কমলা ভাসিন ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক, বন্ধু এবং পরিবারের অংশ। —ফাইল চিত্র
কমলা ভাসিনের সান্নিধ্যে আমি প্রথম এসেছিলাম ১৯৯৫ সালে জয়পুরে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ওমেনস স্টাডিস’ (আই এ ডব্লিউ এস)-এর সম্মেলনে। তিনি তখন ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলনের নক্ষত্র। আর আমি সবে টলমলে পায়ে আন্দোলনের অংশ হতে শুরু করেছি।
সেই সম্মেলনের কয়েক মাস আগেই তৈরি করেছি ‘স্বয়ম’। কমলার গান, নাচ আর আকর্ষণীয় স্লোগানে সেই সম্মেলন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। নারী আন্দোলনের অন্যান্য কর্মীর মধ্যে তাঁর উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী। আমি নারী আন্দোলনের নেত্রীকে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছিলাম। সকলের সঙ্গে হাসি মুখে, আন্তরিকভাবে কথা বলছিলেন তিনি, চোখ ঝলমল করছিল। সম্মেলনে তাঁর সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত পুত্র ‘ছোট্টু’-কে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং সস্নেহে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি আরও অনেক মেয়েদের মতোই সে দিন ওঁর চারপাশে ঘুরেছিলাম। কথা বলতে পারিনি, কেন জানি না বাধোবাধো ঠেকছিল। ওঁর উদ্যমী আচরণ আর ছোঁয়াচে হাসিতে মগ্ন হয়েছিলাম সে দিন।
কয়েক বছর পরে, ১৯৯৯ সালে আমার আবার কমলার সঙ্গে দেখা হয়। ‘স্বয়ম’-এর পরিচালনায় নারী নির্যাতন বিরোধী ১৬দিন ব্যাপী প্রচার অভিযান উপলক্ষে কমলা এসেছিলেন কলকাতায়। আমরা বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে যে ভাবে এর পরিকল্পনা করেছিলাম, তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কমলা। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে ওঁর পরিচালনায় দক্ষিণ এশিয়ার মহিলাদের জন্য এক মাস ব্যাপী ‘লিঙ্গ ও স্থায়ী উন্নয়ন’ সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে এই প্রচারাভিযান সম্পর্কে বলার জন্য।
‘স্বয়ম’ থেকে আমরা তিন জন ওঁর সঙ্গে কাটিয়েছিলাম পাঁচ দিন, অসাধারণ সে অভিজ্ঞতা! শিখলাম কী ভাবে শুধু বৌদ্ধিক স্তরে কঠিন আলোচনার মাধ্যমেই নয়। গান, কবিতা, হাসিঠাট্টা আর ঐক্যের মধ্য দিয়েও বিষয়গুলো শেখা যায়। হেসে ফেলি আজও, যখন মনে পড়ে প্রথম সন্ধ্যায় টানা দু’ঘণ্টা কৌতুকে ভরিয়ে রেখেছিলেন কমলা। মজার মজার কথা বলেছিলেন। দু’ঘণ্টা পর হাসিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল সবাই, যেন মুক্তির আনন্দ। মজা করার কল্পনাতীত ক্ষমতা ছিল কমালর। নারীবাদী কৌতুকগ্রন্থ লিখেছিলেন, যা পড়লে নিজেদের দিকে তাকিয়ে হেসে খুন হন নারী আন্দোলনের কর্মীরা।
সেই থেকে আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলেন কমলা। তিনি ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক, বন্ধু এবং পরিবারের অংশ। ছিলেন ‘স্বয়ম’-এর একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। ২০০৫ সালে তিনি সংস্থার পরিচালন সমিতিতেও যোগ দিয়েছিলেন। আজ আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি, তাতে ওঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যখন দিল্লি যেতাম, ওঁর বাড়ি ছিল আমার বাড়ি। আর কমলা কলকাতায় এলে আমার বাড়ি হয়ে উঠত ওঁর বাড়ি।
কমলা ছিলেন আমার দেখা অন্যতম প্রাণবন্ত, সৃজনশীল, উদ্যমী, বহুমুখী প্রতিভার এক মানুষ। নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার এবং সকলকে ভালবাসতে পারার অনায়াস ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। কবি ও লেখক কমলা আবেগ এবং উৎসাহের সঙ্গে নারীর অধিকার এবং ক্ষমতায়নের স্থির লক্ষ্যে কাজ করে গিয়েছেন আজীবন।
পাশাপাশি স্থায়ী উন্নয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে সত্তরের দশক থেকে ধারাবাহিক ভাবে কাজ করেছেন তিনি। নয়াদিল্লির ‘জাগরী ওমেন্স রিসোর্স অ্যাণ্ড ট্রেনিং সেন্টার’ এবং হিমাচল প্রদেশের ‘জাগরী গ্রামীণ’ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কমলা। ১৯৯৮ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘সঙ্গত’ নামের দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী মঞ্চ। কঠিন ধারণাগুলিকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার অনন্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। কমলার লেখা ৩০টির বেশি বই, ২০০টি গান আর কবিতার বেশিরভাগই দক্ষিণ এশীয় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
লিঙ্গ, পিতৃতন্ত্র, নারীবাদ এবং পৌরুষ নিয়ে লেখা তাঁর বইগুলি দক্ষিণ এশীয় নারী সংগঠন সমূহে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মানবীবিদ্যা চর্চা বিভাগে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং আমাদের সেই বিষয়ে চেতনা তৈরির ভিত হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর গান আর স্লোগান গ্রামে, মফস্সল এলাকায় এবং শহরের নারীদের মধ্যে অনুরণিত হয়েছে বারবার এবং নারীবাদী আন্দোলনের জমায়েতগুলিকে উজ্জীবিত করেছে। পাকিস্তানের নারীবাদী কর্মীদের কাছ থেকে শেখা ‘আজাদি’ স্লোগান শুধুমাত্র পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধেই নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও তিনি ব্যবহার করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সংহতির লক্ষ্যে গঠিত ‘পাক-ইন্ডিয়া পিপল্স ফোরাম ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস’ (পি আই পি এফ ডি পি), ‘সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস’ (এস এ এইচ আর) এবং ‘ওমেনস ইনিশিয়েটিভ ফর পিস ইন সাউথ এশিয়া’ (ডব্লিউ আই পি এস এ)-এর মতো মঞ্চগুলির সঙ্গে যুক্ত এবং কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন কমলা।
সব সীমানার বাঁধন পেরিয়ে সবাইকে একত্রিত করার অনন্য ক্ষমতা ছিল কমলার। নিজেকে ‘দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা’ বলতেন। শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বিভিন্ন দেশের মহিলাদের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন বন্ধুত্বের সেতু। ‘সঙ্গত’-এর মাধ্যমে তাঁর দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে তিনি আমার পরিধিরও ব্যাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। প্রতি বছর ‘সঙ্গত’-এর লিঙ্গ, স্থায়ী উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং শান্তি সংক্রান্ত একমাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ শিবিরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মহিলাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আর ঐক্যের উন্মেষ ঘটত। প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে তিনি রঙিন ওড়না আর তাঁর ভালবাসায় ভরা আলিঙ্গন দিয়ে স্বাগত জানাতেন।
যে কোনও বাধা অতিক্রম করতে, মতানৈক্যের সমাধান করতে এবং সংহতি গড়ে তুলতে মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন কমলা। সেই উদ্দেশ্যেই কর্মশালায় ভিন্ন দেশের দুই প্রতিনিধিকে এক ঘরে থাকতে দেওয়া হত। যাতে তাঁরা একে অপরের সংস্কৃতি, তাঁদের মিল এবং অমিলের জায়গাগুলি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং একে অপরকে বুঝতে পারেন। প্রশিক্ষণ শিবিরের একটি উল্লেখযোগ্য অধিবেশন হল নিজের দেশকে উপস্থাপন করা। যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা যৌথ ভাবে নিজ নিজ মাতৃভূমির ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গান, নাচ এবং অন্যান্য সৃজনশীল পরিবেশনার মাধ্যমে সকলের সামনে তুলে ধরেন।
ওই সমস্ত অসাধারণ উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী একে অপরকে নতুন ভাবে দেখতে শুরু করেছিলেন, বুঝতে শুরু করেছিলেন কোথায় কোথায় একে অপরের সঙ্গে মিল, কোথায় কোথায়ই বা অমিল। মিল-অমিলের সেই অনন্যতাই আমাদের সমৃদ্ধ করে, সেই সার কথাও এই পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সকলের কাছে। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
নতুন কিছু শেখার জন্য কমলার মন ছিল উন্মুক্ত। বিভিন্নতাকে সন্মান করতেন তিনি। সক্রিয় ভাবে বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষদের একত্রিত করতেন। তিনি ভালবাসার শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন, শক্তির ভালবাসায় নয়। সেই ভালবাসাই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করতেন। ফলে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে যাঁরা ‘সঙ্গত’-এর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং আমরা যাঁরা ‘সঙ্গত’-এর সঙ্গে যুক্ত আছি, তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত পরিসর ও কর্মক্ষেত্রে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
কমলা অনায়াসে সকলের সঙ্গে মিশতে এবং ভাবনার আদানপ্রদান করতে পারতেন। খুব সহজেই মিশে যেতে পারতেন গ্রামের মহিলা থেকে শুরু করে আমলা, সমাজকর্মী, রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি বা সিনে তারকাদের সঙ্গে। কমলা মনে করতেন, নারীবাদ আসলে নারী-পুরুষের মধ্যে লড়াই নয়। লড়াই আদর্শের। এক দিকে পিতৃতান্ত্রিক দর্শন ও বৈষম্য। অপরদিকে সাম্য এবং শান্তি। কাউকে আক্রমণ না করেই তিনি বোঝাতে পারতেন অনেককিছু। খুঁটিয়ে পরিকল্পনা করতেন সমস্ত অনুষ্ঠানের। কোন স্লোগান কখন ব্যবহার করা হবে, কোথায় কোন পোস্টার থাকবে, কী করলে বর্ণময় এবং ভাল লাগবে অনুষ্ঠান— সব মাথায় থাকত কমলার। তাঁ সব সময়ের সঙ্গী ছিল একটা নোটবুক । যেখানে অনেক কিছু লিখে রাখতেন। বক্তৃতা করার আগে নিজের হাতে সেটা নোটবুকে লিখে রাখা ওঁর অভ্যাস ছিল। বুঝতে পারতাম, যাঁরা তাঁর কথা শুনতে আসছেন, তাঁদের কতটা সন্মান করতেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে অপরিসীম আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও সকলের মধ্যে তাঁর ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন কমলা। অন্যদের ভরিয়ে দিয়েছেন আনন্দে। দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অসংখ্য মানুষের মনে তিনি চিরকালীন স্থান করে নিয়েছেন এই ভালবাসার জোরেই। উনি সকলের সঙ্গে এমন ভাবে মিশতেন যে, প্রত্যেকে মনে করতেন ওঁর হৃদয়ে তাঁর জন্য একটি বিশেষ স্থান আছে।
সারাজীবন ধরে নীরবে কমলা এ ভাবেই কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর চেতনার সম্পদ দিয়ে তৈরি করেছেন একটি সংস্থা, যা তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । যে শূন্যস্থান তাঁর অনুপস্থিতিতে তৈরি হবে, তা কোনওদিনই পূর্ণ হওয়ার নয়। কিন্তু তিনি থেকে যাবেন আমাদের সকলের হৃদয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুপ্রাণিত করে যাবেন আমাদের।
(লেখক ‘স্বয়ম’ এর প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্ত্রী, মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy