অতিমারি-জর্জরিত দেশগুলোতে কবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে, কেউ নিশ্চিত নন। ধীরে ধীরে যে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে, সেটা স্বাভাবিক। তবে, সমস্যা যে শুধু অতিমারির কারণেই হয়নি, কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ভারতীয় অর্থনীতি যে ধুঁকছিল, সেটা মনে রাখা প্রয়োজন।
এ কথা সর্বৈব সত্য যে, মাথাপিছু জাতীয় আয় এবং জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার, দুটোতেই ভারতের বিপদ চোখে পড়ার মতো। এই প্রসঙ্গে চিনের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের অবস্থা আরও ভাল ভাবে বোঝা যাবে। তুলনাটি অন্যায় নয়— কারণ, বহু ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কর্তারাই চিনের প্রসঙ্গ টানেন। গত দু’দশক ধরে— কোভিড অতিমারির আগে পর্যন্ত— দুটো দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগের হার নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন। কারণ একটাই— বিনিয়োগের হার জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারকে নির্ধারণ করে। আর, যেখানে বছর বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে তেমন পরিবর্তন হয় না, সেখানে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার মাথাপিছু আয়ের হার নিশ্চিত করে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের আলোচিত তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চিনে বিনিয়োগের হার বেড়েছিল ৩২ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশের মতো। অর্থাৎ, বিশ বছরে দশ শতাংশ। আমাদের দেশে বেড়েছে তিন শতাংশের মতো— ২৬ শতাংশ থেকে ২৯ শতাংশ। তবে মাঝে বেশ কয়েকটা বছর এই হার খানিকটা বেড়েছিল। কিন্তু ২০১৩ থেকে ক্রমাগত নেমে এসে এখন বিনিয়োগের হার ২০০১ সালে যেমন ছিল, তেমন। দু’দশক ধরেই আমাদের বিনিয়োগের হার চিনের চেয়ে মোটামুটি ৮-১০ শতাংশ-বিন্দু করে কম। যদি এ দেশে বিনিয়োগের হার চিনের ধারে কাছে না যায়, তা হলে মাথাপিছু জাতীয় আয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কিছুতেই বাড়বে না। অর্থাৎ, বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার না বাড়া, এ দেশের দীর্ঘকালীন চরম ব্যর্থতার নজির। কোনও ধরনের রূপচর্চা আমাদের অর্থনীতির স্থবির ও গলিত চেহারাকে ঢাকতে পারছে না।
আরও কিছু ভয়ের কথা বলি। গত বিশ বছরে, অর্থাৎ ২০০০ থেকে ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত, সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ মোটামুটি জাতীয় আয়ের শতকরা সাত শতাংশে আটকে আছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ তিন শতাংশের মতো বেড়েছে। সরকার তিন শতাংশ, এবং বেসরকারি উদ্যোগপতিরা ২১ শতাংশের মতো বিনিয়োগ করেছেন ২০১৮ সালে— দুইয়ে মিলিয়ে ২৮ শতাংশ। আর চিনে সেই বছর বিনিয়োগের পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৪২ শতাংশ। এই ফারাকটা কোভিডের জন্য নয়। তাই কোভিড প্রস্থান করলেও এই ফারাকটা থেকে যেতে পারে। শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ ছাড়া ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়বে না। ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি এবং তৎসম্পর্কিত পরিষেবার উন্নতি চোখে পড়ার মতো। অন্য দিকে, শিল্পের অবস্থা শোচনীয়।
২০০০ সালে জাতীয় আয়ে শিল্পের অনুপাত ছিল ২৭ শতাংশ, ২০১৯-এ ২৪ শতাংশ, ২০১১-য় বেড়ে ৩০ শতাংশে পৌঁছনোর পর থেকে ক্রমাগত কমতে কমতে ওই ২৪ শতাংশে এসে ঠেকেছে। চিনেও এটা কমে এসেছে ৪৫ শতাংশ থেকে ৩৮ শতাংশে, অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে ১৪ শতাংশ-বিন্দুর ফারাক। আর এটা হচ্ছে শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের অনীহার জন্য। যে দেশ আমাদের চেয়ে নিজেদের রোজগারের ১৪ শতাংশ বেশি বিনিয়োগ করে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। আমরা বিনিয়োগ করি না, এটাই সমস্যা। তাই দেশের বিনিয়োগের পরিমাণ এক ধাপে অনেকটা না বাড়ালে এবং যত ক্ষণ পর্যন্ত শিল্প জাতীয় উৎপাদন বা আয়ের অন্তত ৩০ শতাংশ না হচ্ছে, তত ক্ষণ অন্য কোনও অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক নিয়ে লাফালাফি একেবারেই অবান্তর। শিল্প ছাড়া এ দেশের কোটি কোটি স্বল্পশিক্ষিত, স্বল্পদক্ষ সাধারণ কর্মীর চাকরির সুযোগ নেই। আর এঁদের মধ্যে এক বৃহদংশ কমবয়সি।
এ বারে পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে আসি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারা দুটো— আয় বৃদ্ধি; এবং বৈষম্য দূরীকরণ, বা দারিদ্র ও অসম বণ্টনপ্রক্রিয়া হ্রাস করা। সম্প্রতি অনেকের লেখায় এ ব্যাপারগুলো স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক আয়বৃদ্ধি অন্তত গত দশ বছরে ভারতীয় গড়ের চেয়ে বেশি নয়, এবং পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় অনেক রাজ্যের চেয়েই কম। বেশ কিছু দিন ধরেই এই পিছিয়ে পড়া নিঃসন্দেহে একটি বড় সমস্যা। তা ছাড়া ভারতীয় গড় মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বিশেষ ভাবে অপমানকর। কেন কোনও কোনও রাজ্য মাথাপিছু আয়ে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি সফল, সেটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সমগ্র ভারতের যে অসুখ, এখানেও তাই। এখানেও প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং অবশ্যই অনেক স্বল্পদক্ষ মানুষের কর্মোপযোগী শিল্পের প্রয়োজন। এক অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক সময় রাজনীতি অর্থনীতির হাত ধরে হাঁটে না, যদিও তত্ত্বের খাতিরে ভাবা হয় যে, অর্থনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি করবে। ভারতের ক্ষেত্রে বহু দিন ধরে রাজনীতির রং ব্যতিরেকে বিনিয়োগহীনতা এবং শিল্পহীনতার সমস্যা রাজনীতিকে বিরক্ত করেনি, পশ্চিমবঙ্গেও করছে না।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আজ প্রমাণিত যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বিতীয় ধারাটি অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশ শক্তপোক্ত। পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য, দরিদ্রের জন্য, বেশ কিছু প্রকল্প অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। কৃষিক্ষেত্রে আয় দেশের অনেক জায়গার চেয়ে ভাল ফল করেছে। কিন্তু সরকারি রোজগার, কর আদায় এবং শিল্পে বিনিয়োগ বিশেষ ভাবে না বাড়লে সামগ্রিক আয়ের উন্নতি হওয়া শক্ত। সরকার বেশি রোজগার না করলে, রাজস্ব আদায় না বাড়লে জনহিতকর প্রকল্পে খরচা করে উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করার টাকা থাকবে না। ফলে, এ দেশের মতো সরকারি কার্যকর বিনিয়োগের অনুপাত বাড়বে না।
পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা বেশি শিক্ষিত, বেশি মেধাবী, বেশি দক্ষ ছেলেমেয়েদের এখান থেকে চলে যাওয়ার। অর্থনীতির শিক্ষা বিশ্বাস করে না যে, ঘরের উঠোনের পাশেই আমাকে সারা জীবন চাকরি করতে হবে। কিন্তু এটাও মানতে পারে না যে, চাকরির কথা ভাবলেই তাঁরা রাজ্যের বাইরে ছুটতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ, খানিকটা উচ্চমানের জীবনযাত্রার প্রতিশ্রুতি দিতে এ রাজ্য পারছে না। এটা বড় অর্থনৈতিক সমস্যা। সরকারকে বিশেষ ভাবে এ সব নিয়ে ভাবতে হবে। বাঙালি ছেলেমেয়েরা এ দেশের অন্যান্য জায়গায় অত্যন্ত সফল। কিন্তু নিষ্ক্রমণ কেন জীবনের মূল উদ্দেশ্য হবে? দেশের বেশ কিছু জায়গায় এই হতাশা দেখা যায় না। আজ যখন উন্নয়নের দ্বিতীয় ধারাটি এ রাজ্যে বেশ উজ্জ্বল এবং নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হিসেবে দেশে-বিদেশে চর্চিত, তখন প্রথম ধারাটিকে উপেক্ষা করা চলে না। পড়াশোনার উৎকর্ষের কেন্দ্র সৃষ্টি এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু ঝাঁ চকচকে উৎপাদন ও কর্মের কেন্দ্রবিন্দু প্রতিষ্ঠা করতে না পারা এ রাজ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটা মেনে নেওয়ার সময় হয়েছে। সংশোধন করারও।
অতিমারি চলে যাওয়ার পর এই ভয়ানক সমস্যাগুলো দেশে ও রাজ্যে আরও কত দিন দাপিয়ে বেড়াবে, সে সব নিয়েই বেশি চিন্তা আবশ্যক। সব বাবা-মা ভাবেন, কেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাড়ির ভাত খেয়ে কাজ করতে পারেন না। সে ব্যাপারে রাজ্যের কোনও দায় নেই। কিন্তু তা বলে বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, মুম্বই, পুণে, দিল্লি, চেন্নাই, এ সব জায়গায় গেলেই চাকরি পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে চাকরি কোথায়? এটা গ্লানিকর, অন্য দিকে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু নিয়ে লাফালাফি করার কোনও মানে নেই, কারণ চিনের কাছাকাছি আসতে এ দেশের শিল্প এবং অর্থনীতিকে বহু পথ পেরোতে হবে। মাঝেমাঝে আমরা আসলে কত খারাপ, এ কথাটাও মনে রাখা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy