বিজয়গড় অঞ্চলের এক বাড়ির পুজো। পুজো করেন গৃহকর্তা নিজেই। ছেলেমেয়ে বিদেশে স্থিত, প্রতি বছর মা দুর্গার সঙ্গেই তাঁদের আগমন। দিনকয়েক বাড়িতে কাটিয়ে ফের পাড়ি দেন নিজের কর্মস্থলে। কিন্তু পুজোর হরেক ঝক্কি সামলায় কে? গৃহকর্ত্রী-সহ পরিবারের অন্যরা পুজোর কাজে ব্যস্ত। সংসারের খুঁটিনাটি কাজ, পুজোর ক’দিনে বাড়িতে আসা আত্মীয়-পরিজনদের থাকা-খাওয়ার তদারকি, পুজোর বাসন, ভাঁড়ার ঘর সামলে রাখার দায়িত্ব দিনকয়েকের জন্য গ্রাম থেকে আসা যে মহিলা সযত্নে নিজের হাতে তুলে নিতেন, তিনি পরিবারের রক্তের সম্পর্ক নন, ধর্মে মুসলমান। কিন্তু ধর্ম, আত্মীয়তা— সব পরিচিতি ছাপিয়ে কখন যেন নিঃশব্দে তিনি উৎসবের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন, আসলে পরিবারটির আত্মার সঙ্গেই মিশে গিয়েছিলেন। এখন তাঁরও বয়স হয়েছে, অশক্ত শরীরে পুজোর ধকল তিনি আর বেশি দিন হয়তো বইতে পারবেন না। তাঁর অনুপস্থিতিতে বাড়ির পুজো মসৃণ, সর্বাঙ্গসুন্দর হবে কী করে, সেই ভেবে হয়রান পরিবারের সদস্যরা। কাজের মানুষ হয়তো আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু এতগুলো বছরে তাঁর সঙ্গে যে এক নীরব বন্ধন তৈরি হয়েছে, যে অপার ভরসার জায়গাটি নির্মিত হয়েছে, তার বিকল্প তৈরি হবে কি?
বাঙালির উৎসব এমনটাই। আড়ম্বর, ঢাকের বাদ্যি, নতুন জামা, কার্নিভাল— এ সবই তার বাইরের মোড়ক, রূপসজ্জার শেষ টান। ভিতরে থাকা টলটলে মুক্তোটি হল পারস্পরিক বন্ধন, মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন। সারা বছর যাঁদের অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতিটুকু মনেই পড়ে না, উৎসব এলে সেই অস্তিত্বগুলোও বেরিয়ে আসে চালচিত্রে নিজের জায়গাটি তৈরি করে নিতে। ভাদ্র-আশ্বিনের রোদ চড়লেই যেমন মনে পড়ে ফর্সা টকটকে, টিকালো নাক, আর গালে ঈষৎ লালচে আভার শালওয়ালার স্মৃতি। তখনও আমি হাঁস-মুরগি আঁকা ফ্রক পরি। পুজোর ঠিক আগেই শ্রীনগর ছেড়ে নীল বস্তায় ভর্তি মাখন-নরম শাড়ি, কাশ্মীরি কাজের চুড়িদার পিস নিয়ে বাড়িতে হাজির হতেন। আর পুজো-শেষে সেই ঝুলি থেকেই বেরিয়ে আসত উপত্যকার গন্ধ-মাখা কাশ্মীরি ফিরান, জ্যাকেট, শালের স্তূপ। বিস্তর দরাদরি-অন্তে তাঁর হতাশ মুখের “ঠিক হ্যায়, মা জি, আপনের মর্জি” এখনও কানে বাজে। সে তো শুধু বিকিকিনির সম্পর্ক নয়, অশান্ত উপত্যকার কত খবরই যে মিলত তাঁর কাছ থেকে। আর মিলত উপহার হিসেবে কিশমিশ, আখরোটের ঠোঙায় নিখাদ ‘কাশ্মীরিয়ত’-এর ছোঁয়া।
আরও যে কতশত চরিত্র আনাগোনা করে চোখের সামনে। মায়ের কাছে সারা বছরের শাড়ির পাড় বসাতে, কাঁথা বোনার জন্য আসত একটি মেয়ে। ভাইয়ের সংসারে থাকে। বাড়ি ঘুরে-ঘুরে অর্ডার নিয়ে বেড়ায়। পুরনো প্যান্টের কাপড় কেটে চমৎকার কাপড়ের ব্যাগ বানাত। মধ্যবিত্ত সংসারে কোনও জিনিসই তখন অতিরিক্ত নয়। পরিবেশের প্রশ্নে রিসাইক্লিং-এর গুরুত্ব সাধারণ গৃহস্থ ঘরে ঢুকে পড়ার বহু আগে থেকেই প্রয়োজনের তাগিদে পুরনো-ছেঁড়া, ফেটে যাওয়া সামগ্রীকে একটু এ দিক-ও দিক করে নতুন রূপ দেওয়া হত। সেই কাজে এই মেয়েদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। দু’-চার খানা কাপড় পুরনো হলেই ডাক পড়ত তার। পাতলা বালাপোশ, কাঁথা, টেবিলের ঢাকা, লেপের খোলস— কত কী যে তার হাত থেকে বেরোত। পুজোর আগে তার নিঃশ্বাস ফেলা সময় ছিল না। সারা বছরের মলিন মুখে ওই সময়ই যা একটু হাসি দেখতাম। হাতে বাড়তি টাকা পেয়ে ভাইপো-ভাইঝিদের জামা কিনে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সংসারে একটু সম্মান কিনে নেওয়ার হাসি।
সেই প্রসন্নতাই দেখতে পেতাম পাড়ায় কাপড় বিক্রি করতে আসা মাসির মুখেও। সারা বছর ঠা-রোদে-জলে ঘুরে হাঁক দিয়ে দিয়ে বেশির ভাগ সময় বন্ধ দরজার বাইরে থেকে ফিরে যাওয়াই যাঁর নিয়ম ছিল, পয়লা বৈশাখ-পুজোর কালে তিনিও নেহাত খালি হাতে ফিরতেন না। উৎসবের মুহূর্তে আরও কিছু বাড়তি কাপড়ের প্রয়োজনে তাঁর জন্য দরজা খুলত। খবর নেওয়া হত, গ্রামের বাড়ির, ফসলের, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার, আর বন্যার। পুজোর মুখেই গ্রামবাংলায় বন্যার হাহাকার তো নতুন কিছু নয়।
সম্প্রতি সোমা সেনের মায়েরা ও মেয়েরা বইটি পড়তে গিয়ে এমনই কিছু প্রায় বিস্মৃত ছবির কথা মনে পড়ল। লেখিকা বলেছেন মালিনী মালাকারের কথা। শোলার কাজ তাদের পারিবারিক ব্যবসা। দক্ষ হাতে সে বানাত ঠাকুরের মুকুট, মালা, চাঁদমালা। পরের দিকে কুলোর উপর বা বাক্সের মধ্যে ঠাকুরের মুখ, দুর্গা, সরস্বতী, গণেশের মূর্তি, ময়ূরপঙ্খী নৌকা... কিন্তু বছর দশেকের চেষ্টায় পায়ের তলার যে মাটি তৈরি করেছিল সে, তা-ও সরে যাওয়ার উপক্রম হল লকডাউনের দিনে। ভাইরাসের আতঙ্কে পারিবারিক উৎসবের টোপর, মুকুট বিক্রিও বন্ধ তখন। একটু আলোর আশায় মালিনী ছুটে এসেছিল লেখিকার কাছেই, উগড়ে দিয়েছিল ভিতরে আটকে রাখা হাহাকার।
সে বইয়ের আলতামাসিদের সঙ্গে কি আমাদেরও পরিচয় ঘটেনি? দিদিমার বাড়ি বৃহস্পতিবারের বিকেল, উৎসব-ব্রত-পার্বণ মানেই আলতাবৌয়ের আসার সময়। পা ঘষেমেজে আলতা পরাতে পরাতে কত যে গল্প দিদিমার সঙ্গে। ছেলের বিয়ে, বিয়ের পরের অশান্তি, ওই সামান্য রোজগারের ভরসায় বাড়ির এক কোণে প্রায় পঙ্গু বর আর নিজের ব্যবস্থাটুকু করে নেওয়া— কথা বলতে বলতে চোখের জলে ঝাপসা দৃষ্টিও আলতার টানকে একবিন্দু নাড়াতে পারত না।
এ তো গেল শুধুই মেয়েদের কথা। অন্দরমহলের ছোট ছোট কাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকা পুরুষদের ভূমিকাও কি কম ছিল নাকি? অতি রক্ষণশীল পরিবারে ঠাকুরঘরে গঙ্গাজল পৌঁছে দেওয়ার ‘ভারী’, পুজো-পার্বণে বাড়ির বৌদের শাঁখাপলা পরাতে আসা শাঁখারী, নতুন কাপড়ের বোঝা নিয়ে আসা তাঁতি— এঁদের জন্য কোনও বাড়ির দরজা কখনও বন্ধ হয়নি।
নিছক বাণিজ্যিক বা পরিষেবা-প্রদানকারীর গণ্ডিতে তাঁদের আটকে রাখা যাবে না। গরমের দিনে, ক্লান্ত মুখে তাঁরা হাজির হলে অনেক বাড়ির কর্ত্রীই তাঁদের বাতাসা-জল, মুড়ি-বাতাসা, আবারও কখনও দুপুরের ভাতটুকু খাওয়াতেন। ফিরে যাওয়ার সময় ছেলেপুলেদের ‘জল খাওয়ার’ জন্য হাতে টাকা গুঁজে দেওয়া হত। বিয়ের পরে দেখেছি শ্বশুরবাড়িতে দৈনন্দিন দুধের জোগান দিতেন যিনি তিনি ধর্মে মুসলমান। সেই দুধ রক্ষণশীল, নিয়মনিষ্ঠ বাড়ির পুজোর কাজেও লাগত। বাড়িতে এসে প্রতি দিন তিনি বাংলা খবরের কাগজ পড়তেন। দেশের খবর নিয়ে দাদাশ্বশুরের সঙ্গে তাঁর আলোচনা শোনার মতো ছিল।
বাঙালি পুজোয় ধর্ম, জাত যে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, তেমনটা ভাবলে ভুল হবে। ভেদাভেদের মানসিকতা সে কালেও ছিল, এ কালেও আছে। কিন্তু হামেশাই পারস্পরিক সম্পর্কের দাবি সেই বিভেদকে হারিয়ে দিয়েছে। নতুন বন্ধন রচিত হয়েছে, আবার সেই চরিত্ররা হারিয়ে গেলে যেন একটা পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। উৎসবের সময় নতুন জামাকাপড় দেওয়ার প্রথাটিও কি আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে না? সেই কেনা কি শুধুই নিজের পরিবারের জন্য? পরিবারের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের হাতে, তার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিচার না করেই, একটি অন্তত জামা তুলে দেওয়া, নিদেনপক্ষে জামা কেনার টাকা দেওয়ার রীতির মধ্যে দিয়েও অনায়াসে এক-একটি সম্পর্ক বোনা হয়ে যায়।
এটাই তো উৎসব। সে উৎসবের হাসি, আনন্দ শুধু একার জন্য নয়, অনেককে নিয়ে, অনেকের জন্য। সে উৎসবে জোর করে ‘ফেরা’ যায় না। সেই উৎসব বাঙালির শিরা-ধমনীতে জেগেই থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy