নিতান্ত দুর্দশাগ্রস্ত এক শ্বশুরমশাই নাকি জামাইষষ্ঠীতে চিঠি লিখেছিলেন, “বাবাজীবন, গত বছর কিছুই দিতে পারি নাই, এ বছর তাহাও দিতে পারিব না।” ২০২১ সালে ভারতে গরিবের দশা নিয়ে বলতে গেলে তেমনই কাতরোক্তি বেরিয়ে আসে। গত বছরই অতিমারির কোপে খেটে-খাওয়া মানুষেরা সঞ্চয়শূন্য, কর্মহীন ‘বেনিফিশিয়ারি’-তে পরিণত হয়েছিল। এ বছর পড়েছে পোঁচের উপর পোঁচ— এত বেশি বেকার যে মজুরি কমছে, এত কম পড়ুয়া যে স্কুল উঠে যাচ্ছে, এত কম ক্রেতা যে মাল তুলছেন না বিক্রেতারা, এত কম চাহিদা যে উৎপাদন বন্ধ করেছে মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী, স্বনিযুক্ত শিল্পী-কারিগর, ছোটখাটো কারখানা। সংসার চালাতে গরিব মানুষ বহু দিনই চার-পাঁচ রকম কাজ করেন— সকালে দিনমজুরি তো দুপুরে পাড়ার দোকানের ফাইফরমাশ, বিকেলে ছোটখাটো জিনিস ফেরি। এ বছর সে সব কাজও সহজে মিলছে না। যাঁরা দরিদ্র ছিলেন না, এ বছর দরিদ্র হয়েছেন, এমন মানুষ বিশ্বে অন্তত আট কোটি, বলছে বিশ্বব্যাঙ্ক। তার মধ্যে কত ভারতীয়, জানে না ব্যাঙ্ক— ভারত সরকার দেশের মানুষের আয়ের তথ্য দেয়নি তাকে। মনের চোখে দেখা যায়, সরকার দেশবাসীকে জামাই-আদরে চিঠি লিখছে, “বাবাসকল, গত বছর বাড়ি ফিরিবার পথে কে কত মরিয়াছ বলিতে পারি নাই, এ বছর বাড়ি ফিরিয়া কে কত মরিলে, তাহাও বলিতে পারিব না।”
সরকার সুবিধেমতো অন্ধ সাজতে পারে, নাগরিকের চোখ খোলা। রাজ্যের দক্ষিণে তাকালে দেখা যায়, এ বছর আরও লোক গিয়েছে বাঘের পেটে, আরও বেশি মেয়ে-পুরুষ বাগদা ধরতে নেমে পড়েছে নদীতে। ধান ডুবেছে, মাছ ভেসে গিয়েছে, বাজার মুখ ঘুরিয়েছে, দুটো টাকার জন্য জলে-জঙ্গলে ফিরে যাচ্ছে মানুষ। হুগলি নদীর পুবে সার সার ইটভাটা, বছরভর ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে। ইটের চাহিদায় ভাটা, উৎপাদন কম, মজুরি কমিয়েছে মালিকরা। বসিরহাট, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জের অন্তত দেড় লক্ষ শ্রমিকের একটা বড় অংশ অন্ধ্র-তামিলনাড়ুর ভাটায় চলে গিয়েছেন। যাঁরা ঘরে রয়েছেন, তাঁরা এ বছর বর্ষায় নেওয়া দাদন শোধ করতে না পারলে আগামী বছর দাদন পাবেন না, অনাহারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। “আমি প্রায় পঁচিশ বছর এখানে ট্রেড ইউনিয়ন করছি, দাদন শুধতে না পারার ভয় দেখছি এই প্রথম,” বললেন কৃষ্ণকান্ত ঘোষ। হুগলির পশ্চিমে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে চটকল— দুর্নীতির পচন আরও ছড়িয়েছে অতিমারির আঘাতে। বছর পাঁচেক আগেও যে শিল্প চল্লিশ লক্ষ চাষি, চার লক্ষ শ্রমিকের ভরসাস্থল ছিল, স্রেফ কাঁচা পাটের মজুতদারিতে তা প্রায় অর্ধেক হতে বসেছে এ বছর। কাজ হারিয়েছেন অন্তত এক লক্ষ শ্রমিক। নদিয়া-মুর্শিদাবাদে তাঁত চালিয়ে, বিড়ি বেঁধে হাতে আসছে আগের চাইতে কম টাকা। সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমানে কাটোয়ার দু’টি গ্রামে অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর মনে হয়েছে, গ্রামের মানুষ নিজেদের স্বপ্নের ছোট গণ্ডিকে আরও ছোট করে নিয়ে আসছেন। “এই মুহূর্তে চরম কষ্টে রয়েছি আমরা”— বলেছেন তিনি।
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে— মগডালে উঠেছে বাজারদর। সুলভ জ্বালানির স্বপ্ন কাঠকুটোর সঙ্গে উনুনে গুঁজে দিয়েছে মেয়েরা। রেশনের কেরোসিনে এ বছর ভর্তুকি উঠল। গ্যাসের দাম প্রায় হাজার টাকা, সর্ষের তেল, ডাল গরিবের সাধ্যের বাইরে। সারা বিশ্বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, বলেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। অতিমারি শুরুর পরে তা শিখর স্পর্শ করেছে এ বছর সেপ্টেম্বরে। খিদে পেটে শুতে যাচ্ছে বিশ্বের সাত-আট কোটি মানুষ। খাদ্য কেনার ক্ষমতার বিচারে ভারত পাকিস্তানেরও পিছনে, বলছে অক্টোবরে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট।
সরকারি সমীক্ষাও বলছে, অপুষ্টি বাড়ছে। অর্ধেকের বেশি মেয়ে রক্তাল্পতায় ভুগছে, তিন জন শিশুর এক জন অপুষ্টির জন্য লম্বায় বাড়েনি, বলছে এ বছরে প্রকাশিত পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা। মানে, একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি মিটবে না। কারণ, গত বছর যে কিশোরীদের বিয়ে হয়েছিল, তারা এ বছর সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। শিশু সুরক্ষা নিয়ে কর্মরত সমাজকর্মী প্রবীর মিশ্র বলেন, “কেবল কুলতলি ব্লক হাসপাতালেই যত নাবালিকা এ বছর প্রসব করেছে, বা গর্ভবতী অবস্থায় মাতৃত্ব কার্ড পেয়েছে, তাদের সংখ্যা অন্তত একশো।” নানা জেলা থেকে যেমন খবর আসছে তাতে স্পষ্ট, কন্যাশ্রী প্রকল্প দিয়ে নাবালিকা বিবাহ, অকালমাতৃত্ব কমানো যাবে, এই প্রত্যাশায় বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে ২০২১। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য, দারিদ্রমুক্তির এই দুই প্রধান স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে গেল এ বছর।
সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের প্রধান হাতিয়ার দুটো, একশো দিনের কাজ আর রেশনে চাল-গম বিতরণ। যত চাল-গম ভারত সরকার এ বছর চাষিদের থেকে কিনেছে, গুদামে রেখেছে এবং বণ্টন করেছে, ভারতের ইতিহাসে তা সর্বাধিক। সন্দেহ নেই, দরিদ্র, নিম্নবিত্তরা বিনামূল্যে রেশনের ভরসাতেই রাতে ঘুমোতে পারছে। তবু নাগরিকের খাদ্যের অধিকার পূর্ণ মর্যাদা পেল কি? এ বছর পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ মাস বন্ধ ছিল অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, শিশুদের পুষ্টিকর খাবার জোটেনি। স্কুলের মিড-ডে মিল হয়ে দাঁড়িয়েছে চাল-আলুর প্যাকেট। বিনামূল্যে ওষুধের জোগান কমেছে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে। খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার, তথ্যের অধিকার, সবের উপরেই বসেছে শর্ত— থাকলে পাবে, না হলে নয়। ইচ্ছা হলে দেব, না হলে নয়। নাগরিকের অধিকারের চাইতে প্রশাসনের ইচ্ছাকে বড় হয়ে যেতে দেখল এ বছরটাও।
সে কথাটা সব চাইতে বেশি টের পাওয়া গিয়েছে কোভিড টিকাদানে। জীবনের অধিকার আছে সব নাগরিকের, সেখানে অন্তত সবাই সমান, তাই সকলে একই শর্তে টিকা পাবে— এমন আশা কি দেশবাসী করেননি? কিন্তু টিকাকরণ শুরু হতেই দেখা গেল বিচিত্র কত নিয়ম। শেষ অবধি ধনী, শহরবাসী আর পুরুষরা চটপট টিকা পেয়ে গেলেন, পিছিয়ে রইলেন গরিব, গ্রামবাসী আর মহিলারা। শুধু টিকা না পাওয়ার জন্যই বাংলার অগণিত মেয়ে বাদ পড়ে গেল সেই কর্মক্ষেত্র থেকে, যেখানে মেয়েদের নিয়োগ সর্বোচ্চ— গৃহ পরিচারিকা। কেউ তাঁদের ক্ষতির খবর রাখেনি। কে রাখবে কাজ হারানোর তথ্য, যে দেশে প্রাণ হারানোর খবর দিলে মামলা করা হয় সাংবাদিকের নামে? অতিমারিতে প্রাণ হাতে কাজ করেও রাজ্যের আশাকর্মীদের আজ আট মাসের টাকা বকেয়া। এনআরজিইএ প্রকল্পের কাজ করে যথাসময়ে মজুরি পাননি দেশের একাত্তর শতাংশ মজুর। যে সুরক্ষা অধিকার-পূরণে মেলে না, মেলে শুধুই অনুদান-বিতরণে, তা কাকে সুরক্ষিত করে?
প্রান্তিকের সুরক্ষায় এ বছর পিছু হটেছে নাগরিক সমাজও। গত বছর আমপান-বিধ্বস্ত এলাকায় প্রচুর নাগরিক সংগঠন গিয়েছিল ত্রাণ নিয়ে, এ বছর ইয়াসের পরে তুলনায় কম। অক্টোবরের অতিবৃষ্টির পর তাদের অনুপস্থিতিই চোখে পড়ল বেশি। চরম দুর্দশা আড়াল হয়ে রইল, বহু চাষি খেতমজুরি করতে চলে গেলেন ভিনরাজ্যে। তত দিনে হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন, শাসক দল সুরক্ষিত। আর বাংলার মেয়ে-পুরুষদের দল বাসে চেপে চলেছে অন্ধ্র কি কর্নাটকে, মজুরি করতে। সংবাদের ভাষায় এই বিচিত্র ছবি ঠিক আঁটে না। চাই ছড়ার চলনটি— এ তো বড় রঙ্গ জাদু, এ তো বড় রঙ্গ/ চার অবাক দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ/ অবাক ভোট, অবাক জোট, মকুব ঋণের রাশি/ সবার চেয়ে অবাক জাদু গরিব লোকের হাসি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy