এলা ভট্টের প্রয়াণের পর সারা দেশ তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে। তিনি ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘সেবা’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, যা ভারত জুড়ে শ্রমজীবী মেয়েদের সংগঠিত করেছে, মেয়েদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক তৈরি করেছে। আমার অবশ্য মনে হয়, কেবল ‘সেবা’-র প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এলাকে দেখাই যথেষ্ট নয়। এলা ভট্ট (১৯৩৩-২০২২) স্বাধীন ভারতে মেয়েদের অবিসংবাদিত নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন, এটাই তাঁর সব চাইতে বড় পরিচয়। মেয়েদের তিনি এক নতুন পরিচিতি দিয়েছিলেন— কর্মীর পরিচিতি। মেয়েরা চিরকালই উদয়াস্ত কাজ করে এসেছে। তারা বরাবরই ভেবে নিয়েছে, স্ত্রী হিসাবে, মা হিসাবে, নিজের সংসারের জন্য বেতনহীন কাজ করে যাওয়াই তাদের কর্তব্য, দেশে বা সমাজে তাদের এটাই ভূমিকা। এলা ভট্ট সকলকে মনে করালেন, দেশের অর্থনীতিতে ঘরে ও বাইরে মেয়েদের কাজের মস্ত অবদান রয়েছে। তাই তাদের কর্মীর অধিকার ও মর্যাদা প্রাপ্য। সেই অধিকার দাবি করতেই তিনি মেয়েদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন খুলেছিলেন।
উন্নয়নের যে মডেল পঞ্চাশ-ষাটের দশকে উঠে এসেছিল, তার ভিত্তি ছিল আধুনিক শিল্পের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা, যার ভিত্তি নিয়মিত বেতনের পাকা চাকরি, নিয়োগকারী ও নিযুক্ত কর্মীর সম্পর্ক। ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও তারই প্রতিফলন দেখা যায়। তখন মনে করা হত, উন্নয়ন করতে হলে ওই শিল্পব্যবস্থার বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদেরকে ওই সংগঠিত ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এলা ভট্ট সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন, এক জন কর্মী যেখানে, যে ভাবেই কাজ করুক না কেন, সে কর্মী। তাকে কর্মীদের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধে দিতে হবে।
এলা মেয়েদের সংগঠিত করে তাদের ‘কর্মী’ বলে প্রতিষ্ঠা করলেন, তাদের কাজের আর্থিক মূল্য সকলের সামনে তুলে ধরলেন। তাতে উন্নয়নের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণাতেও বদল এল। সত্তরের গোড়ার দিকে কেনেথ হার্ট নামে এক অর্থনীতিবিদ আফ্রিকার দেশ ঘানা-র অর্থনীতি নিরীক্ষণ করে ‘ইনফর্মাল সেক্টর’ বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের ধারণাটি সামনে নিয়ে এলেন। এলার কাজ দেখার পর সেই গবেষণায় আমরা— ভারত ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিবিদরা— বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠলাম। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, আন্তর্জাতিক সংস্থা বা ভারতের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এনএসএসও) যে ভাবে কর্মীর ব্যাখ্যা দেয়, তাতে তাকে কোনও একটিই কাজে দিনের অন্তত অর্ধেকটা ব্যয় করতে হবে। অথচ, মেয়েরা সাধারণত এক সঙ্গে অনেক রকম কাজ করে— রান্না চাপিয়ে হাঁস-মুরগির দেখাশোনা করছে, আবার হয়তো একটা দোকানও চালাচ্ছে, কিংবা চাষের কাজ করছে। জাতীয় উৎপাদনে এ সব কাজের অবদান অনেকখানি, তবু মেয়েটি ‘কর্মী’ বলেস্বীকৃতি পাচ্ছে না। মেয়েদের কাজ নিয়ে এই বিতর্ক যখন চলছে, তখন ভারত সরকার তৈরি করল ‘শ্রমশক্তি কমিটি,’ যা সারা ভারতে মেয়েদের কাজের ধরন ও পারিশ্রমিকের পরিমাণ খতিয়ে দেখবে। এলা ছিলেন সেই কমিটির শীর্ষে। এই সময়ে এলা সারা ভারতে ঘুরে অনেক রকম পেশায় মেয়েদের কাজের ধরন, এবং মহিলা কর্মীদের সমস্যাগুলো লক্ষ করেছিলেন।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হল শ্রমশক্তি রিপোর্ট, যার অন্যতম রূপকার ছিলেন এলা। মেয়েরা কত রকম কাজই না করে— তারা মাছ ধরে, তাঁত বোনে, ফুটপাতে দোকান চালায়, লটারির টিকিট বিক্রি করে, চা পাতা তোলে, কাগজ কুড়োয়। কিন্তু উন্নয়নের রথ এই শ্রমজীবী, স্ব-উদ্যোগী মেয়েদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। তাদের সহায়তার নীতি, পরিকল্পনা, প্রকল্প, কিছুই তখন ছিল না। এমনকি যে কাজগুলি বরাবর পুরুষরা করে এসেছে, যেমন বীজতলা থেকে ধান তুলে জমিতে রোপণ, ডাল মাড়াই কিংবা পাথর ভাঙা— সে সব কাজ প্রচুর মেয়েও করেছে বরাবর। কিন্তু জনগণনায় মেয়েদের কেবলমাত্র ‘গৃহবধূ’ বলে লেখা হত। অত্যন্ত পরিশ্রম করলেও মেয়েদের কাজের উৎপাদনশীলতা কম, রোজগারও পুরুষদের তুলনায় কম।
একই সঙ্গে এলার নেতৃত্বে দরিদ্র মেয়েদের সঞ্চয়ে তৈরি ‘সেবা’ ব্যাঙ্ক দেখাল, মেয়েরা টাকা ধার নিয়ে শোধ দিতে পারে। গরিব মেয়েরও ঋণের প্রয়োজন হয়, অথচ ব্যাঙ্কের বাইরে থেকে অত্যন্ত চড়া সুদে ধার নিতে বাধ্য হতে হয় তাদের। ‘সেবা’ ব্যাঙ্ক গরিব, শ্রমজীবী মেয়েদের সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করল সারা দুনিয়ার কাছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক তার ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত কমিটিতে এলা ভট্টকে সদস্য করে নিল। ভারতেও মেয়েদের কাছে ক্ষুদ্রঋণ সংক্রান্ত সরকারি নীতির পথ তৈরি করেছিল এলা-প্রদর্শিত ‘সেবা’ সমবায় আন্দোলন, ‘সেবা’ ব্যাঙ্ক।
উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক বিজ্ঞান কী করে দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষের কাজে আসতে পারে, তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে, সে বিষয়েও এলা পথ দেখিয়েছেন। হকারদের ঠেলা গাড়ির উন্নত নকশা থেকে চাষের জন্য বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, সব রকম কাজে এলা যুক্ত করেছেন প্রযুক্তিবিদ ও বৈজ্ঞানিকদের। লখনউ-তে চিকনের কাজের জামাকাপড় উৎপাদনে নিয়ম হল, মেয়েদের ওয়ার্কশপে এসেই কাজ করতে হবে, বাড়িতে নয়। তাতে কাজের মান উন্নত হল, দামও মিলল বেশি।
এলা নিজে তাত্ত্বিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংগঠক, আন্দোলন নেত্রী, প্রতিষ্ঠান স্থপতি। কিন্তু তাঁর কাজের ভিত্তিতে গবেষক-অধ্যাপকরা বহু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন, নানা অভিনব অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করেছেন। আমাকেও এলা চিনতেন তাঁর কাজের এক জন মনোযোগী বিশ্লেষক হিসেবে। কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার সত্তরের দশক থেকেই আলাপ, নানা কাজের উপলক্ষে অনেক বার দেখা হয়েছে। কিন্তু ভাল করে আলাপ হয় নাইরোবিতে, ১৯৮৫ সালের একটি আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে। সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মেয়েরা দাবি করে, নারীবাদকে পুরুষ-বিরোধিতা বলে দেখে উন্নত দেশের মেয়েরা। তৃতীয় বিশ্বে মেয়েদের লড়াই পুরুষদের সঙ্গে নয়, পুঁজিবাদের সঙ্গে। ধারণাটা এসেছিল ল্যাটিন আমেরিকা থেকে। এলা আর আমি কিন্তু এই অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। আমরা একমত ছিলাম, পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার না পেলে পুঁজিবাদের পরাভবও মেয়েদের সক্ষমতা দিতে পারবে না।
আবার অনেক বিষয়ে এলা ভট্টের সঙ্গে আমার দ্বিমতও ছিল। কর্মজীবনের উপান্তে এলা এমন একটি ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেন, যেখানে একশো বর্গ মাইলের মধ্যে বাসরত মানুষেরা নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্যে পরস্পরের চাহিদা মিটিয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচবেন। বৃহত্তর বাজারের উপর তাঁদের নির্ভর করতে হবে না। আধুনিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে এমন ধারণা অচল। কিন্তু আজ আমার মনে হয়, এলা হয়তো বুঝেছিলেন, বৃহৎ পুঁজি দরিদ্রের জীবিকা অর্জনের সমস্ত উপায় ধ্বংস করে দিয়েছে। পুঁজিবাদ কিছুতেই দরিদ্রকে তার নিজস্ব সমাজ-পরিমণ্ডলে বাস করতে দেবে না। তাই এমন বিকল্পের কথা ভেবেছিলেন যেখানে মানুষের জীবিকা হবে প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সখ্যপূর্ণ, সমাজ-জীবন তৈরি হবে নিজেদের শ্রম ও সংগঠিত উদ্যোগের ভিত্তিতে। রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী থেকে এলা ভট্ট, গরিবের মর্যাদার সন্ধান সকলকেই নিয়ে গিয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও স্বনির্ভরতার ধারণায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy