Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
দুর্দশা যাঁদের দমাতে পারেনি
Job

নারীর কর্মসংস্থানে অনেক বেশি আঘাত হেনেছে অতিমারি

মহিলারা কাজ করেন মূলত অসংগঠিত শিল্পে, যা অতিমারি ও লকডাউনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:২৮
Share: Save:

দুর্দশার পাহাড়ের খনন চলছে অবিরাম, আর যে সব তথ্য তাদের দেহাবশেষ নিয়ে সামনে আসছে, তাদের নৈরাশ্য-সূচকও কিছু কম নয়। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এবং রয়টার্সের সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, করোনাকালে কর্মরত মহিলাদের উপর অভিঘাত এসেছে অনেক বেশি। কর্মরত পুরুষদের বেকারত্বের হার ১২.৬%, আর মহিলাদের বেকারত্বের হার প্রায় ২০%। এ ছাড়া বেতন হ্রাসের শতকরা হিসাবও পুরুষদের অনুপাতে প্রায় দেড় গুণ। মহিলাদের কর্মসংস্থান এই মুহূর্তে ভারতে ১৫.৫%, যা ১৯৯০ সালেও ছিল ৩০%।

অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। বুঝতে অসুবিধে নেই, মহিলাদের কর্মসংস্থানে অসংগঠিত শিল্পের প্রাধান্যই এই প্রতিকূল অবস্থানের সম্ভাব্য প্রধান কারণ। মহিলারা কাজ করেন মূলত অসংগঠিত শিল্পে, যা অতিমারি ও লকডাউনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতে অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কিত এক সমীক্ষা বলে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করতেন গ্রামীণ মহিলাদের এক বড় শতাংশ, কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময় ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’ অর্থাৎ অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের আবার গ্রামে ফিরতে বাধ্য হওয়ার ফলে কাজ হারান বহু মহিলা। দ্বিতীয় ঢেউ-এর পরে প্রতিষেধক নেওয়ার আবশ্যিক শর্ত আর একটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামীণ পরিষেবায় অপর্যাপ্ত টিকা-গ্রহণের সুযোগ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের জন্য আরও একটি বাধা, যা তাঁদের কাজে ফেরা প্রায় অসম্ভব করে তোলে।

তাই অসংগঠিত শিল্পে মহিলাদের কর্মক্ষয় হয় খুব বেশি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এবং রয়টার্সের সমীক্ষা এ কথাও বলছে যে, পরবর্তী কালে মহিলাদের আবার কাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের অনুপাতে ১১ গুণ বেশি। এই ধরনের অসংগঠিত শিল্প, যেমন হসপিটালিটি বা সেবামূলক ক্ষেত্র, হোটেল রেস্তরাঁ ইত্যাদি এক বার ঘা খাওয়ার পর আবার সমান ভাবে ফিরে আসার সম্ভাবনা যেমন কম, তেমনই কম সেই সব শিল্পে মহিলাদের পুনর্বহাল হওয়ার সিদ্ধান্ত।

তবে এই বিষাদমাখা ছবি যে শুধু আমাদের, এমন নয়। প্রথম বিশ্ব একই আয়না দেখায়। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল উইমেন্স ল সেন্টার’-এর সমীক্ষা দেখায়, সে দেশেও অতিমারির ফলে কর্মসঙ্কোচনের মূল অভিঘাত হয়েছে অসংগঠিত শিল্পে এবং সেই একই সূত্র ধরে মহিলাকর্মীদের উপর তার কোপ পড়েছে অনেক বেশি। অতিমারির পর সে দেশে কর্মরত মহিলা আছেন মাত্র ৫৭%, যা ১৯৮৮ সালের পর সব থেকে নিম্নমুখী পরিসংখ্যান। ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১-এর মধ্যে ২৩ লক্ষ মহিলা চাকরি হারিয়েছেন, যেখানে কাজ-হারানো পুরুষদের সংখ্যা ১০ লক্ষ। এই সমীক্ষায় ক্ষেত্রভিত্তিক বিভাজন ছবিটিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। যে কোনও সেবামূলকক্ষেত্র যেমন রেস্তরাঁ, কফিশপ ইত্যাদি এই অতিমারিকালে ব্যাপক হারে বন্ধ হয়ে যায়। বহুজাতিক সংস্থার খুচরো বিক্রয় সংস্থা বা রিটেলিং চেন-এও কর্মসঙ্কোচন ঘটে গোটা দেশ জুড়ে।

তথ্য শুধু এই পর্যন্ত বলেই থেমে যায় না। আরও গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। কর্মসংস্থানের সুযোগ-হারানো এই মহিলাদের এক বর্ণভিত্তিক বিভাজনও স্পষ্ট করে তোলে। এই ছবি পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, কাজ-হারানো, মাইনে কমে যাওয়া এই মহিলারা অধিকাংশই জন্মসূত্রে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার বসবাসকারী বা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক। এই অতিমারির ফলে উপরোক্ত বর্ণবিভাজনে মহিলাদের একটা বড় অংশ ফেডারাল পভার্টি লাইন-এর (আমেরিকার দারিদ্রের মাপকাঠি) তলায় অবস্থান করছেন। যে ভাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষার ক্ষেত্রে মহিলা ও অসংগঠিত শিল্পের যোগাযোগ ছিল প্রধান বিশ্লেষণকারী, কারণ, আমেরিকার ক্ষেত্রে সেবাভিত্তিক বা হসপিটালিটিক্ষেত্র, রিটেলিং চেন, কফিশপ, রেস্তরাঁয় কাজ করা মহিলাদের অধিকাংশের বর্ণভিত্তিক আঙ্গিকই কারণ হয়ে ওঠে অতিমারির কর্মসঙ্কোচনে তাঁদের প্রতিকূল ভাবে প্রভাবিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে।

অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে, এ সমস্যা আসলে দ্বিস্তরীয় শ্রমের বাজারের সমস্যা। শ্রমের বিক্রিবাটা হয় যে বাজারে, সেখানে শ্রমিকদের দুই ভাবে চিহ্নিত করা যায়— প্রাথমিক বা প্রথম পর্যায়ভুক্ত (প্রাইমারি লেবার) ও দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত (সেকেন্ডারি লেবার)। অর্থনীতির নিয়ো-ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব বলে, মহিলারা দ্বিতীয় প্রকার শ্রমের অংশে পড়েন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মহিলাদের পেশাগত পরিবর্তন বা নতুন পেশায় প্রবেশ হতে পারে সাময়িক বা দীর্ঘকালীন— শর্তসাপেক্ষে। অতিমারি একটা সাময়িক কারণ, সন্দেহ নেই। দীর্ঘকালীন পর্যবেক্ষণের জন্য সময়রেখা বা টাইমলাইন-এর সহায়তায় তুলনামূলক পর্যালোচনা প্রয়োজন।

এ বার ফলাফলের দিকে তাকাই? কী করবেন এই কাজ হারানো, মাইনে কমে যাওয়া, চাকরি ফিরে না পাওয়া মহিলারা? এ ক্ষেত্রেও কি দেশ ও বিদেশের আয়না একই ছবি দেখাবে?

অবাক করা উত্তর হল, হ্যাঁ।

হাল ছাড়েননি মহিলারা, দুই প্রান্তেই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা বলছে ৪৩% মহিলা কাজ হারানোর পর শুরু করেছেন নিজের ব্যবসা। কাজ ফিরে পাওয়ার বা আবার পুরনো মাইনে পাওয়ার আশা হয়তো রেখেছেন, চেষ্টা ছাড়েননি। আরও একটি তথ্য সামনে আসে এই প্রসঙ্গে। অতিমারির ঠিক আগে শুরু হওয়া ব্যবসাগুলির ক্ষয়ক্ষতিও মহিলারা সামলাতে পেরেছেন অনেক বেশি, পুরুষ ব্যবসায়ীরা বিস্ময়কর ভাবে কম। ৮৩% মহিলা পরিচালিত ব্যবসা প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে, পুরুষ পরিচালিত ব্যবসার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা মাত্র ৫৭%।

আমেরিকায় কাজ হারানো মহিলারা তাঁদের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের নতুন শুরু করা ব্যবসায়। গাস্টরের সমীক্ষা বলছে, পুরুষদের থেকে ৪০%-এর বেশি মহিলা অতিমারির সময় নিজের ব্যবসা খুলেছেন। বিলেতের ক্ষেত্রেও ৫০%-এর বেশি মহিলা পুরুষদের অনুপাতে ব্যবসা শুরু করেছেন। দুই দেশেই ব্যবসার ধরন ও ব্যবসা শুরু থেকে ব্যবসা-কারী মহিলাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্যও পাওয়া যায়। মূলত দু’ধরনের ব্যবসা— জামাকাপড় সংক্রান্ত, এবং অ্যাপ তৈরি ও ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যবসাতেই ভরসা রেখেছেন নতুন ভাবে পথ চলতে শুরু করা মহিলারা। আমরা আগেই লক্ষ করেছি, এঁদের অধিকাংশই এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা বা কৃষ্ণনাগরিক। সঙ্কটকালে প্রান্তিক মানুষেরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, সাহস রাখেন— ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়।

দেশেবিদেশে মেয়েরাও প্রমাণ করছেন, বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদেরও মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস আছে। নিজের কাজের সুযোগ নিজে তৈরি করে তাঁরা গ্রাসাচ্ছাদনের চেষ্টা করছেন। অর্থনৈতিক তত্ত্বকে দাঁড় করাচ্ছেন প্রশ্নের সামনে, কখনও উত্তর দিচ্ছেন নিজেরাই। নির্মাণ ও পুনর্নিমাণ হয়ে চলেছে অবিরত। ইতিহাস, অতিমারির ইতিহাস, দেশে এবং বিদেশে— সাক্ষ্য গ্রহণ করল তারও।

অন্য বিষয়গুলি:

Job harassment Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy