া হোক বা বিচার— সব যদি আমরা এত বছর ধরে নিজেরা ঠিক করে আসতে পারি, তা হলে ভোট দেওয়ার ব্যাপারটা কেন ঠিক করতে পারব না?”
“দেখো, সে সব গ্রামের ব্যাপার, আর ভোট হচ্ছে, সারা রাজ্যের জন্য। আর যে যার ভোট নিজেরা দেবে, তাই গাঁয়ের লোক নিজেরা বসে কী করে ঠিক করবে? কে কাকে ভোট দেবে, সেটা কি গাঁয়ের মিটিং-এ বলবে?”
“আমিও তো সেই কথাই বলছি। কে কাকে ভোট দেবে সে ঠিক করবে, মাইক বাজিয়ে হাঙ্গামা করার দরকার কী? মিছিল করে চিৎকার করার দরকার কী? গাঁয়ের একটা বৈঠক করলেই হল, একটাই বৈঠক, পার্টির লোকরা বলুক তাদের কথা, গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-পুরুষ সবাই শুনুক, কোন পার্টি কী বলছে, তার পর নিজেরা ঠিক করবে, কে কাকে ভোট দেবে। এই যে মাইক বাজিয়ে, ঢোল বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটা কথা তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কী বলছে জানতে না পারলে লোকে ভোট দেবে কেন?”
“জানাবার জন্য তো মিটিং হচ্ছে, বড় বড় নেতা মন্ত্রীরা আসছে, বিরাট মাঠে হেলিকপ্টার নামছে, গাড়ি ছুটছে, হাজার লোককে ট্রাকে-বাসে করে মিটিং-এ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, নেতারা বক্তৃতা করে বলছে, তারা ভোটে জিতলে কী কী করবে।”
“সে তো আরও কেলেঙ্কারি! দেখ, আমাদের কাজ পড়লে আমাদের গিয়ে বিডিও অফিসে, পঞ্চায়েত অফিসে বসে থাকতে হয় কি না, এই তো কী একটা কাজের জন্য আমার নাতনিকে পর পর তিন দিন দৌড়তে হল, বিডিও বাবুর অফিসে। এই তো তোদের সামনে দিয়ে বাহামণি গেল জল আনতে, ওই অত্তো দূরে, ফিরতে ফিরতে বেলা ঘুরে যাবে। ওই যে কাল পাল্টনের বৌ পাতলা পায়খানা করে মরে গেল, হাসপাতাল তক নিয়ে যাওয়ার উপায় হল না, তার বেলা? ওরা আমাদের গাঁয়ের ধারেকাছে অন্তত হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা রাখত তা হলে তো বৌটাকে মরতে হত না। তা আমি বাপু সোজা বুঝি, অত বাঁকা ট্যারা রাস্তা চিনি না, আমার দরকারে আমাকে ছুটতে হবে ওদের কাছে, ছুটেও সব সময় ফল পাব না, তা হলে ওদের দরকারে ওরা আমাদের দুয়ারে আসুক। আমরা যুগ যুগ ধরে যেমন করে এসেছি তেমনই করব, সবাই এক সঙ্গে বসব, কথা শুনব, কথা বলব, যার যাকে ভোট দেওয়ার সে দেবে, তার জন্য সারা ক্ষণ তাকে হো-হাল্লা শুনতে হবে কেন, কেনই বা তাকে এই নেতা ওই মন্ত্রী আসছে বলে কাজ-কাম ছেড়ে মিটিং-এ যেতে হবে? আবার বলছি, ভোটটা ওদের দরকার, ওরা আসুক। আর হ্যাঁ, আসুক আসার মতো করে, ওমন হাঁকড় মেরে আসার কী হয়েছে? তুমি ভোট চাইছ না, দখল নিতে এসেছ?”
“দাদু, তুমি সেই পুরনো দিনে থেকে গেছ। এখন সব বদলে গেছে, গাঁয়ের ব্যাপারই গাঁয়ে ফয়সালা হচ্ছে না, তো গোটা রাজ্যের ভোট! কে গরিব, কে সরকারি বাড়ি পাবে, কে ভাতা পাবে, সব ঠিক করবে পার্টি, পার্টি অনেক বড় ব্যাপার, তাই সে আমাদের কাছে আসে না, আমাদেরকেই তার কাছে যেতে হয়। যে পার্টি জিতবে সেই পার্টি ঠিক করবে এই সব। তাই আমাদের পার্টির নেতাদের পিছন পিছন ঘুরতে হয়।”
জাটা কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকেন। তার পর ধীরে ধীরে বলেন, “তার মানে যে পার্টি জিতল, সে-ই রাজা, বাকিরা কিছু না? তা ধর আমি যদি একটা পার্টিকে ভোট দিই, আর সে পার্টিটা হেরে যায়, তা হলে সেই পার্টির দাম রইল না, মানে আমার আর কোনও দাম রইল না। কিন্তু সে তো বড় ভয়ের কথা, এ ভাবে কারও এত দাম বাড়ল, আর কেউ একেবারে ফালতু হয়ে গেল, এ ভাবে দেশ থাকবে কী করে? ধন রে আমার, তোরা ও সবে যাস না, আমরা যেমন ভাবে সবাই এক সঙ্গে থেকেও আলাদা আলাদা থাকবার সুখ পেয়ে এসেছি, সেটাই আমাদের ভাল।”
“এক সঙ্গে থেকে আলাদা থাকার সুখ!” কথাটা যেন তালুতে বাড়ি মারল, কুড়ি বছর আগে মারা যাওয়া জাটা হেমব্রম অদৃশ্য হলেন। স্বপ্ন ভেঙে গেল। এমন স্বপ্ন শাসকের কাছে দুঃস্বপ্নেরও বাড়া। যত বার ভাঙবে তার চেয়ে বেশি বার আমরা এমন স্বপ্ন দেখব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy